মুহম্মদ জাফর ইকবালের জীবনের মূল্য অনেক অনেক বেশি

ইমতিয়ার শামীম

প্রকাশিত : মার্চ ০৪, ২০১৮

এ নিশ্চয়ই বড় স্বস্তির সংবাদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত। আমাদের মতো মানুষদের চেয়ে তার জীবনের মূল্য নিশ্চয়ই অনেক অনেক বেশি; তিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের তরুণ-কিশোরদের প্রণোদিত করেছেন, প্রণোদনা দিয়ে চলেছেন।

কিন্তু যারা এই ঘটনাটি ঘটার পরই কেবল টের পাচ্ছেন যে, পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর, তাদের করুণা করা ছাড়া কিছুই করতে পারছি না। যেখানে একজন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নেই, একজন সাধারণ নারী বা কন্যাশিশুর পর্যন্ত নিরাপত্তা নেই, যেখানে অভিজিৎরা নিরাপত্তাহীন, সেখানে মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো একজন মানুষ, যিনি রাজনৈতিক দল না করলেও সুস্পষ্ট রাজনৈতিক মতবাদ ধারণ করেন এবং সেই রাজনৈতিক ধারণায় উদ্বুদ্ধ করার জন্যে কাজও করেন, তাকে আঘাত হানতে যে প্রতিক্রিয়াশীলরা ওৎ পেতে আছে, তা বোঝার জন্যে খুব বেশি জ্ঞানী হতে হয় না।

এই তো, খুব বেশি দিন হয়নি, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই জাফর ইকবাল কিছু কথা বলেছেন, যা হয়তো সংবাদপত্রের সেলফ-সেন্সরড করতে অভ্যস্ত সম্পাদকীয় বিভাগের লোকজন কাটতে সাহস পাননি অথবা ভুলে গেছেন। লেখাটি ছাপা হয়েছে ২২ ফেব্রুয়ারিতে ‘আর কতদিন এই ভাঙা রেকর্ড’ শিরোনামে। তাতে তিনি লিখেছিলেন :
‘‘আমি জানতে পেরেছি, বেশ কিছুদিন আগে একটি সরকারি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, যেখানে বিজি প্রেসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়-সম্পত্তির খোঁজখবর নেয়া হচ্ছিল। ... তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই অত্যন্ত সময়োপযোগী প্রয়োজনীয় তদন্তটি হঠাৎ করে ‘ওপরের’ আদেশে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।’’

তিনি একই লেখায় আরও লিখেছেন, ‘‘একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি আমাকে নতুন একটি তথ্য দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে, প্রশ্ন ফাঁসের এই রমরমা ব্যবসার মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বিকাশ। ... যে বড় পুলিশ অফিসারটির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে তিনি বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছেন, এই বিকাশ প্রযুক্তির কারণে কিডন্যাপিং অনেক বেড়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, যে প্রযুক্তি অপরাধীদের টাকা লেনদেনে সাহায্য করে, আমাদের দেশ কি সেই প্রযুক্তির জন্য প্রস্তুত হয়েছে?
...যদি এই প্রক্রিয়ায় অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে টাকা লেনদেন করতে পারে, তাহলে তার দায়দায়িত্ব কি বিকাশকে নিতে হবে না।‘’

এই লেখালেখির কয়েকদিন পর ভার্সিটির র‌্যাগিং সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেন, ‘‘যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থীদের র‌্যাগ দেয় ওই ছাত্রদের আমি শিক্ষক, সে জন্য লজ্জিত, জাতির কাছে ক্ষমা চাইছি। নবীন শিক্ষার্থীদের র‌্যাগিং দেয়ার অপরাধ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, শাস্তি দেয়া হয়েছে। সেই শাস্তিটা গ্রহণ করে ওদের ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটা না করে তারা আন্দোলন করা শুরু করেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি ছাত্রদের কষ্ট দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, তারা শিক্ষকদের সাথেও বেয়াদবি করেছে।’’ (কালের কণ্ঠ, ৩ মার্চ ২০১৮)

মুহম্মদ জাফর ইকবাল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষে কথা বলেন। কিন্তু বোধকরি তিনি সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চেয়ে বেশি কিছু বুঝতে শুরু করেছিলেন আর একজন মানবতাবাদী হিসেবে সেসব নিয়ে মুখ খুলতেও দ্বিধা করছিলেন না। আঘাতকারীরা বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, আঘাত হানার জন্যে এই সময়টিকেই বেছে নিয়েছে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল সুস্থ হয়ে আমাদের মধ্যে ফিরে আসুন, ভাঙা রেকর্ডের ছন্দপতন ধরিয়ে দিন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কিত সাধারণ মানুষের ধারণাগুলো তার লেখায় সঞ্চারিত হোক, কামনা করি।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ভাঙা রেকর্ডের ছন্দপতন ধরানোর লেখালেখি আমাদের ক’জনের ভালো লাগছে? আমাদের কণ্ঠস্বরও কি তার এ জাতীয় লেখা পড়ে আজকের অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে জাফর ইকবালসংক্রান্ত সংবাদগুলোর মন্তব্য অংশে লেখা কথাগুলোর মতোই শোনায় না?