মোহাম্মদ নাসির আলীর গল্প ‘ঋণ পরিশোধ’
প্রকাশিত : জানুয়ারি ১০, ২০২০
শিশুসাহিত্যিক মোহাম্মদ নাসির আলীর আজ জন্মদিন। ১৯১০ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তেলিরবাগ কালীমোহন দুর্গামোহন ইনস্টিটিউট হতে নাসির আলী ১৯২৬ সালে স্বর্নপদকসহ এন্ট্রান্স পাস করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে ‘ঋণ পরিশোধ’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
তখন বাদশাহ আকবরের রাজত্বকাল। দিল্লিতে তাঁর রাজধানী। ইতিহাসে নিশ্চয়ই পড়েছ, বাদশাহ আকবর খুব বুদ্ধিমান ছিলেন, রাজ্য চালাবার দক্ষতাও তাঁর যথেষ্ট ছিল। যদিও নিজে তেমন বিদ্বান ছিলেন না, তবুও বিদ্বান ব্যক্তিত্বকে যথেষ্ট কদর করতেন তিনি। গুণী, বিদ্বান, বুদ্ধিমান লোকদের জাতি-ধর্ম বিচার না করে নিজের দরবারে এনে তিনি পরম সমাদরে ঠাই দিতেন। আবুল ফজল, মোল্লা দোপিয়াজা, রাজা মানসিংহ, খান খানান, কবি গঙ্গা, ফৈজী, তানসেন, বীরবল ও তোডরমল- এই নয় জন বিশেষ জ্ঞানীলোক ছিলেন তাঁর দরবারে। তাঁদের ভিতর গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, রাজনীতিবিদ, হাস্যরসিক, ইতিহাসবিদ-সবাই ছিলেন। এক-এক বিষয়ে এক-একজন ছিলেন যেন একটি অমূল্য রত্ন। তাই তাঁদের নয়জনের দলটিকে বলা হতো `নবরত্ন’।
বাদশাহ আকবরের এ-নবরত্নের একজন ছিলেন এক গরিব ব্রাহ্মণ। তিনি হাস্যরসিক ছিলেন আর খুব গল্প বলে আসর জমাতে পারতেন। তাই যতই দিন যেতে লাগল বাদশাহ এ-ব্রাহ্মণের উপর ততই খুশি হয়ে উঠলেন। একদিন তাঁর গল্প শুনে তিনি বললেন: তোমার গল্প শুনে আজ যেমন হেসেছি, তেমন জীবনে কোনোদিন হেসেছি বলে তো মনে পড়ে না। তুমি যা বখশিশ চাইবে, তা-ই দেব তোমাকে। কী চাও তুমি?
ব্রাহ্মণ তখন উঠে বাদশাহকে কুর্নিশ করে বললেন: শাহানশাহ, সত্যিই যদি গরিবের উপর খুশি হয়ে থাকেন, তা হলে আপনার জল্লাদকে হুকুম করুন আমার পিঠে চাবুকের একশ ঘা দিতে। তা-ই হবে আমার মনের মতো বখশিশ।
বাদশাহ এ-কথা শুনে তাজ্জব হয়ে চেয়ে রইলেন তাঁর মুখের দিকে। আমীর-ওমরাহ যারা হাজির ছিলেন তাঁরাও অবাক! কে কবে শুনেছে চাবুকের ঘা চেয়ে নিতে বখশিশের বদলে?
বাদশাহ পুনরায় বললেন: কী তুমি চাও ঠিক করে বলো। চাবুকের ঘা কি কখনও বখশিশ হতে পারে? নিশ্চয়ই তুমি হাসি-তামাশা করছ।
ব্রাহ্মণ করজোড়ে বললেন: হুজুরের সঙ্গে হাসি-তামাশা করব তেমন বেয়াদব আমি নই। হয়তো আমিই প্রথম ব্যক্তি যে জাহাপনার কাছে এমন আজব ধরনের বখশিশ চেয়ে নিতে পারি। কিন্তু আমি সত্যিই বলছি, একান্ত যদি আমাকে বখশিশ দিতে হয় তবে যা চেয়েছি তা-ই দিন। আর তা যদি না দিতে হয়, কিছুই দেবেন না জাঁহাপনা।
বাদশাহ কিছুতেই রাজি হন না বেকসুর একটা লোকের পিঠে চাবুক মারার হুকুম দিতে। বখশিশ দিতে চেয়ে সাজা কী করে দেবেন? দরবারে নানারকম লোকই ছিল। কেউ-কেউ ছিল হিংসুটে। অল্পদিন হলো ব্রাহ্মণ এসেছেন শাহি দরবারে; কিন্তু এরই ভিতর তিনি বাদশাহর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছেন। ব্রাহ্মণের এ সৌভাগ্যে তারা তাঁকে হিংসা করত। হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরতো। তাদেরই একজন টিস্পনী কাটল: হয়তো বামুন ভেবেছে, চাবুকের পিটুনি খেয়ে ওর বুদ্ধি আরও খুলবে।
ব্রাহ্মণ তার দিকে ফিরে বললেন; সত্যিই তা-ই। সেজন্যই ওস্তাদ তাঁর শাগরেদদের বেতের পিটুনি দেন। কোনো-না-কোনো লোক পিটুনি খেয়েই শেখে। রোগ সারাতে পিটুনি যে কেমন ভালো ঔষধ একটু পরেই আপনারা তা দেখতে পাবেন।
বাদশাহ দেখলেন উপায়ান্তর নেই। ব্রাহ্মণ নাছোড়বান্দা, কিছুতেই তাঁর কথার নড়চড় হতে দেবেন না। অবশেষে নাচার হয়ে তিনি ব্রাহ্মণের পিঠে চাবুক মারতেই হুকুম দিলেন।
জল্লাদ এসে বেচারা ব্রাহ্মণকে চাবুক মারতে শুরু করল—শপাং শপাং। পঞ্চাশ ঘা মারবার পরে হঠাৎ ব্রাহ্মণ হাত উঠিয়ে বলে উঠলেন: থামো, থামো, আর নয়।
বাদশাহ বললেন; থামাও থামাও, আর মেরো না। এবার বুঝি বামুনের সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে! ব্রাহ্মণ বললেন: শাহানশাহ এবার আমার ঋণ পরিশোধের পালা। আমার এক বন্ধু আছে, তার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি, আমার বখশিশের অর্ধেক আমি তাকে দেব। আমার সেই বন্ধুটিকে এবার এখানে আনতে অনুমতি দিন। সে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
ব্রাহ্মণের কথা শুনে আবার সবাই অবাক হয়ে রইল। বাদশাহ ভাবলেন, একটা রহস্য আছে এর ভিতর। তাই অনুমতি দিতে বিলম্ব হলো না। ব্রাহ্মণ তখন বাইরে গিয়ে ডেকে নিয়ে এলেন দেউড়িতে পাহারারত বিশালদেহী এক দারোয়ানকে। এনে বললেন; এই আমার সেই বন্ধু, শাহানশাহ। আমার বখশিশের অর্ধেক প্রাপ্য এ-বধুটির।
দারোয়ানকে দেখে বাদশাহ আকবর তাজ্জব হয়ে গেলেন। ব্যাপার কী! তাঁর দারোয়ান কী করে এ বিদেশি ব্রাহ্মণের বন্ধু হতে পারে? ব্রাহ্মণ তখন সব কথা বুঝিয়ে বলতে লাগলেন: দিল্লি থেকে অনেক দূরে কালী নামক এক গ্রামে আমার বাস। অত্যন্ত গরিব আমি। বরাবর শাহানশাহর গুণগ্রাহিতার কথা শুনে আসছি। কিন্তু শাহি দরবারে হাজির হবার ভাগ্য বা সুবিধা কখনও হয় নি। একবার তাই ভারি ইচ্ছে হলো দিল্লি আসতে। তারপর সত্যি একদিন পায়ে হেঁটে দিল্লি এসে হাজির হলাম। অনেক দূর হেঁটে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়েছি, কিন্তু মনে তবু অপার আনন্দ, এতদিনে মনের বাসনা পূর্ণ হলো৷ দিল্লি এলাম। একপা-দুপা করে শাহি-মহলের দিকে ভয়ে-ভয়ে এগোচ্ছি। দেউড়ির কাছে আসতেই পথ আগলে দাঁড়াল হুজুরের বিশালবপু এই দারোয়ান।
ধমক দিয়ে বলল: কোথায় যাচ্ছ? আমি চমকে গেলাম। মিনতি করে বললাম: অনেক দূরদেশ থেকে পায়ে হেঁটে এসেছি বাবা, শাহানশাহ আকবরকে একটিবার চোখে দেখতে। আমার এ-কথায় দারয়ানের মন ভিজল না। সে অনেক টাকা বখশিশ চেয়ে বসল। বখশিশ না পেয়ে কাউকেই নাকি সে দরবারে ঢুকতে দেয় না। এদিকে আমার সঙ্গে নেই একটিও কানাকড়ি। কী বখশিশ দেব দারোয়ানকে? অবশেষে ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ এক বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। বললাম: ট্যাঁকে যে কিছু নেই তো দেখতেই পাচ্ছ। তবে হ্যাঁ, আশা আছে বাদশাহর দরবারে ঢুকে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারলে কিছু এনাম নিশ্চয়ই পাব। যা-কিছু আমি পাই তার অর্ধেক তোমাকে দেব বলে ওয়াদা করছি। আমার এ-সঙ্গত প্রস্তাবে হুজুরের দয়ালু দারোয়ান রাজি হলো। রাজি হয়ে আমাকে দরবারে ঢুকতে দিল। সে-অবধি দরবারে যাতায়াত করছি। এতদিন হুজুরের নেকনজর আমার উপর পড়ে নি বলে ঋণ শোধেরও কোনও উপায় হয় নি। এ দারোয়ানের দিন কেটেছে আশায় আশায়। হুজুরের দয়ায় আজ আমার সে ঋণ পরিশোধের সুযোগ এসেছে।
এটুকু বলে ব্রাহ্মণ হতভম্ব দারোয়ানের দিকে চেয়ে বললেন: বাদশাহ খুশি হয়ে আজ আমাকে একশ চাবুকের ঘা বখশিশ দিতে রাজি হয়েছেন। তার অর্ধেক আমি নিয়েছি। এবার বাকি অর্ধেক তোমাকে দেওয়ার পালা।
ব্রাহ্মণের কথা শুনে উপস্থিত আরও অনেকে দারোয়ানের নামে নালিশ করল। তারাও দারোয়ানের বখশিশ দিয়েই দরবারে ঢুকেছে। এসব শুনে আকবর গেলেন ভীষণ চটে। তিনি হুকুম দিলেন: ওকে আচ্ছা করে পঞ্চাশ ঘা চাবুক মেরে রাজ্যের বাইরে তাড়িয়ে দাও।
চাবুকের পিটুনি দেওয়ার কথা শুনে যে লোকটা ব্রাহ্মণকে ঠাট্টা করছিল, এবার তার দিকে ফিরে ব্রাহ্মণ বললেন: চাবুকের ঘা খেয়ে মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি বাড়ে কিনা, দারোয়ানকে দেখে শিখে নিন।
সেদিনই দারোয়ানকে চাবুক মেরে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। এ ব্রাহ্মণ লোকটিকে তোমরা বোধহয় বুঝতে পেরেছ। ইনিই বিখ্যাত হাস্যরসিক বীরবল। দরবারের অনেকেই তাঁকে ভালোবাসত। বাদশাহ সেদিন থেকে তাঁকে নবরত্নের একজন করে নিলেন। তাঁকে অনেক টাকা বখশিশ দিলেন।