মোজাম্মেল হকের উপন্যাসিকা ‘প্রস্থান’

পর্ব ৫

প্রকাশিত : মার্চ ২০, ২০২১

আয়নালকে শোবার ঘরে ডাকে হামিদা। আয়নাল ঘরে এলে হামিদা লুডু বের করে খাটে বসে। আয়নাল উৎসাহ নিয়ে খেলতে বসে। বেশ কিছুক্ষণ খেলেও আয়নাল এর ছক্কা মেলেনি। একটা ঘুটিও বের করতে না পেরে মন খারাপ করছিল। হামিদা এগিয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে আয়নাল ও পিছু নেয় হামিদার। একটার পর একটা ঘুটি খেয়ে নেয়। হামিদা মন ভারি করে বলে একি তুমি যে একের পর এক আমার ওপর ওঠে আসছো। আয়নাল মজা করে বলে, ওপরে ওঠেও তো কাছে থাকতে পারছি না, তুমি ঘরে ঢুকে যাচ্ছ।

হামিদাও কম যায় না। বলে, আচ্ছা খুব কাছে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি, বলেই আয়নালকে হাতে চাপ দেয়। কিছুটা ঝুঁকে ঘনিষ্ট হয়ে চোখের দিকে স্থির তাকিয়ে থাকে। আয়নালও সামান্য নুয়ে হামিদার নাকে নাক ঘষায়। হামিদার ঠোট আয়নালের ঠোঁট ছুয়ে যায়। লুডুর পাতা গুটিয়ে রেখে পরস্পরের ঘনিষ্ট হয়। আয়নালের ঘন নিঃশ্বাস টের পায় হামিদা। ওকে কাছে টানে। আরও ঘনিষ্ট হয়। শাড়ির  আঁচল সরিয়ে নেয়। ক্রমশ সহজ হয়ে ওঠে আয়নাল। ব্লাউজের ওপর দিয়ে হামিদার স্তনযুগলে হাত বুলায়। হামিদা আনন্দে গভীর চুমু খায়।

আয়নালের হাত সাপের মতো হামিদার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ঘুরে বেড়ায়। ব্লাউজের বোতাম খুলে দেয় হামিদা। মিউজিয়ামে দেখা নারী মূর্তির উন্নত স্তনের দেখা পায় আয়নাল। হামিদা যেন মিউজিয়ামে দেখা কাঙ্ক্ষিত নারী। দুজনে দুজনকে পান করতে থাকে। আয়নালের গলা জড়িয়ে ধরে হামিদা বলতে থাকে এতদিন কেন কাছে আসোনি। বছরের পর বছর নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি, কেন কাছে এলেনা আয়নাল। আয়নাল হামিদাকে আদর করতে থাকে। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার  আওয়াজআসে। ওফ! এই সময় আবার কে এলো, বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে হামিদা।

আয়নালকে বাথরুমে ঢুকতে বলে দরজার দিকে এগোয়। বাথরুম থেকে শিলার গলা শুনতে পায় আয়নাল। শরীরটা ভাল লাগছিল না, তাই বাসায় চলে এলাম বলেই শিলা মায়ের দিকে তাকায়। মাকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই বলতে থাকে মা তোমাকে কেমন যেন লাগছে। নিজেকে সামলে নিয়ে হামিদা বলে শুয়েছিলাম, কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম টের পাইনি। তা তোমার কি হয়েছে, জ্বর আসেনি তো বলেই শিলার কপালে হাত দেয় হামিদা। না, শরীর ব্যথা, তলপেটে ব্যথা করছে। পিরিয়ডের সময় শিলার দুয়েকদিন একটু যন্ত্রণা হয় এটা হামিদার অজানা নয়। শিলাকে ভালভাবে স্নান করে বিশ্রাম নিতে বলে হামিদা ঘরের দরজা লাগায়।

শিলা আর কলেজে যেতে চায়নি। দু’দিন পরেই যেহেতু রাজশাহী ছাড়ছে কলেজে গিয়ে আর কি হবে। এর মাঝে সবার কাছে তো বিদায় নেয়াও হয়ে গেছে। বাসার সব কিছু গোছগাছ করতেই হামিদার সময় কাটছে। তার মন পড়ে আছে আয়নালের কাছে। শিলার প্রতি মনে মনে খুব রাগ হয় হামিদার। শিলা এখন সুস্থ। শরীরে একটা ফুরফুরে ভাব। চাচার কাছে যাবার জন্য মন ছটফট করছে। কিন্তু চাচা তো তাকে কাছে টানছেনা। দুপুরে ভাবীকে এতোটা কাছে পেয়েও পাওয়া হয়নি তার। শিলাও আর বাসার বাইরে যাবে না।

ভাবীকে একান্তে পাবার আশা তাই ছেড়ে দিয়েছে আয়নাল। জীবনে প্রথম নারীসঙ্গ লাভের এমন মুহূর্তে বঞ্চিত হয়ে শরীরের ভেতরে জ্বলে উঠা আগুনে পুড়ছে আয়নাল। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে শিলা আয়নালের ঘরে আসে। ঘাড়ে হাত রেখে ঝাঁকুনি দেয়। চমকে ওঠে আয়নাল। মনে মনে ভাবীকে কল্পনা করলেও ঘুরে তাকাতেই শিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। ফিসফিস করে ছাদে চলো বলেই হাত ধরে তাকে টেনে তোলে শিলা। কোন কথা না বাড়িয়ে শাল গায়ে জড়িয়ে শিলাকে অনুসরণ করে ছাদে ওঠে আসে আয়নাল। ঘন কুয়াশায় ভিজে দুজন। তোমার ঠান্ডা লাগবে বলতেই আয়নালকে জড়িয়ে ধরে শালের ভেতর ঢুকে পড়ে শরীরের সাথে মিশে যায় শিলা।

আয়নাল আর স্থির থাকতে পারেনা। সবকিছু ভুলে শিলাকে জড়িয়ে ধরে। শিলা আয়নালের গলায় চুমু খায়। বাধা দেয়না আয়নাল। ওর নিথর শরীর পরগাছার মতো পেচিয়ে ধরে আয়নালকে। শিলাকে কোলে তুলে নেয় আয়নাল। ধীরে নেমে আসে ছাদ থেকে। আয়নালের গলা জড়িয়ে ধরে উষ্ণতার ধারা ঢেলে দেয়। দরজা লাগিয়ে দিয়ে সোজা বিছানায়। আনন্দে নেচে ওঠে শিলার মন। সাগরের ঢেউয়ের গর্জন টের পায় সে। চুমোয় চুমোয় আয়নালকে বলে ভেসে চলো, নির্ভয়ে ভেসে চলো কোন ঝুঁকি নেই। অতলে নামো। ত্বকের গভীরে ত্বক। লোনাজ্বলে ভাসা মানব-মানবীর ভালবাসায় জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পায় ওরা।

পরদিন অনেক বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে শিলা। স্নানঘরে গিয়ে হাত-মুখে পানি দেয়। আয়নায় নিজেকে ভালভাবে দেখে। গলায় ছোপ ছোপ লাল হয়ে আছে। সারা শরীরে যেন ভালবাসার পরশ লেগে আছে। একবার ভাবছে স্নান করে নিবে। কিন্ত্ সহজে তা ধুয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। এক অদ্ভূত ভাল লাগার অনুভূতি ও ঘোর নিয়ে বেরিয়ে আসে। নাশতা করে নিজের ঘরে গিয়ে বই নিয়ে শুয়ে পড়ে। পড়ায় মন নেই। বই দিয়ে শুধু নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। গত রাতের সবকিছুই তার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। অসম্ভব ঘোর লাগা এক সময়, বয়ে যাওয়া ঝড় সবকিছুই যেন স্যলুলয়েডের মত চোখের সামনে ভাসছে। শিলা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। ঘোর লাগা সুখ, ঝড়ে দুলে উঠার আনন্দ তাকে ভেতরে ভেতরে উচ্ছসিত করছে আবার নিজের চাচার সাথে এমন কিছু ভাবতেই বিষাদ্গ্রস্ত হচ্ছে।

শুধুই এক অ্যাডভেঞ্চার আকাঙ্ক্ষায় এমন ভেসে যাওয়ায় নিজেকে  এখন খুব ছোট মনে হচ্ছে তার। চাচার মুখোমুখি হতে লজ্জা লাগছে। আর তো কিছুটা সময়। কাল ভোরেই তো রওনা হবে যশোর। আয়নাল বিছানা ছেড়ে উঠেছে অনেক আগেই। গত রাতের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছেনা। শিলা ছোট মানুষ, ওর আবেগের কাছে এভাবে পরাস্ত হয়ে মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছে। এই মনোবেদনা যেন বইতে পারছে না। শিলার সাথে চোখাচোখি হতেও তার ভয় লাগছে। এসব ভাবনা থেকে বাসা ছেড়ে বাইরে ঘুরতে যায় আয়নাল।

পরদিন ভোরে রওনা হতে হবে বলে রাতের খাবার আগে আগে শেষ করে সবাই ঘুমাতে যায়। হামিদা যাত্রা পথের খাবার তৈরি করে সবকিছু গুছিয়ে ঘুমাতে যাবার আগে আয়নালের ঘরে আসে। অনেক কিছু ভেবে শোবার ঘরে চলে যায়। এতক্ষণ কি করছিলে ওসমানের এমন প্রশ্নেই হামিদা বুঝতে পারে ওসমান এখনো ঘুমায়নি। কি আর করবো, তোমাদের কালকের খাবার তৈরি করলাম। এতোটা পথ, খেতে হবে না। ওসমান হেসে বলে বাইরের খাবার একদিন খেলে কি আর হতো। হামিদা এসে পাশে শোয়। ওসমানকে জড়িয়ে ধরে। ওসমান নির্বাক। কিছুক্ষণ এভাবে থেকেও ওসমানের কোন সাড়া নেই। হামিদার প্রচন্ড ইচ্ছের কিছুই না বুঝে ওসমান বলে অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও বলেই পাশ ফিরে শোয়। হামিদা খুব অপদস্ত বোধ করে। তার ইচ্ছে করছে এখুনি আয়নালের কাছে ছুটে যেতে। চোখ ভিজে আসে তার।

পরদিন সকালে যাত্রা করার আগেই ওসমান ট্রাকে মালামাল তুলে দেয়। সবাই ট্রেনে করে খুলনা আসে। খুলনা থেকে ওসমান চলে যায় যশোরে আর সবাইকে নিয়ে তালায় ফিরে আয়নাল। বাড়ি ফিরেই জানতে পারে মায়ের শরীরটা ভাল নেই। রাতে অবস্থার উন্নতি না হলে সকালে খুলনায় হাসপাতালে নিয়ে যায়। অবস্থার অবনতি ঘটে । খুলনায় নিয়ে যায়। ডাক্তার দেখেই মৃত ঘোষণা করে। মায়ের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। ওসমান মালপত্র কোন রকম বুঝে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। বাড়িতে সাময়িক আনুষ্টানিকতা সেরেই সবাইকে নিয়ে যশোরে ফিরে যায়। মায়ের মৃত্যু, বাবার বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ওসমান আরও ভেঙে পড়ে। চলবে