মোদির লগে আমিরাতের রিশতা মুসলিম উম্মতরে কী বার্তা দেয়

তুহিন খান

প্রকাশিত : আগস্ট ২৫, ২০১৯

মোদিরে আমিরাত সরকার মেডেল দিছে, `ভাই` বইলা গ্রহণ করছে। হুররিয়াতসহ উপমহাদেশের মুসলিম জনতা তাতে যথেষ্ট নাখোশ, নাখোশ হওনের কারণও আছে। কিন্তু বোঝার বিষয় এই যে, ইজরাইলের পরম বন্ধু নরেন্দ্র মোদি আমিরাতের বন্ধুই হবেন, এতে আশ্চর্য হওনের কিছু নাই। গালফ স্টেটগুলার সাথে ইজরাইলের, এবং সেই উসিলায় আমাদের নরেন্দ্র মোদির দোস্তি এখন ওপেন সিক্রেট।

কাশ্মীর, ফিলিস্তিন বা রোহিঙ্গা—কোনো ইস্যুতেই গালফ স্টেটগুলার আপাতত কোনো ইতিবাচক ভূমিকা নাই। বিপরীতে, সৌদি আরব-কুয়েত-আমিরাত-মিশর জোট ফিলিস্তিনরে বিক্রি করতে চাইতেছে কুশনারের কাছে, এশিয়ায় পাকিস্তান একাত্তরে `মুসলিম কান্ট্রি` হিশাবে মধ্যপ্রাচ্যের যে সাপোর্ট পাইছিল, তাও আর নাই তেমন। ফলে, কাশ্মীর আর রোহিঙ্গা ইস্যুতেও মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশগুলা নীরব, অনেকটা প্রো-ইণ্ডিয়া ভূমিকা পালন করতেছে।

পাকিস্তান-তুরস্ক-মালয়েশিয়ার যে জোট, তা এমনি এমনি হয় নাই। মুসলিম বিশ্বের প্রধান নেতৃত্বের কেন্দ্র আরবভূমির শাসকদের ক্ষমতা পোক্ত করার জন্য এখন ইজরাইল বা ভারতরেই বেশি দরকার, পাকিস্তান বা ফিলিস্তিনরে না। ফলে, এই শাসকগোষ্ঠী খোলাখুলিভাবেই তা করতেছেন। তাইলে, আরবের বাইরে যে বিশাল মোসলমান জনগোষ্ঠী, তারা কী করবেন? তাদের নিজেরা নিজেরা জোট করা ছাড়া উপায় নাই।

অন্যদিকে, ইরান-কাতারের ক্রমঃবর্ধনশীল ভ্রাতৃত্বের গোড়াও কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের এই ক্রাইসিসের মধ্যেই লুকানো। শিয়া-সুন্নি কর্তৃত্বেত লড়াইয়ে সৌদিরে বিশ্বের সুন্নি মোসলমানরা যে নিঃশর্ত আনুগত্য দিয়া রাখছেন, তা আর কতদিন লাস্টিং করবে? বলা মুশকিল। কারণ, মিডল ইস্টের বাইরে মোসলমানদের যে বড় বড় স্টেট, ধরা যাক তুরস্ক বা পাকিস্তান, রাজনীতির প্রশ্নে ভবিষ্যতে হয়ত ইরানই হবে তাদের প্রধান মিত্র। ব্রাদারহুডরে আশ্রয় দিয়া কাতার যে বিপদে পড়ছে, সেই বিপদ থিকা উত্তরণের জন্য ইরানের সাথে হাত মিলানো ছাড়া তাদের উপায় ছিল না। তাইলে, ব্রাদারহুডও তো একরকম ইরানের সহায়তাই পাইলো, নাকি? তাইলে, বিশ্বব্যাপী মোসলমানদের যে লড়াই বা সংগ্রাম, রাষ্ট্র তৈরির প্রচেষ্টা বা নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ— সেসবে আগামী দিনগুলিতে তারা গালফ স্টেটগুলারে পাশে পাবেন না মেবি, পাশে পাবেন (অন্তত মৌখিকভাবে) তুরস্ক বা ইরানরে। তার মধ্যে ইরান আবার শিয়া রাষ্ট্র, ফলে সুন্নি মোসলমানরা হয়ত শত বিপত্তি সত্ত্বেও সৌদি বা মিশরের দিকেই তাকায়ে থাকবেন।

এই পরিস্থিতি জটিল বটে। বিশ্বনন্দিত ইসলামি স্কলার আবুল হাসান আলি নদভির থিসিস ছিল, ইসলামের প্রকৃত ও টেকসই বিপ্লবটি আরবভূমিতেই হইছিল, এবং আবার যদি কখনও হয়, তো আরব ভূমি থিকাই হবে এবং হওয়া উচিত। নদওয়াতুল ওলামার প্রতিষ্ঠাকালীন এজেণ্ডা ছিল আরব বিশ্বের লগে অ্যাকাডেমিক ও আধ্যাত্মিক যোগাযোগ কায়েম করা। তবে, নদভির সুসম্পর্ক ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথেই বেশি, হয়ত তাদের মধ্যেই নদভি ইসলামি বিপ্লবের ক্ষমতা দেখছিলেন। কিন্তু, নদভির বৃহত্তর আরবভূমি কোন একক বস্তু না। মুসলিম ব্রাদারহুড এখন গালফের মাতব্বরদের চোখে জঙ্গি সংগঠন, ইভেন, আমেরিকারে তারা চাপ দেয় ব্রাদারহুডরে জঙ্গি ঘোষণা করার জন্য। ফলে, এই ডিসটর্টেড আরবভূমিতে, নদভি কারে সাপোর্ট দিতেন, তা খুব ইন্টারেস্টিং আলাপের বিষয় হইতে পারে।

দক্ষিণ এশিয়ার মোসলমানেরা উনিশ শতকের মাঝামাঝি থিকা সম্ভবত, দীর্ঘ এক সময়ের পর, রাজনৈতিক ও ধর্মীয়ভাবে আরবমুখী হইতে থাকেন। সেই ধারাবাহিকতা অদ্যাবধি চলমান। কিন্তু ইতিহাসের এই সময়টাতে দাঁড়াইয়া পশ্চিমে তাকাইলে, এশিয়া বা আফ্রিকার সংগ্রামী মোসলমানদের মিডল ইস্ট প্রীতি, ভীতি বা অনুকৃতিতে, কিছুটা নিরুদ্যম হওনের কথা। গালফ স্টেটের ক্ষমতাসীনরা এই মোসলমানদের জন্যে, জাতিরাষ্ট্রের পিয়াসী কাম মুসলিম উম্মতের নয়া জাগরণ ও রিফর্মেশনে বিশ্বাসী মোসলমানদের জন্য খুব ইতিবাচক কিছুই আর অফার করতে পারতেছেন না, পারবেনও না। কারণ, গোটা উনিশ-বিশ-একুশ শতকজুইড়া বিশ্বের মোসলমানদের মধ্যে (যারা ম্যাক্সিমামই ইওরোপের প্রজা ছিলেন) রাজনৈতিক, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে যেসব সংগ্রাম, জাগরণ বা রিফর্মেশন হইছে, একসময় সৌদিসহ অন্যান্য গালফ স্টেটগুলা তার উত্থানে মদদ দিলেও, এখন তারা সেইসব নয়া চিন্তার সমুখে নিজেদের গদিগুলারে খুব একটা নিরাপদ আর দেখতেছেন না। গোড়া থিকাই বৃটিশের সহায়তায় রাষ্ট্র খাড়া করা আর আমেরিকার খাতিরে ক্ষমতা পোক্ত করা সৌদ-রা ৯/১১-এর পরে তাই নীতি পাল্টাইতে বাধ্য হইছেন। কিন্তু সেই নীতি, বিশ্বজুইড়া তৈরি হওয়া নয়া মোসলমানদের (রাজনৈতিক অর্থে নয়া মোসলমান আরকি) রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আকাঙ্ক্ষার সাথে মেলে নাই। এই না মেলার ফলাফল হয়ত এতদিনে আরো চাক্ষুশ হইতো, কিন্তু একদিকে সৌদির আদি ঐতিহ্য আর অন্যদিকে `শিয়া` ইরানের `উত্থান-আশঙ্কা` সম্ভবত এই মোসলমানদের ধৈর্যে ফুয়েল দিতেছে। বিশ্ব রাজনীতিতে এ এক মজার ঘটনা বটে।

তবে, গালফ স্টেটগুলার সাহায্য পাওনের দিনও ফুরালো বোধহয়। কাশ্মীর, রোহিঙ্গা, ফিলিস্তিন—কেউই তো তা পাইতেছেন না। পাইতেছে কারা? কুশনার, নেতানিয়াহু, মোদি। আরবদের সাথে আমাগো পিএমেরও অল্পবিস্তর খাতির আছে, তাদের অর্থায়নে দেশে `মডেল মসজিদ` হইতেছে, সেইখানে নয়া স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা নিয়োগ পাওনের দৌড়ে আগাইয়া আছেন। তাইলে মিললো তো সবই! কিন্তু, যাদের মিলল না, তাদের হইল সমস্যা। ধরেন, বিএনপিন্থী কওমিগণ বা জামাতে ইসলামি। তাদের লগে মধ্যপ্রাচ্যের রিলেশন এই মুহূর্তে কেমন? ঠিক আন্দাজ করতে পারি না। জানতে মনে চায়।

দক্ষিণ এশিয়ার মোসলমানদের নিজেদের মধ্যে, এবং নিজেদের বাইরে ইওরোপ আর আফ্রিকার লগে ঘন সম্পর্ক বানাইতে হবে। আবার, এর বাইরে, নয়াশক্তি চীন বা রাশিয়ার লগেও তাগো আলাপ চালু করা লাগবে। সেইটা ভাল না লাগলে, তৃতীয় ও নিরাপদ পন্থা হইল, আমেরিকার লগে, ইজরাইলের লগে, ইন্ডিয়ার লগে সম্পর্ক বাড়াইতে হবে। তাগো লগে তালমিল দিয়া হাসিখুশি থাকা লাগবে। আরব শাসকগো মত, পুরানা আমেরিকাবিরোধী মনোভাব, বা ইজরাইলরে অস্পৃশ্য ভাবা বাদ দেওন লাগবে। অর্থাৎ, যা চলতেছে, তাতে শামিল হইতে হবে। তাতে গুনাহ হবে না এজতেহাদের সওয়াব হবে, তা মহাকাল বা পরকালে জানা যাবে। ইসলামিস্টদের গণতান্ত্রিক অ্যাপ্রোচ ফেইল করছে, মিলিট্যান্ট অ্যাপ্রোচেরও কোন দিগদিশা নাই, ইরানের বিপ্লবও চল্লিশ বছর পুরানা হইছে। এইক্ষণে আবার, দিকে দিকে উগ্র ডানপন্থার উত্থান ঘটতেছে। তাতে মোসলমানরা যদি খুশি হন (যেমন মোদির বিজয়ে বিএনপি-জামাত ইকটু হইলেও আত্মপ্রসাদ পাইতেছিলেন) তা হইতে পারেন। কিন্তু দেখার বিষয় হইল, বিশ্বজুইড়া এতগুলা ডানপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসলেও, মোসলমানদের আশা-ভরসার কেন্দ্র আরবভূমিতে তার উলটা ইফেক্টই পড়ছে। অর্থাৎ, বিশ্বব্যাপী উগ্র জাতীয়তাবাদী ডানপন্থীদের উত্থানে মোসলমানদের খুশি হওনের কিছুই নাই। অবশ্য, ফিউচারিস্টদের ব্যাপার আলাদা। তারা হয়ত এর মধ্যে ভবিষ্যৎ যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখতেছেন। তা, ভবিষ্যৎ কে বলিতে পারে! কিন্তু ভবিষ্যৎ-যুদ্ধ যদি হয়ই, তা কেমন হবে, সেইটা কল্পনা করা যাইতে পারে৷

মোসলমানদের রাষ্ট্রগঠনের উনিশ-বিশ-একুশ শতকী নানাবিধ প্রকল্প ফেইল করছে। সৌদি সরকার তার নিজের স্বার্থে প্রচারিত `ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তা` প্রমোট করতেছেন। কিন্তু সেই রাষ্ট্রচিন্তা দিয়া সকলের চলে না, যেমন কাশ্মীরি বা ফিলিস্তিনিদের, আফগানদের, চলবে না। ফলে, রাষ্ট্রের লগে বোঝাপড়ার নয়া তরিকাও তাদের খুঁইজা বাইর করতে হবে। নয়া রাজনৈতিক প্রকল্প ও শত্রু-মিত্রতার পুনর্বিন্যাস ছাড়া আপাতত মুসলিম উম্মত ধারণাটিরে আর কোন অর্থ দেওয়া যায় না।

লেখক: কবি ও অনুবাদক, শিক্ষার্থী: সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়