মোহাম্মদ মোদাব্বের ছোটগল্প ‘ডানপিটে টুটুল’

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৬, ২০২০

শিশুসাহিত্যিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের আজ জন্মদিন। ১৯০৮ সালের ৬ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বশিরহাট মহকুমার হাড়োয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত ‘ডানপিটে টুটুল’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

স্মাগলার মানে চোরাচালানীরা, আমার মনে হয় এখনও তাদের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। বুঝলে টুটুল, এখনও ওদের দলকে শেষ করতে পারা গেল না।
মাথা চুলকাতে চুলকাতে ইনসপেকটর রহমান বললেন।

কর্ণফুলি নদীর ঘাটে একটা শানের ওপর টুটুল আর তার ছোট বোন লিলি অবাক হয়ে ইনসপেকটর রহমানের মুখে চোরাকারবারীদের কাহিনী শুনছিল। রহমান সাহেব দীর্ঘ দিন ধরে নদী-পুলিশে চাকরি করছেন। অনেক জাঁদরেল চোরাচালানী তাঁর হাতে নাজেহাল হয়েছে। এখনও যে অনেক জলদস্যু আর চোরাকারবারী তাদের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে তাঁর আদৌ সন্দেহ নেই। তাই তিনি তাঁর মোটরবোটে যখন তখন কর্ণফুলির এ মোহনা থেকে ও মোহনা ঘূর্ণির মত ঘুরে বেড়ান, কখনও বা বঙ্গোপসাগরের ভিতর অনেকখানি চলে যান। আবার যখন একটু অবসর পান, এই ঘাটটিতে এসে একটু বিশ্রাম করেন। টুটুল ও লিলি প্রায়ই এইখানটায় এসে বসে। ওদের বাড়ি ঘাট থেকে বড় জোর পঞ্চাশ গজ দূরে। তাই রহমান সাহেবের সঙ্গে ওদের পরিচয় হয়েছে। রহমান সাহেবও ওদের সঙ্গে মন খুলে গল্প করেন।

চোরাচালানীরা এখনও তাদের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে শুনে টুটুল বলে: ওরা কি দেশের খুব ক্ষতি করে, ইনসৃপেকটর সাহেব?

‘তা আবার করে না? এ দেশের মাল চুরি করে পরের দেশে পাঠায়। আবার পরের দেশের মাল চুরি করে এ দেশে আনে। এতে দেশের শুল্ক আদায়ের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। তাতে কি কম ক্ষতি হয়? আমি যদি একবার কোনো খোজ পাই, তা হলে এদের বংশ ধ্বংস করে ছাড়ব। আর তা হলে আমার নিজেরও গৌরব বাড়বে।”
“ওরা কি কি জিনিস চালান করে, ইনসপেকটর সাহেব?” লিলি চোখ বড় বড় করে শুধোয়।।

“ধর, বিদেশ থেকে ওরা আনে রেশম, কলম, তামাক, আরো কত কি। এ দেশ থেকে ধান, চাল, পাট, চা ইত্যাদি।” রহমান সাহেব জবাব দেন।
“ওরা কি জাহাজ বোঝাই করে এইসব জিনিস চালান দেয়?” টুটুল জিজ্ঞাসা করলো।

“না, জাহাজ কোথায় পাবে! তবে নৌকা, মোটর লঞ্চ এইসব ওদের সম্বল। ওদের চলাফেরা দেখলে আমরা বুঝতে পারি, ওরা চোর।” রহমান সাহেব বললেন।

বেলা তখন শেষ হয়ে এসেছে। সূর্য ধীরে ধরে অস্ত গেল। মনে হল অত বড় সুর্যটা। ধীরে কর্ণফুলির পানিতে ডুব মারলো। টুটুল ও লিলি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ির পথ ধরলো। কিন্তু বাড়ি গিয়েও টুটুলের স্বস্তি নেই। সে ভাবতে থাকে, চোরাচালানীদের সে যদি খুঁজে বের করতে পারে, তা হলে রহমান সাহেবের খুব উপকার করা হবে। দেশও ক্ষতির হাত থেকে বাচবে। কিন্তু কেমন করে ওদের ধরা যায়। ভাবতে ভাবতে টুটুল পড়ার কথা ভুলেই যায়।

পরদিন বিকেলে টুটুল লিলিকে সঙ্গে করে আবার নদীর ঘাটে এল। ওরা বসে বসে দেখতে থাকে, কত সামপান ভেসে যায়। জাহাজঘাটে কুলীদের হৈচৈ। ছোট ছোট মোটর লঞ্চ তীরে ভীড় করে আছে। কারুর চোঙা দিয়ে সাদা-কালো ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। মনে হয় অনেক পথ দৌড়ে এসে ধুকছে। একটি একচোখো বুড়ো যে তফাৎ থেকে টুটুলদের দিকে তাকিয়ে ছিল, তা ওরা দেখতে পায়নি।

বুড়োটা ধীরে ধীরে ওদের কাছে এসে টুটুলের কাঁধে হাত দেয়। টুটুল ত ভয়ে চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। এ আবার কোথা থেকে এল। তার একটি চোখ। দেখে ও তো রীতিমত ঘাবড়ে যায়।
বুড়োটা বলে, ভয় পেয়েছ, খোকা? কিছু ভয় নেই।
টুটুল তেরিয়া হয়ে বলে, তুমি কে! কি চাও আমার কাছে!

“না, না, তোমার কাছে আবার কি চাইব। আমি বরং শুধোই, তুমি কি কিছু চাও খোকা?” বুড়ো লোকটা হাসতে হাসতে বেশ আদর মাখানো সুরে বললো। “হ্যা, তুমি যদি নদীতে বেড়াতে চাও, তা হলে আমি বেড়িয়ে আনতে পারি। আমার মোটর বোট আছে, এক নিমিষে সাগরের ধার থেকে ঘুরিয়ে আবার এখানে পৌঁছে দেব। যাবে?”

টুটুলের মন অনন্দে লাফিয়ে ওঠে। লঞ্চে চড়ে সাগরের ধার দিয়ে ঘুরে আসার কত আনন্দ। কিন্তু রহমান সাহেব এমন ভীরু, কিছুতেই নিয়ে যেতে চান না। বলেন কিনা, বিপদ হতে পারে। আরে, বিপদ কি আর এত সোজা যে, মনে করলেই এসে যাবে। এসব কিছু চিন্তা করে এখনই টুটুল বুড়োকে কোনো জবাব দিতে পারে না। আর একটু ভেবে দেখতে হবে ত। তাই সে বললো : আচ্ছা, আজ আমি কিছু বলতে পারছিনা, কাল এই সময় এখানে এসো। যাই তবে কালই যাবো।

বেশ বেশ, এই তো ভাল ছেলের মত কথা। আচ্ছা কালই আমি আসবো। তুমি যদি বেড়াতে চাও, তবে অনেক দূর থেকে বেড়িয়ে আনবো। আবার ঠিক এইখানটায় দিয়ে যাবো।—লোকটা খোঁড়াতে খোড়াতে নদীর ধার দিয়ে ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

টুটুল লিলির হাত ধরে বাড়ির পথে চললো। যেতে যেতে সে ভাবে, লোকটা তাকে বেড়িয়ে আনতে চায় কেন! ওরা চোরাকারবারীর দল নয় তো? তা যদি হয়, তা হলে খুব ভাল হয়। আমি ওদের সঙ্গে গিয়ে সব খবর জেনে রহমান সাহেবকে জানিয়ে দেব। এতে দুটো কাজ হবে। কিন্তু এ খবর বাড়িতে কাউকে বলা হবে না। বোনের দিকে চেয়ে বলে : বুঝলি লিলি, তুই কাউকে একথা বলবিনে।
লিলি ঘাড় দুলিয়ে বলে, আচ্ছা।

পরদিন টুটুল চললো নদীর ঘাটে। সঙ্গে লিলি। টুটুল চলতে চলতে বলে : বুঝলি লিলি, আজ মোটর লঞ্চের সেই লোকটির সঙ্গে নদীতে বেড়াতে যাবো। তুই কিন্তু কাউকে একথা বলিসনে। যদি ফিরতে দেরী হয়, তা হলে রহমান সাহেবকে বলবি, আমি এক অচেনা লঞ্চে করে বেড়াতে গিয়েছি। হয়ত সেটা চোরাকারবারীদের লঞ্চ। তা যদি হয়, তা হলে ঠিক ওদের ষড়যন্ত্র ধরে ফেলবো, তা দেখে নিস।

লিলি বিজ্ঞের মত বলে : ইস, উনি ধরে ফেলবেন! ওরা বুঝি কম চালাক। তোমায় জানতে দেবে কেন?
“জানতে দেবে না বললেই হল। আমি ওদের লঞ্চে উঠে একেবারে কালা সাজবো; ওরা নির্ভাবনায় আলাপ করবে। তা হলেই আমার কাজ হাসিল। কি বলিস, ভাল যুক্তি নয়!”
লিলি মাথা দুলিয়ে বলে, তা ঠিক।

নদীর ঘাটে এসে টুটুল দেখলো, লোকটা আগে থেকেই ওদের অপেক্ষায় একটা পাথরের উপর বসে আছে। টুটুলকে দেখে ধূর্তের মত হেসে সে বললো : কি গো খোকা, যাবে নাকি বেড়াতে?
টুটুল কালা বনে গিয়েছে ততক্ষণ। সে শুনতে না পাওয়ার ভান করে বললো, কি বলছেন?

লোকটা এবার আরো একটু জোরে বললো, কি মত করলে, বেড়াতে যাবে? টুটুল এবারও শুনতে পায় না। শুধু চোখ বড় বড় করে বলে : আঁ, কি বললেন?

লোকটা মনে মনে খানিক গজগজ করে বলে, হুঁ, দেখছি ছেলেটা বদ্ধ কালা। এবার গলার স্বর সপ্তমে চড়িয়ে বলে : আজ যাবে কি? লঞ্চ যে এখনি ছাড়বে।
টুটুল এবার শুনতে পায়। বলে, হ্যা, আমি তৈরী।
“বেশ বেশ, চল তাহলে।” লোকটি খুশীতে যেন বাগে বাগ।

টুটুল লিলিকে বলে, লিলি তুমি এখন ঘরে ফিরে যাও, আমি এক্ষুনি ফিরে আসবো। লিলি বেচারী আর কি করে। মুখ কালো করে একা একা বাড়ির দিকে ফিরে চললো।

ওদিকে টুটুল লোকটির সঙ্গে এক ধূসর রংয়ের লঞ্চে গিয়ে উঠলো। লঞ্চে ইঞ্জিলে স্টার্ট দেওয়াই ছিল। এতক্ষন যেন রাগে গজ গজ করছিল। চলতে শুরু করায় লঞ্চটা ভীষণভাবে গর্জন করে উঠলো। দেখতে দেখতে ধোয়ার আড়াল করে সে তীর ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেল। বাইরে তখন ভীষণ কুয়াসা, কিছুই নজরে পড়ে না। টুটুল লঞ্চের জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে সে কি যে ভাবতে থাকে, তা সে-ই জানে।

টুটুলকে দেখে সব মাঝিমাল্লারা ছুটে এসে তার পাশে জড় হয়েছিল। লোকটি তার সঙ্গীদের বললো : এই ছোকরাটাকে নিয়ে এলাম, একে দিয়ে চাকরের কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে, কি বল?
“চমৎকার হবে। এই জন্যই তো সবাই বলি, কানা মংলুর মত বুদ্ধি দুনিয়ার কারুর নেই, কি বলিস চ্যাং।” রহীম বলে উঠলো!

যে লোকটি টুটুলকে এনেছিল, তার নাম মংলু। একটা চোখে দেখতে পায় না বলে ওকে সবাই কানা মংলু বলে। রহীমের কথায় মংলু খেকিয়ে ওঠে : বড় তো তামাসা করা হচ্ছে। বলি এতদিনে একটা লোকও আনতে পেরেছিস?
রহীম বলে, চটো কেন, আমি কি আর কিছু খারাপ বলেছি? এই চ্যাং-ই বলুক না।

চ্যাং ওদের দলের সেরা ডাকাত। ও চীনা কি বর্মী, তা চোহরা দেখে বুঝবার উপায় নেই। ওদের সবাই চ্যাংকে যেমন ভয় করে, তেমনি ভক্তিও করে। এতক্ষণ চ্যাং চুপ করে ছিল, ওদের তর্কে কান দেয়নি। এবার সে মুখ খুললো : ছেলে তো একটা আনলে, কিন্তু একটু বুঝে সুঝে এনেছ তো।

মংলু বলে, না জেনে কি আর এনেছি। দেখই না পরখ করে। ছেলেটা একে বোকা, তার ওপর আবার কালা। চেঁচিয়ে মরলেও শুনতে পায় না।
চ্যাং টুটুলকে পরীক্ষা করার জন্য জিজ্ঞাসা করে, এই ছোকরা, চা বানাতে পারিস?

টুটুল ওদের পানে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। ভান করে যে, সে কিছুই শুনতে পায়নি। এবার চ্যাং খুব জোরে চেঁচিয়ে বলে : চা করতে পারিস?
এবার টুটুলকে শুনতে হল। বলল, হ্যা, খুব পারি।

চ্যাং খুশী হয়ে বলে, ভালই হল। যা আমরা ওকে শুনতে দিতে চাইনে, ও এমনিতেই তা শুনতে পাবে না। মংলুর বাহাদুরি আছে বলতে হবে।
মংলু এবার খুশিতে ডগমগ করে, আমি না বুঝে কোনো কাজ করিনে।

মংলু টুটুলের সামনে এসে বলে, খোকা, এবার রান্নাঘরে যাও, আমাদের জন্য একটু চা বানিয়ে ফেল।। টুটুল এবারও শুনতে পায় না।
মংলু তখন আরও জোরে—এক বিকট চীৎকার করে বলে : রান্নাঘরে ঢুকে একটু চা তৈরি কর।
মংলুর কথা এবার যেন টুটুলের কানে গেল। সে আস্তে আস্তে উঠে রান্নাঘরের দিকে গেল। রান্নাঘর থেকেই টুটুল শুনতে পায়, ওরা যুক্তি করছে, রাঙ্গামাটি থেকে কিছু মাল তুলতে হবে আর রেশমী কাপড়ের গাঁটগুলি নামিয়ে নিতে হবে।

সারারাত আর সারাদিন লঞ্চ ছুটে চলেছে নদীর বুক চিরে। এক একবার এক এক ঘাটে লঞ্চ থামে। জিনিস বোঝাই করে আবার ছুটে চলে। লঞ্চের লোকেরা যা বলাবলি করছে, টুটুলের কানে সবই আসে। সে শুনতে পায়, চ্যাং বলছে যে, আজ ভোর হওয়ার আগেই রাঙ্গামাটিতে মাল নামাতে হবে আর চালের বস্তা লঞ্চে বোঝাই করতে হবে। কিন্তু সাবধান, ছোকরাটা যেন দেখতে না পায়, কোথায় আমরা লঞ্চ ভিড়াচ্ছি। জায়গা যদি চিনতে পারে, আর ছোকরা যদি কোথাও বেফাস বলে দেয়, তা হলে আমাদের দফারফা হবে।

মংলু বলে, সেজন্য ভেবো না। লঞ্চ ঘাটে ভিড়বার আগেই আমরা ওর চোখ বেঁধে কেবিনের মধ্যে ফেলে রাখবো। সেজন্য তোমরা ঘাবড়িও না। ওদের সব যুক্তিই টুটুলের কানে এল। ওর এখন একমাত্র ভাবনা, কি করে রহমান সাহেবকে খবর দেওয়া যায়। সে এর মধ্যে মতলব ঠিক করে রাখে। রান্নাঘরে একটি খালি বোতল ছিল, পকেট থেকে পেনসিল বের করে একটি ছোট কাগজে লিখলো : “চোরাচালানকারীদের সন্ধান পেয়েছি। ধূসর রংয়ের এক স্টীম লঞ্চ মাল নিয়ে রাঙ্গামাটির দিকে চলেছে। ওরা হয়ত বর্মার মধ্যে ঢুকে পড়বে। এই পত্র, যার হাতে পড়বে, তিনি যেন জল-পুলিশের কাছে খবর পৌঁছে দেন।” লেখা শেষ করে ও বোতলের মুখ ছিপি দিয়ে আচ্ছা করে বন্ধ করলো। তারপর তার ওপর একটা ছোট লোহার শিকে একটা ছেড়া ন্যাকড়া জড়িয়ে পতাকা করে নদীর পানিতে ফেলে দিল। নদীর উজান পানিতে বোতল ভাসতে ভাসতে চাটগাঁর দিকে চললো।

পরদিন ভোরবেলা লঞ্চ রাঙ্গামাটিতে পৌঁছতে পারলো না। ওরা ঠিক করলো, সন্ধ্যার আগে আর ঘাটে লঞ্চ ভিড়াবে না। রাতের অন্ধকারে যা হয় করা যাবে।

এদিকে টুটুলের বোতল ভাসতে ভাসতে চাটগাঁর কাছে এসে যায়। নদীতে জাহাজের খালাসীরা মাছ ধরছিল। তারা বোতল দেখতে পেয়ে ধরে ফেললো। বোতলের ছিপি খুলে কাগজ পেয়ে ওরা পড়ে ত অবাক। তখন মাছ ধরা ছেড়ে পানসি নিয়ে তারা থানার দিকে দৌড় দেয়। কিন্তু থানা পর্যন্ত যেতে হয় না, ঘাটেই রহমান সাহেবকে পেয়ে যায়। তিনি তখন লিলির সঙ্গে টুটুরের ব্যাপার নিয়ে আলাপ করছিলেন। খালাসীরা ওর কাছে গিয়ে বোতল সমেত চিঠিটা রহমান সাহেবের হাতে তুলে দিল। তিনি চিঠির ওপর একবার চোখ বুলিয়ে লিলিকে দেখতে দিলেন : দেখ ত লিলি, হাতের লেখাটা কার?

লিলি চিঠিটা পড়তেই চেঁচিয়ে ওঠে, এ ত টুটুল ভাইয়ের হাতের লেখা। ঠিক ও ডাকাতের হাতে পড়েছে। কি হবে রহমান সাহেব। -ও কাঁদো কাঁদো মুখে রহমান সাহেবের দিকে তাকায়।
“কিছু ভেবো না, এইবার বাগে পেয়েছি। এখনি আমি সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে স্পীডবোটে ওদের পিছনে ধাওয়া করছি। লঞ্চের চেয়ে চার গুণ বেগে চলে এই স্পীডবোট। কাজেই আজই সব শয়তান ধরা পড়ে যাবে।” রহমান সাহেবে আর অপেক্ষা না-করে লিলিকে বাড়ি ফিরে যেতে বলে থানার দিকে ছুটলেন।

রাতের অন্ধকারে মংলুদের লঞ্চ রাঙ্গামাটির ঘাটে ভিড়লো। একে একে ওদের মাল নামানো শুরু হয়। তার আগে ওরা টুটুলের চোখ বেঁধে কেবিনের মধ্যে ফেলে রেখেছিল।

ওরা মনে করেছিল, এখানে ওদের বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ জায়গাটা খুব নির্জন। পাশে ছোট পাহাড়ের টিলা। সুতরাং ওদের কারুর চোখে পড়বার ভয় নেই। কিন্তু

ওদের জন্য কি বিপদ যে অপেক্ষা করছিল, তা ওরা জানবে কেমন করে?
নিশ্চিত হয়ে ওরা যখন সবাই তীরে নেমে চোরাই মাল কাঁধে তুলতে যাবে, তখন ছোট ছোট টিলার আড়াল থেকে বজ্রকণ্ঠে রহমান সাহেবের হুকুম হল : যে যেখানে আছো, চুপ করে দাড়াও আর দু’হাত মাথার ওপর ওঠাও। নয়ত কুকুরের মত সবাইকে গুলী করে মারবো।

মংলু ও চ্যাংয়ের দল নিরুপায় হয়ে মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়ালো। টিলার আড়াল থেকে তখন পুলিশরা বেরিয়ে এসে ওদের সবার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।

রহমান সাহেব লঞ্চে উঠে প্রত্যেক কেবিন পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন। কেবিনের একটি দরজা খুলে দেখতে পেলেন টুটুল মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তিনি কালবিলম্ব না করে ওর মুখের বাধন কেটে দিলেন।
ছাড়া পেয়ে টুটুল বলে, ওদের গ্রেফতার করেছেন ত রহমান সাহেব?

“হঁ টুটুল, ওদের সব কটাকে পাকড়াও করেছি, আর ওরা আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু তুমি এ কি কাণ্ড করে বসেছিলে? বাপরে বাপ, কি ডানপিটে ছেলে। বলা নেই, কওয়া নেই, একেবারে ডাকাতের খপ্পরে।”
“বলে কয়ে এলে কি কেউ আসতে দিতো? আর না এলে কি ওরা এত সহজে ধরা পড়তো?” টুটুল বিজ্ঞের মত জওয়াব দেয়।

রহমান সাহেব সেবার বড় রকম পুরস্কার পেলেন আর চাকরিতেও উন্নতি হল। কিন্তু রহমান সাহেব সব সময় বলেন, এতে কি আমার কোনো বাহাদুরি আছে! সব বাহাদুরি ত ঐ ডানপিটে ছেলে টুটুল বাবুর।