মৃদুল মাহবুবের কলাম ‘মাইগ্রেশন: সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’
প্রকাশিত : মে ৩১, ২০২০
সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট: যারা সারা দুনিয়া লক ডাউন অবস্থায় দেশ ছাড়ার ক্ষমতা রাখে, তারা কি ফিটেস্ট? মানুষের ভেতর ইনবিল্ড ক্যারেকটার ও ডিগনিটি আশা করার কোনও কারণ নাই। মানুষ আসলে দীর্ঘ বিবর্তনের ফলাফল। দুই ধরনের বিরর্তন তার হয়েছে। একটা শারীরিক আর একটা মানসিক। মানুষের যে মানব ধারণা আমরা পাই, তা অতিনতুন। ফলে, মানুষের আচরণ কেমন হবে তা দেখার জন্য তার অ্যানিম্যাল ইন্সটিংথের দিকে তাকাতে হবে। মোরালিটি অতি নতুন সংযুক্ত ব্যাপার মানব দেহে ও মনে। ফলে, দেহের দিক থেকে মানুষকে আগে দেখা লাগে।
আমরা মানুষের অনেক আচরণকে মোরাল জায়গা থেকে বিচার করি। ভালো বা মন্দ বলি। যেমন কাউকে গুলি করে চার্টার বিমানে পালিয়ে বা অবকাশে যাওয়াকে অনেকে খুব খারাপ হিসাবে দেখতেছে। হ্যাঁ, গ্রোকো-রোমান মোরালিটির জায়গা থেকে এগুলো খারাপ বটে। এটা সবাই জানে। তারপরও আমার অনেকেই এমন আচরণ করি। কিন্তু মানুষ কেন এমন আচরণ করে? এই আচরণের ফলাফল কী ভবিষ্যতে? এর উত্তরের জন্য মানুষের ডেভেলপমেন্টের দিকে তাকানো লাগে।
যেকোনো প্রাণীই সাধারণত সুবিধাযুক্ত স্থানে থাকতে চায়। এতে বংশ বিস্তার করা যায় ও শারীরিক স্বাচ্ছন্দে থাকা যায়, আয়ু বাড়ানো যায়, পরিশ্রম ও উৎকণ্ঠা কম থাকে। যেকোনো প্রাণীই আরাম প্রিয়। আমরা যেকোনো কিছুর ভুল ব্যাখ্যা পেলেও তার উপর ঝাপিয়ে পড়তে চাই। কেননা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার কষ্ট ব্রেন নিতে চায় না। দৌড়ালে রগে টান পড়ে। শরীর চায় না আপনি তাকে স্ট্রেস দিন। ফলে, রেগুলার জগিং করতে হয়। যেকোনো জীবের ডিএনএ কোডের মূল সূত্র সার্ভাইভাল, বাঁচো। ফলে মানুষ অধিক সুবিধাযুক্ত জায়গায় নিজেকে মাইগ্রেট করে। আমাদের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ে তারা অলরেডি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত। তারা প্রিভিলেজড। তারপরও তারা দেশের বাইরে চলে যায়। যাওয়াটা দোষের কিছু না। মানুষ স্বাধীন।
যে যে কারণে দেশের সুবিধাপ্রাপ্তরা দেশের বাইরে চলে যায়, একই কারণে আমরা তাদের দেশে রেখে দিতে চাই। ক্লাস ওয়ান শিক্ষিতরা দেশে থাকলে যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা কম, রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ও নাগরিক উৎকণ্ঠা আছে, সার্ভিস কোয়ালিটি খারাপ। ফলে তারা দেশ ছেড়ে চলে যায়। অপরপক্ষে কম প্রিভিলেজডরা ভাবে. এই ক্রিমগুলো দেশে থাকলে তারা তাদের মেধা, ধন, সম্পদ দিয়ে অনেক কিছু করতে পারতো সাধারণ মানুষের জন্য। ফলে, তারা কম সুবিধা দিয়ে হলেও এদের দেশে রাখার পক্ষপাতী। এবং দেশে লেখাপড়া করে দেশসেবা না করে বাইরে চলে যাওয়া যে খারাপ, তার একটা মোরাল প্রেসার তৈরি করে মাইগেটেড লোকদের উপর কম প্রিভিলেজডরা। দুই পক্ষই মূলত যারা যার স্বার্থ দেখে। দুই পক্ষের জন্য সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি না হলে কেউ থাকবে না।
পাখিরাও শীতকালে সাইবেরিয়া থেকে চলে আসে জাহাঙ্গীরনগরে। মানুষের ইতিহাস মাইগ্রেশনে ভরা। কম সুবিধাযুক্ত জায়গা থেকে অধিক সুবিধাপূর্ণ জায়গায় মানুষ প্রয়োজন অনুসারে চলে যেতে পেরেছে। ফলে সভ্যতা এখানে এসেছে।
হেমো স্যাপিয়েন্সের আদি গোত্র অস্ট্রালোপিথেকাস। এর অনেকগুলো গণ ছিলে। আনুমানিক ২৫ লক্ষ বছর আগে হোমো গণ আস্ট্রালাপিথেকাস থেকে আলাদা হয়ে যায়। হোমো গণে অনেক প্রজাতি ছিলে। এখন মানুষ, হোমো স্যাপিয়েন্স ছাড়া কেউ নাই। হোমো ইরেক্টাস যারা এশিয়ায় বাস করতো তারা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। হোমোর আরো ভাই ব্রাদাররা ছিলে আফ্রিকায়। যারা আফ্রিকা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল, তারাই বেঁচে গিয়েছে। যারা মাটি ও নাড়ির টানে থেকে গিয়েছে, তারা বিলুপ্ত।
মানুষ নামে যা দেখি তা নিজ ভূমি ছেড়ে চলে যাবার ফলাফল। ফলে, মাইগ্রেশন প্রজাতির বংশ রক্ষার প্রাথমিক শর্ত। ফলে, নৃতাত্ত্বিকভাবে মানুষ নিজেকে রক্ষা করতে অধিক সুবিধাযুক্ত স্থানে চলে যায়। এতে তার বাঁচা ও বংশ রক্ষার সম্ভাবনা বাড়ে। এটাই নিয়ম।
যারা সুযোগ পেয়ে বা বিশেষ কারণে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন বা যেতে চাচ্ছেন, তারা মূলত অ্যানিম্যাল ইন্সটিংথ দ্বারা তাড়িত। দোষের কিছু না। এটা মানুষ না, যেকোনো প্রাণীর আচরণ। পরমাণুর ভেতর যে ইলেক্ট্রন আছে, তাও রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থান নেয়। ফলে সজীব মনযুক্ত মানুষ ও নির্জ্ঞান ইলেক্ট্রনের আচরণ সমান এই ক্ষেত্রে।
মানুষের আচরণ কালচার দ্বারা শেপআপ হয়। তার শারীরিক অনেক আচরণ কালচার দ্বারা দমিত হতে হতে পারে, হয়ও। আবার নাও পারে। অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে এখানে। খুব সরলভাবে বলা হয় না, কীসের ফলাফল কী হবে। আবার কালচার ও মোরালিটি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আচরণের উপর শারীরিক আচরণ ছাপিয়ে উঠতে পারে। ফলে, মানুষ সব সময় খুব মোরল আচরণ করবে এটা প্রত্যাশা অবান্তর, অতিপ্রত্যাশা এবং মানুষের বিবর্তনের বিরোধী চিন্তা। মানুষ নামক ধারণার উপর যে মানবিকতা আরোপ করা হয়েছে, তা মানুষের নৃতাত্ত্বিকভাবে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াবিরোধী। মানুষ পশু ও মানব ধারণার মিক্স। কিন্তা মোরাল জায়গা থেকে মানুষকে অতি মানুষের মতো দেখায়, যা তার প্রকৃত স্বরূপ নয়।
এখন প্রশ্ন হলো, যারা দেশের দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা দেখে জল, স্থল ও বিশেষ অন্তরীক্ষ পথে দেশ ছাড়ার সুযোগ পাচ্ছেন তারা নিশ্চয়ই ফিটেস্ট। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে তারা অবশ্যয়ই ফিটেস্ট। ডারউইনিয়ান ক্লজ আছে, সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। এখন প্রশ্ন হলো, তাদের এই অতি ফিটনেস তাদের শারীরিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে রক্ষা করবে কিনা?
ফিটনেস বিষয়টা শুধু মাসেলের পরিমাপ না। আরো কিছু। বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট রবার্ট সাফলসকির বিহেভ নামে একটা মোটাসোটা বই আছে। তিনি মানুষের মানুষ হিসাবে বেড়ে ওঠাটা দেখিয়েছেন খুব বিশদ প্রক্রিয়া বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে। সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট মানে হলো, কোনও প্রজাতি নিজেদের প্রজাতিকে কতটা সহযোগিতা করতে পারে। শুধু গায়ের জোরে রক্ষা হয় না। একই প্রজাতির কোনও একটা অংশ যদি পরস্পরকে সাহায্য করতে পারে, তবে তারা প্রতিকূল পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে। সহযোগিতাই হলো ফিটেস্ট হওয়ার পূর্ব শর্ত।
যারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তারা মূলত পারস্পরিক সহযোগিতা না করে নিজেদের অভিযোজন ক্ষমতাকে কমিয়ে দিচ্ছেন। তাদের দূরবর্তী প্রজন্ম খুব বেশি দূর সার্ভাইভ করতে পারবে না. যেহেতু স্বার্থপরতার কালচার তার পরবর্তী প্রজন্মের জীনে স্থানান্তরিত হবে। সাময়িকভাবে খুব বড় রক্ষা মনে হলেও তারা যে প্রজন্ম তৈরি করতে চাচ্ছে তা বেশি দূর আগাবে না।
আর কে কোথায় গেল, কত টাকা নিয়ে পালালো, ব্যক্গিত বিমানে, নাকি মাটি খুঁড়ে পালালোর হিসাব থেকে আমাদের প্রথম দরকার সীমিত সম্পদ দিয়ে পারস্পারিক সাহায্যের ভেতর দিয়ে কিছু উপায় খুঁজে বের করা, যা আমাদের ফিটেস্ট হিসাবে গড়ে তুলবে। যেখানে সমস্যা, টেকনোলজি ও দর্শন সেখানে সমাধান। এগুলো আমাদের খুঁজে পেতে হবে। টেকনিক্যাল সমাধান লাগবে। মোরাল জায়গা থেকে সমালোচনা খুব পুরাতন ও মেটাফিজিক্যাল ব্যাপার। এগুলো কাজ করে না। রবং আর্ট যেকোনো সমালোচনা থেকে বেশি কাজ করে যেহেতু তা মানুষের গুহাজীবন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সভ্যতায় আছে।
এসএম সুলতানের ছবির ভেতর শাীরিরীক ও মানসিক ফিটেস্ট মানুষের দেখা পাওয়া যায়। তা দেখে আমরা অনুপ্রেরণা নিতে পারি, বেঁচে যেতে পারি।
লেখক: কবি