মোজাম্মেল হকের উপন্যাসিকা ‘প্রস্থান’

পর্ব ২

প্রকাশিত : মার্চ ১৬, ২০২১

হামিদা এর মাঝেই সব গুছিয়ে নিয়েছে। এখন সারাদিন তার অবসর। সামান্য রান্নাবান্না আর ছোট বাসা পরিচ্ছন্ন করে রাখতে তার খুব একটা সময় লাগে না। টেপ খুললেই পানি পাচ্ছে। চুলার ধোঁয়ায়  আর চোখ জ্বলে না। নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার সময় অনেক। ছেলেমেয়েদের সময় দিয়েও তার নিজের জন্য এখন অনেক সময়। হামিদা ভাবতে থাকে, শুয়েবসে সময় কাটাবার চেয়ে কোনো কিছু করা যায় কিনা। সেলাইয়ের কাজে ছোটবেলা থেকেই তার আগ্রহ ছিল। ঘরের জন্য তাই নকশিকাঁথা সেলাইয়ের কাজে লেগে যায়। শিলা আর সজীব স্কুলে চলে গেলে হামিদা সেলাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বিউটি মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যায়। অনেক মহিলাই দূর-দূরান্ত থেকে ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্কুলে আসে, ছুটি হবার আগপর্যন্ত স্কুলেই থাকে। তাদের অনেকের সাথেই বিউটির বেশ ভাব হয়েছে। এজন্য মাঝে মাঝে বিউটিও স্কুলেই থেকে যায়। ছুটি হলে মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফেরে। হামিদার মনে হয়, বিউটি বাসায় থাকলে দুজনে মিলে গল্প করে সময় কাটাতে পারতো।

বিউটি বয়সে হামিদার চেয়ে খুব ছোট নয়। বয়সে হামিদা বছর পাঁচেকের বড় হলেও তাকে বিউটির চেয়ে বেশি বয়সী মনে হয়। বিউটি বেশ চটপটে। নিজের প্রতি বেশ যত্নবান। নিজেকে গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করে। বিউটিকে দেখে ওর বিয়ে হয়েছে বলেই কেউ ভাবে না, আর সাত বছরের এক কন্যাসন্তান আছে শুনলে তো বিশ্বাসই করতে চায় না কেউ। ভৈরব শহরে বড় হয়েছে। কলেজে পড়েছে। মাঝে মাঝে পার্লারে গিয়ে সাজগোজ করেছে বলে ওর মাঝে একটা অন্যরকম ভাব আছে। বিউটির এই চটপটে ভাব, তার সৌন্দর্য আর জামাকাপড়ের জৌলুস অনেকেই ঈর্ষা করে। হামিদাও বুঝতে পেরেছে এই কলোনির মাঝে যত পরিবার আছে, এর মাঝে বিউটিকে সহজেই আলাদা করা যায়। একজন সৈনিকের স্ত্রীর এমন শান-শওকন অনেকেই মানতে পারে না। এসব নিয়ে আড়ালে কথা হলেও কিন্তু সামনে সবাই বিউটিকে বেশ সমীহ করেই চলে। বিউটিও সবার সাথে মেশে না, নিজেকে কিছুটা আলাদা করেই রাখে। কিন্তু হামিদার সাথে তার আন্তরিকতায় তাকে কখনোই অহঙ্কারী মনে হয়নি। প্রতিবেশী হিসেবে বিউটিকে হামিদার বেশ ভালো লাগে এবং এভাবেই দুজনের ভাব জমে ওঠে।

শিলা ও সজীব দুজনেই পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী হয়ে উঠছে। শিলা ক্লাসে সহপাঠী এবং শিক্ষকদের বেশ নজড় কাড়ছে। পরীক্ষায় ভালো করছে। ক্লাসের বেশ কয়েকজনের সাথে তার বন্ধুতা হচ্ছে। অনেকের মাঝে শিউলিই সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে ওঠে। এভাবে শিলা ও শিউলি পরস্পরের বাসায় যাতায়াত করে এবং তারা পারিবারিক বন্ধু হয়ে যায়। শিউলির বড় ভাই শিপনের কাছে মাঝে মাঝে গণিতের কিছু বিষয়ে সহায়তা নেয় শিলা। দেখতে দেখতেই শিলা এসএসসি পাশ করে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়। এর মাঝে প্রতিবেশী বিউটির স্বামীর বদলি আদেশ হয়। কিছুদিনের মাঝেই বিউটিরা বাসা ছাড়ে। ওসমানেরও বদলির আদেশ হয়। নতুন প্রতিবেশী আসার আগেই তাদের যশোরে চলে যেতে হবে। শিলা আর সজীবের স্কুল বদলি নিয়ে ভাবে ওসমান। কলেজে শিলার বেশ ভালো লাগছে। এখানে ওখানে বেড়াতে যেতে পারছে। বান্ধবীদের প্রেমের গল্প আরও কতকিছু শুনে এক চাপা উত্তেজনা অনুভব করে শিলা। বান্ধবীদের মতো প্রেমপত্র পেতে, ছেলেবন্ধুর সান্নিধ্য পেতে ইচ্ছে করে। সামিয়া দেখতে বেশ সুন্দরী। ওর পেছনে কতজন ঘুরছে। কিন্ত ওর প্রতি কারো আগ্রহ না দেখে ভেতরে ভেতরে কেমন যেন শূন্যতা লাগে শিলার। নিজের চেহারা নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে। শিলার এই পরিবর্তিনটা চোখে পড়ে সামিয়ার।

সামিয়া শিলাকে বেশ পছন্দ করে। সারাক্ষণ ওর সাথে থাকতে চায়। শিলার সাথে সামিয়ার অন্তরঙ্গতা দেখে পিন্টু, রিয়াজ আর রুমেল শিলাকে নানাভাবে সামিয়ার প্রতি তাদের ভালো লাগার কথা জানায়। শিলা নিশ্চুপ শোনে। কিন্তু কিছুই বলে না। পিন্টুকে ওর পছন্দ না হলেও রুমেল আর রিয়াজকে খারাপ লাগে না শিলার। রিয়াজ ভালো ফুটবলার আর রুমেল সাংস্কৃতিক কাজে যুক্ত, ভালো লেখে। রুমেলের গল্প, কবিতা শিলা পড়েছে কিন্তু পিন্টুর সম্পর্কে ওর বিশেষ ধারণা নেই। শিলা দ্বিধান্বিত। সামিয়া তা টের পায়। একদিন সামিয়া শিলাকে বলে, শোন, আমার এসব ছেলেপেলেদের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। শিলা কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন থেমে যায়। সামিয়া বিষয়টা বুঝতে পেরে বলে, তুই কি যেন বলতে চেয়ে থেমে গেলি। বল তো শুনি। তোকে দিয়ে আমাকে ভালবাসার কথা জানাতে চেয়েছে? কতটা বেকুব হলে মানুষ এমন করে আমি বুঝে পাই না। শিলা সামিয়াকে থামিয়ে বলে, আরে না ওরা হয়তো তোকে বলতে লজ্জা পাচ্ছে, সাহস পাচ্ছে না তাই আমাকে মনের কথা জানিয়েছে। এজন্যইতো বলছি বেকুব। বেকুব না হলে একটা মেয়েকে দিয়ে আরেকটা মেয়ের প্রতি ভালবাসা জানায়? ওদের কি একবারও মনে হয়নি যাকে দিয়ে এই প্রস্তাব পাঠাচ্ছে সেই মেয়েটা ভেতরে ভেতরে কতটা উপেক্ষিত ভাবতে পারে?

শিলা সামিয়ার মতো করে না ভাবলেও সামিয়ার এমন ভাবনায় ওর বেশ ভালো লাগে। সামিয়ার প্রতি ওর বিশেষ একটা ভালো লাগা তৈরি হয়। ওদের সবাইকে আমার হয়ে না বলে দিস, এরপরও যদি তোকে বিরক্ত করে তবে আমার সাথে সরাসরি কথা বলতে বলিস। আমি সই তোকেই ভালোবাসি, বলেই শিলাকে জড়িয়ে ধরে গাল টিপে দেয় সামিয়া। শিলার ভালো ফলাফলের আনন্দে ওসমান বেশ গর্ব বোধ করে। এখানে আসতে পেরেছিলাম বলেই তো আজ মেয়েটা ভালো করল, তালায় থাকলে কি এমন ফলাফল পেত? এই প্রশ্ন করেই হামিদা থেমে থাকেনি। এরপর তোমার যেখানে পোস্টিং হবে সেখানেই কিন্তু ওদের ভর্তির ব্যবস্থা করতে হবে। হামিদা যে আর তালা ফিরে যেতে চাচ্ছে না তা ওসমানের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। ছেলেটার ভবিষ্যতের জন্যও তো ওকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করা দরকার। চাকরির শেষ ক’টা বছর ওদেরকে নিজের কাছেই রাখতে চায় ওসমান। কিন্তু এরপর কি হবে? অবসররের পর তো তাকে তালাতেই ফিরে যেতে হবে। তখন কি অবস্থা হবে হামিদার। শহুরে সুবিধায় অভ্যস্ত হয়ে গ্রামে ফিরে গিয়ে তো আবারও কষ্টের মাঝেই পড়তে হবে।

শিউলিদের বাড়িতে বেড়াতে যায় শিলা। ভালো ফলাফলের জন্য শিউলিদের পরিবারে শিলার আলাদা কদর হয়। শিউলির জন্য জামাকাপড় আর একটা ঘড়ি উপহার হিসেবে দেয়। শিউলিদের ছেড়ে যেতে হবে ভেবে শিলার খুব মন খারাপ হয়। কিন্তু যেতে তো হবেই। বাবার বদলি হলো যশোর সেনানিবাসে, আগামী মাসেই আমরা রাজশাহী ছেড়ে যাচ্ছি খালাম্মা। যশোরে বদলির কথা জেনে শিউলির বাবা বললো, এবার তো তোমরা বাড়ির কাছেই যাচ্ছ। বেশ ভালো হবে। মাঝে মাঝেই বাড়ি যেতে পারবে। তোমাদের বাড়ির লোকেরাও বেড়াতে আসতে পারবে। এত দূরে বলেই তো তোমাদের আত্মীয়-স্বজন খুব একটা বেড়াতে আসেনি।

ঠিকই বলেছেন খালু। এবার আমরা বাড়ির কাছাকাছি যাচ্ছি। আপনাদের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। কিন্তু দূর বলে আমাদের এখানে বেড়াতে আসতে যদি আপনারা দ্বিধা করেন তবে বুঝবো আমাদের আপনারা আপন করে নিতে পারেননি। শিলাকে জড়িয়ে বুকের কাছে নিয়ে চুমু খেয়ে শিউলির মা বলে, কবে যে তুই আমার নিজের মেয়ে হয়ে গেছিসরে মা আমি নিজেও বলতে পারিনা। ভগবান তোর মঙ্গল করুক। চোখের জলে শিলাকে বিদায় দেয় শিউলি। চলবে