মুহম্মাদ মহিউদ্দিনের কলাম ‘খেলাফা কেন হারালাম’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৩, ২০২৩

আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে এই ভূপৃষ্ঠে আমাদের অবস্থান কোথায় ছিল? খেলাফার পতাকা তলে থেকে যে শান্তি অনুভব করেছিলাম, এরপর যখন খেলাফার পতাকা হারালাম তখন বুঝতে পারলাম, পতাকা তলের শান্তি। আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুউচ্চ প্রাচীরে আরোহণ করেছিলাম। চিকিৎসা বিজ্ঞান, পর্থথবিজ্ঞান, জ্যোতিরর্বিদ্যা— সকল বিষয়ে মুসলিম মনীষীরা অবদান রেখেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানকে নতুন দিগন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন। আধুনিক বিজ্ঞানের জনক ছিলেন মুসলিম মনীষীরা। দর্শনবিদ্যাকেও অভিন্ন শেকড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোনো শাখা অবশিষ্ট নেই যে, যে শেকড়ে মুসলিমরা আরোহণ করেনি। গাণিতিক বিষয়েও পারদর্শী ছিলেন। একবিংশ শতাব্দী পরে আব্বাসি খেলাফতের পতনের পর উসমানীয় সালতানাতের আর্বিভাব ঘটে। উসমানীয় সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম উসমানের নাম থেকে উসমানীয় বা অটোমান নামটি এসেছে। মুসলিম ইতিহাসের সূর্য উদয় লগনে উমাইয়া খেলাফতের কাল ছিল।

আব্বাসীয় খেলাফতের উত্থান ও পতন
উমাইয়া খেলাফতের যুগে মুসলমানরা বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে স্থাপনে অন্যতম প্রধান সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। তিনটি মহাদেশের ওপর মুসলমানদের কর্তৃত্ব ছিল। আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় এলে বিশাল সাম্রাজ্য তিনটি অংশে ভাগ হয়ে যায়। স্পেন উমাইয়াদের শাসনে থেকে উত্তর আফ্রিকায় স্বাধীন সার্বভৌম ফাতেমীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এককেন্দ্রিক সাম্রাজ্যের পরির্বতনে তিনটি স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্যের উদ্ভব হয়। উমাইয়াদের রাজত্বে আরবের প্রাধান্য ও হিংসার রাজনীতি বেশি চলত। কিন্তু আব্বাসীয়রা ভ্রাতৃত্ব, সাম্য ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে উদার নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাজত্ব পরিচালনা করতো। ফলে তাদের রাজত্বকাল দীর্ঘয়িত হয়।

এ সময় একক আরবীয় জাতীয়তাবাদের পতন ও বিশ্বজনীন মুসলিম জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। আব্বাসীয় আমলে রাজনীতিতে ও গুণগত পরির্বন আসে। উজির বা মন্ত্রীর পদ সৃষ্টি হয়। দামেস্কের পরিবর্তে বাগদাদ রাজধানী ও কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। আব্বাসীয়দের রাজ্য বিস্তার নীতি না থাকায় সামরিক শক্তি হ্রাস পায়। এতে সাম্রাজ্য সংকুচিত হতে থাকে। আব্বাসীয় খলিফাগণ রাজ্য বিজয়ের চেয়ে অত্যাধিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের প্রতি বেশি নজর দেন। আব্বাসীয় আমলে সকল শ্রেণির মুসলমানরা খিলাফতের শাসন কার্যে কতৃত্ব করার সুযোগ পায়।

মাওয়ালিগণ মুক্তি লাভ করে এবং তারা আরবদের সাথে সমার অধিকার পেয়ে ক্ষমতায় অংশগ্রহণ করে। আব্বাসীয় যুগে শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভৃতি উন্নতি সাধিত হয়। প্রকৃত পক্ষে আব্বাসীয় যুগ ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগ। আব্বাসীয়রা ৫০৮ বছর পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাদের প্রথম খলিফা ছিলেন আবুল আব্বাস আস-সাফফাহ। আব্বাসীয় বংশের খলিফাদের মধ্যে আল-মনসুর, হারুনুর রশীদ এবং আল মানুন ছিলেন প্রখ্যাত। তাদের আমলকে ইহিহাসের সোনালী যুগ বলা হয়। এরা ছিলেন অসাধারণ জ্ঞান পিয়াসী। তাদের উদার ও অপরিসীম দানে মুসলিম সভ্যতা পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। তাদের পর হতে আব্বাসীয়দের পতনের যুগ শুরু হয়। খলিফা মুসতাসিম বিল্লাহর নিহত ও বাগদাদের পতনের মাধ্যমে আব্বাসীয় খিলাফতের পরিসমাপ্তি ঘটে।

উসামনীয় সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন
উসমানীয় সাম্রাজ্য। ঐতিহাসিকভাবে তুর্কি সাম্রাজ্য বা তুরস্ক বলে পরিচিত ছিল। ১২৯৯ সালে অঘুজ তুর্কি বংশোদ্ভূত প্রথম উসমান উত্তরপশ্চিম আনাতোলিয়ায় এই সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম মুরাদ কর্তৃক বলকান জয়ের মাধ্যমে উসমানীয় সাম্রাজ্য বহুমহাদেশীয় সাম্রাজ্য হয়ে উঠে এবং খিলাফতের দাবিদার হয়। ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের কনস্টান্টিনোপল জয় করার মাধ্যমে উসমানীয়রা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য উচ্ছেদ করে।

১৬শ ও ১৭শ শতাব্দীতে বিশেষত সুলতান প্রথম সুলাইমানের সময় উসমানীয় সাম্রাজ্য দক্ষিণপূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া, ককেসাস, উত্তর আফ্রিকা ও হর্ন অব আফ্রিকা জুড়ে বিস্তৃত একটি শক্তিশালী বহুজাতিক, বহুভাষিক সাম্রাজ্য ছিল। ১৭শ শতাব্দীর শুরুতে সাম্রাজ্যে ৩৬টি প্রদেশ ও বেশ কয়েকটি অনুগত রাজ্য ছিল। এসবের কিছু পরে সাম্রাজ্যের সাথে একীভূত করে নেয়া হয় এবং বাকিগুলোকে কিছুমাত্রায় স্বায়ত্ত্বশাসন দেয়া হয়।

উসমানীয় সাম্রাজ্য সুদীর্ঘ ছয়শত বছরেরও বেশী ধরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। তবে দীর্ঘদিনব্যাপী ইউরোপীয়দের তুলনায় সামরিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। ধারাবাহিক অবনতির ফলে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর আনাতোলিয়ায় নতুন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আধুনিক তুরস্কের উদ্ভব হয়। বলকান ও মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যের সাবেক অংশগুলো প্রায় ৪২টি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন
১৯০৮ সালে তরুণ তুর্কি বিপ্লবের পর দ্বিতীয় সাংবিধানিক যুগ শুরু হয়। বিপ্লবের পর ১৮৭৬ সালের সংবিধান এবং উসমানীয় সংসদ পুনরায় চালু করা হয়। বিপ্লব পরবর্তী ছয় বছর ব্যাপক আকারে রাজনৈতিক ও সামরিক সংস্কার শুরু হলেও এই সময়কে উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির সূচনা হিসেবে ধরা হয়। এই সময়টি কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রোগ্রেসের আধিপত্যকাল ছিল।

গৃহবিবাদের সুবিধা নিয়ে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ১৯০৮ সালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা দখল করে নেয় তবে যুদ্ধ এড়ানোর জন্য উসমানীয় ও অস্ট্রিয়ানদের মধ্যকার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অঞ্চল নোভি পাজার সানজাক থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছিল। ইতালীয়-তুর্কি যুদ্ধের সময় উসমানীয়দের বিরুদ্ধে বলকান লীগ যুদ্ধ ঘোষণা করে। উসমানীয়রা বলকান যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। পূর্ব থ্রেস ও ঐতিহাসিক উসমানীয় রাজধানী এডির্ন ছাড়া বাকি অঞ্চলগুলো যুদ্ধের সময় হারাতে হয়। ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের আশঙ্কায় প্রায় ৪,০০,০০০ মুসলিম বর্তমান তুরস্কে পালিয়ে আসে।

একটি কলেরা মহামারীতে অনেকে যাত্রার সময় মারা যায়। জাস্টিন ম্যাককার্থির হিসাব অনুযায়ী ১৮২১ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত বলকানে উসমানীয় মুসলিমদের উপর জাতিগত নিধনযজ্ঞের ফলে কয়েক মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে এবং প্রায় সমসংখ্যক পালিয়ে যায়। ১৯১৪ সাল নাগাদ উসমানীয় সাম্রাজ্য ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকায় তার অধিকাংশ অঞ্চল হারিয়ে ফেলে। এসময় সাম্রাজ্যের অধীনে ২৮ মিলিয়ন জনসংখ্যা ছিল যার ১৫.৫ মিলিয়ন বর্তমান তুরস্কে, ৪.৫ মিলিয়ন সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন ও জর্ডানে এবং ২.৫ মিলিয়ন ইরাকের অধিবাসী ছিল। বাকি ৫.৫ মিলিয়ন বাসিন্দা ছিল উসমানীয়দের অনুগত আরব উপদ্বীপ অঞ্চলের অন্তর্গত।

১৯১৪ সালের নভেম্বরে উসমানীয় সাম্রাজ্য কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়। উসমানীয়রা মধ্যপ্রাচ্য রণাঙ্গনে অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধের প্রথমদিকে উসমানীয়রা বেশ কিছু বিজয় অর্জন করেছিল। এর মধ্যে গ্যালিপলির যুদ্ধ ও কুত অবরোধ অন্তর্গত। তবে রুশদের বিরুদ্ধে ককেসাস অভিযানে ব্যর্থতার মত উদাহরণও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কখনো উসমানীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি। ১৯১৫ সালে রুশ ককেসাস সেনাবাহিনী পূর্ব আনাতোলিয়ায় অগ্রসর অব্যাহত রাখে। উসমানীয় সরকার স্থানীয় জাতিগত আর্মেনীয়দের স্থানান্তর শুরু করে। ফলশ্রুতিতে প্রায় ১.৫ মিলিয়নের মত আর্মেনীয় মৃত্যুবরণ করেছিল যা আর্মেনীয় গণহত্যা বলে পরিচিত। এছাড়া গ্রিক ও এসিরিয়ান সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধেও বড় আকারের হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে।

১৯১৬ সালে আরব বিদ্রোহ শুরু হলে তা মধ্যপ্রাচ্য রণাঙ্গনে উসমানীয়দের স্রোতকে উল্টে দেয়। ১৯১৮ সালের ৩০ অক্টোবর মুড্রোসের যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর হলে তা মধ্যপ্রাচ্যের লড়াইয়ের অবসান ঘটায় এবং এরপর কনস্টান্টিনোপল দখল ও উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিভাজনের ঘটনা ঘটে। ১৯ শতকের শেষ চতুর্থাংশ ও ২০ শতকের প্রথম অংশে প্রায় ৭-৯ মিলিয়ন তুর্কি মুসলিম উদ্বাস্তু হাতছাড়া হওয়া ককেসাস, ক্রিমিয়া, বলকান ও ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপগুলো থেকে আনাতোলিয়া ও পূর্ব থ্রেসে চলে আসে।

কনস্টান্টিনোপল ও ইজমির দখলের ঘটনার কারণে তুর্কি জাতীয় আন্দোলনের সূচনা হয়। পরবর্তীতে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের অধীনে তুর্কিরা স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হয়। ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর সালতানাত বিলুপ্ত করা হয় এবং শেষ সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ ১৭ নভেম্বর দেশ ছেড়ে চলে যান। সালতানাত বিলুপ্ত হলেও এসময় খিলাফত বিলুপ্ত করা হয়নি। ষষ্ঠ মুহাম্মদের স্থলে দ্বিতীয় আবদুল মজিদ খলিফার পদে বসেন। ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ খিলাফত বিলুপ্ত করা হলে সর্বশেষ খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মজিদ দেশত্যাগ করেন।

এভাবেই ইসলামের খেলাফত ব্যবস্থা হারিয়ে ফেলেছিলাম। জ্ঞান-বিজ্ঞানকে আলোর মুখ দেখিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছি। প্রায় এক হাজার বছরের ইহিতাস আমাদের মুছে গেছে। খেলাফার ছায়া তলে আবার যেতে হলে আবার নতুন করে বাচঁতে শিখতে হবে মুসলিম উম্মাহকে। নিজের অস্তিত্ব ফিরে আনতে আবার বদরের যুদ্ধের মতো করে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। মুসলিমদের ইতিহাস রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে। রক্ত দিয়ে আবার সেই ইতিহাস ফিরিয়ে আনতে হবে।