মেহেদী উল্লাহ

মেহেদী উল্লাহ

মেহেদী উল্লাহর কলাম ‘মিডিয়া, প্রতিবাদ ও জাতির গ্লানি’

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৫, ২০২০

কোনো পরিবারের অতি আদরের সন্তানটির হারিয়ে যাওয়া বা নিখোঁজের ঘটনাটি একটি পারিবারিক ঘটনা। কিন্তু সেই সন্তানের খোঁজে যখন জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় সেটি তখন সন্ধানে ইচ্ছুক প্রচারণামূলক জাতীয় ঘটনা। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে পরিবারের অবস্থা কী হয় সেদিকটায় যাওয়া যাক। সন্তানের মা যদি মনে করেন সন্তান অভিমানবশত হারিয়ে গেছে তাহলে সন্তানের বাবাকে দোষ দেন এবং হারিয়ে যাওয়ার জন্য অতিরিক্ত কড়া শাসনকে দায়ী করেন। এবং মা নিজে কান্না করেন, এটিও ভাবেন, নিজের কোনো অবজ্ঞা, অনাদর, শাসন বা অযত্নের জন্য সন্তান পালিয়েছে কিনা! ভালোবাসার মানুষের এমন হারিয়ে যাওয়ায় বা মৃত্যুতে (স্ত্রী স্বামীকে হারায়, মেয়ে মাকে হারায়) যে কান্না, শোক, বিলাপ এবং নিজেই দোষী কিনা এমন গ্লানি, সিগমুণ্ড ফ্রয়েড একে বলছেন `অ্যাবেশজ গ্লানি`। এটি এক প্রকারের মানসিক দ্বন্দ্ব। ফ্রয়েডের ভাষ্য অনুসারে, ভালোবাসার মানুষের প্রতি অবচেতনে একপ্রকারের ইর্ষাও থাকে, ফলে ব্যক্তির যে গ্লানি এটা সেই অবচেতন থেকেও আসতে পারে যে তার সুপ্ত চাওয়া অনুযায়ী প্রিয়জন মারা গেল বা নিখোঁজ হলো। এমনও দেখেছি, গ্রামে সন্তান বেশি দুষ্টামি করলে মা নিজেই অভিসম্পাত দেন। কাজেই এই গ্লানি অবচেতনের সেই খারাপ বাসনার সঙ্গেই ফাইট।
 
সন্তানের নিখোঁজ সংবাদের মতো প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় `জাতীয় চেতনা` নিখোঁজ হয়ে গেছে, এমন বোধোদয় মূলক সংবাদ ছাপা হয়। ধর্ষণ, হত্যা, দুর্নীতি লেগেই আছে মহামারির মতো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে চেতনা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে, এর জন্য কি কেউ অ্যাবেশজ গ্লানিতে ভুগছে সেই সন্তান হারা মায়ের মতো? অবশ্যই ভুগছে। কারা তারা? দেশের মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ার আমরা! একটা একটা ঘটনা ঘটে আর গ্লানিতে ভুগি, প্রতিবাদ করি। কিন্তু এত প্রতিবাদেও কেন কিছু হচ্ছে না? কেন বন্ধ হচ্ছে না ধর্ষণ? কেন হারিয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে `জাতীয় আত্মা`?

ফ্রয়েডের মত অনুযায়ী, তাহলে এই গ্লানির জন্য মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার আমরা অবচেতনে কি কি পুষছি?  এই ক্ষেত্রে গ্লানির কারণ কি? কেন আমরা এত চিৎকার করি, এত প্রতিক্রিয়া দেখাই? ফ্রয়েডের মতে আমরা কি নির্জ্ঞান মনে, এই ধর্ষণের পক্ষে একটা অবস্থান তৈরি করেছি, যা ধর্ষণের ঘটনায় আমাদের কাঁদায়, হাহাকার করায়?  উত্তর হ্যাঁ হলে আমি বিতর্কিত হয়ে যাই, আর উত্তর না হলে ফ্রয়েড। তাহলে কি মনোবিজ্ঞান মিছা?

প্রকৃতপক্ষে সামষ্টিক মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা হাইপার রিয়েলিটি ক্রিয়েট করেছে, যেটার সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই। বাস্তবে নিপীড়ক কেমন সেটা ভিডিওতে দেখা গেছে। কতটা নৃশংস! বর্বর! অমানবিক! কেউ ফেসবুকে হয়তো প্রতিবাদ করছে কিন্তু বাস্তবে তার রূপটি কেমন, আমরা জানি না। সে হয়তো গৃহে নিপীড়ক। সমাজে ইভটিজার। কাজেই আমাদের সামষ্টিক সত্তা গ্লানিতে ভোগে কিছু ঘটলেই।

আর মিডিয়া এসব ধর্ষণের সংবাদকে পণ্য বানায়। এমনভাবে প্রচার করে সেখানে `ধর্ষণ` নিরুৎসাহিত করার মতো খুব কমই কিছু থাকে। অথবা মিডিয়ার যে সামষ্টিক নখ-দন্তহীনতা, পরাধীনতা, সেটা থেকেই মিডিয়া অ্যাবেশজ গ্লানিতে ভুগছে। ধর্ষণ, দুর্নীতি নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠায় মায়া কান্না কাঁদছে। এটা মূলত মিডিয়ার গ্লানি, মিডিয়ার দায় আছে কি এই ধর্ষণে—মিডিয়া সেটা থেকেই এমন কাঁদে।

মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা প্রতিবাদ করি, কিন্তু অবস্থা পালটাচ্ছে না। ফ্রয়েড বলেছেন, অ্যাবেশজ গ্লানি এই প্রবল কান্নার মধ্য দিয়ে লাঘব হবে না। এর জন্য সময় দরকার। অনেক সময়। সেই ক্রান্তিকালীন সময়ই কি আমরা পার করছি? জাতির কাছে এজন্য নিখোঁজ সংবাদের গুরুত্ব অনেক। নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে কি জাতীয় আত্মা, চেতনা?

লেখক: কথাসাহিত্যিক