মোহাম্মদ রফিক: কিছু শোক কিছু স্মৃতি
মোহাম্মদ এনায়েত হোসেনপ্রকাশিত : আগস্ট ০৭, ২০২৩
গতকাল ছিল ২২ শ্রাবণ– বাঙালির জীবনে এক স্মরণীয় দিন, বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। এই গতকালই প্রয়াত হলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে মেরুদণ্ডসম্পন্ন কবি মোহাম্মদ রফিক। পার্থক্য রবীন্দ্রনাথ মারা যান ১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ, আর মোহাম্মদ রফিক ১৪৩০ সালের ২২ শ্রাবণ– মাঝখানে ৮২ বছরের ব্যবধান।
আমরা যারা বিগত শতকের আশির দশকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, তাদের কাছে মোহাম্মদ রফিক ছিলেন কীর্তিনাশার কবি, গাঁওদিয়ার কবি, কপিলার কবি, খোলা কবিতার কবি। এগুলো তার একেকটি অত্যুজ্জ্বল শেকড়-সন্ধানি কাব্যগ্রন্থ, বাঙালির ভাগ্যরেখার সাথে যার নিবিড় সম্পর্ক। আমরা তার কবিতা পড়ে আলোড়িত হয়েছি, তাকে ঘিরে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। কিন্তু ক্রমশ লক্ষ্য করেছি মোহাম্মদ রফিক শুধু আমাদের নন, তিনি যেমন ইংরেজি বিভাগের গণ্ডি ছাড়িয়ে পুরো বিশ্বদ্যিালয়ের, তেমনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং সমগ্র দেশের।
আমার মনে আছে, তার স্বৈরশাসন বিরোধী কাব্যগ্রন্থ ‘খোলা কবিতা’ বের হবার পরপরই কীভাবে তাঁকে অভিনন্দন জানাবার জন্য চট্টগ্রাম থেকে বলা যায় দৌড়েই এসেছিলেন প্রয়াত উপাচার্য সুসাহিত্যিক আবুল ফজলের ছেলে আবুল মোমেন এবং পথে তার সাথি হয়ে সানন্দে এসেছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সংগীত সাধক ওয়াহিদুল হক।
আমাদের পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মোহাম্মদ রফিক ছিলেন আমাদের বন্ধু, শিক্ষাগুরু, পথপ্রদর্শক ও দীক্ষাদাতা দার্শনিক। আমাদের সময়ে এবং আমাদের পরেও দীর্ঘ সময় তিনি ছিলেন ছাত্রছাত্রীদের কাছে এক স্বনামধন্য লিজেন্ড, রীতিমতো কিংবদন্তি! তিনি আমাদের চেতনাকে শাণিত করেছিলেন, আমাদের যৌবনকে উদ্দীপিত করেছিলেন, আমাদেরকে স্বদেশলগ্ন করেছিলেন এবং অনাচার ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামমুখর করেছিলেন। আমরা জাহাঙ্গীরনগরের গহিন গ্রামীণ পরিমণ্ডল থেকেই তখন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছি, মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছি, ‘শিক্ষানীতির জারি’ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় উপস্থিত হয়েছি।
এরপর অনেক সময় পার হয়ে গেছে, মোহাম্মদ রফিকের রচনা-রীতিতেও পরিবর্তন এসেছে, তিনি নতুন ধারার কাব্য-রচনার প্রয়াস নিয়েছেন, গদ্য-রচনায় নিবিষ্ট হয়েছেন এবং ‘পথিক পরান’ নামে তিনখণ্ডে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও রচনা করেছেন। এগুলো তার তরফ থেকে সময় ও সাহিত্যের বিভিন্ন দিগদিগন্তকে স্পর্শ করার প্রয়াস, এবং এসবক্ষেত্রে তার গুরুত্ব কিংবা সফলতা-বিফলতা আলাদাভাবে সম্যক আলোচনার দাবি রাখে।
কর্মজীবনের অবসানে দীর্ঘ অবসরে কবি মোহাম্মদ রফিক প্রচুর লেখাপড়া করেছেন; দেশ, কাল, সমাজ সাহিত্য, বিশ্ববীক্ষা নিয়ে প্রচুর চিন্তাভাবনা করেছেন। এসময়ে তিনি এক অসাধারণ কথক ও চেতনার ভাষ্যকারে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি তার উপলব্ধিকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাইতেন, সবার মনে অনুভূতির সঞ্চারণ ঘটাতে চাইতেন। তার কাছে বসলে ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে যেত, তার কথা শেষ হতো না। আজ দুঃখ হয়, আমরা তার কথাগুলো শুনবার জন্য তেমন সময় দিতে পরিনি, তার কথাগুলো অনুচ্চারিতই রয়ে গেল, থেমে গেল তার দিগদিগন্তের অভিযাত্রা! আমাদের সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের পতন ঘটল।
তবুও শেষ করার আগে কবি মোহাম্মদ রফিককে সশ্রদ্ধ সালাম জানাই, মৃত্যুর আগেও এই ৮০ বছর বয়সে তিনি কী দারুণ মাটি ও মানুষলগ্ন ছিলেন! যেমন আমরা তার সাম্প্রতিক স্ট্যাটাসগুলোতে দেখি:
• স্ট্যাটাস : ২৯ জুলাই ২০২৩
That whole world is a big prison yard/where some of us are prisoners, the rest of us are guards’ – sings Bob Dylan in memory of the cutting down of George Jackson.
What America dares to talk about human- rights self- made issue in our Bangladesh!
They must have some shame!
Dear friends, please read Malcolm X’s Autobiography and learn what kind of hypocrites and killers they are!
• স্ট্যাটাস : ৩০ জুলাই ২০২৩
বাংলাদেশ, বাঙালির প্রগাঢ় অস্তিত্বসংকট;
এখন বুঝি, কী প্রকার আরব বসন্তের ধুয়া তুলে গাদ্দাফিকে হত্যা করা হয়েছে, এই সেদিনের ঐশ্বর্যশালী লিবিয়াকে নুড়িতে ধুলিতে পরিণত করা হয়েছে ; ভয় হয়, অচিরে বাংলাদেশ না পেলেস্টাইনে পরিণত হয়, আর বাঙালি ঘরহারা একটি জাতি!
নিজেকে প্রবোধ দেয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলি প্রতিক্ষণ!
মৃত্যু জীবনের এক অমোঘ পরিণতি। কবি মোহাম্মদ রফিকের কোনো কোনো কবিতায় মৃত্যু ছায়া ফেলেছে। সেই মৃত্যুর মধ্য দিয়েও তিনি এই স্বদেশের শরীরে মিশে থাকার প্রগাঢ় আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন:
আজ রাত। সৃষ্টির প্রপাত যেন
আমাকে আমুণ্ডু গ্রাস করে নিল।
অন্ধকারে জ্বলে উঠল বিদ্যুতের ফণা
ঢেলে গেল বিষ মাংসে হৃৎপিণ্ডে-হৃদয়ে
উজ্জীবন, ঘটে বিস্ফোরণ জরায়ণে,
তাই বলি, অকাল-মৃত্যুকে ক্ষমা করে দিও।
মিশে রইব স্বদেশের বেহুলা শরীরে,
ভেসে যাব গাঙুড়ের জলে।
ঢাকা থেকে কয়েকদিনের জন্য কবি গিয়েছিলেন বাগেরহাটে তার পৈতৃক বাড়িতে। চিকিৎসার জন্য তাকে আবার ঢাকায় আনা হচ্ছিল। তিনি পথিমধ্যেই মারা গেলেন। তাকে আর ঢাকায় আনা হলো না। তাকে বাগেরহাটে নিজগ্রাম বইটপুরে হয়তোবা এতক্ষণে সমাহিত করা হয়েছে। হয়তোবা তিনি এটাই চেয়েছিলেন:
বেশ তো চলছিল, কাল মহাকালে;
হঠাৎ বৃষ্টির রঙ কাল বৃক্ষপত্রে,
খেতে মাঠে তেপান্তরে ও প্রান্তরে
সারে-সারে পাতো রোয়া না হতেই
ধান কাটা হয়ে গেল সারা কৃষকের;
জন্ম মৃ্ত্যু একাকার মূঢ় হতভম্ব আমি,
থমকে আছি বইটপুর গাঁয়ের সীমানা ছুঁয়ে
অবিশ্বাস্য/ মোহাম্মদ রফিক
বইটপুরে নিজ গাঁয়ের মাটির বিছানায় ঘুমান কবি। আপনার মুক্তিযুদ্ধ সফল হোক এবং আপনার ওপর বর্ষিত হোক অবিরাম শান্তির ধারা। ভালো থাকুন আপনি, ভালো থাকুক এই বাংলাদেশ। আপনাকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন।