মুখস্তবিদ্যা ও মনে রাখা এক নয়

সরকার আবদুল মান্নান

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৪, ২০২৩

সাম্প্রতিককালে পরিমার্জি শিক্ষাক্রম ২৯২১ বাস্তবায়নের পটভূমিতে মুখস্থবিদ্যা বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের অবতারণা হয়েছে। একটি মহল বলছেন, মুখস্ত করা উচিত নয়। কেননা, মুখস্ত করা জ্ঞানের বিষয় নয়। কেউ কেউ বলছেন, মুখস্তবিদ্যার আশ্রয় নেওয়া আর নকলের আশ্রয় নেওয়া সমান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এমন ধারণা পোষণ করতেন। এর বিপরীতে আরেকটি মহল বলছেন, মুখস্ত করা অনিবার্য। মুখস্ত করা ছাড়া গণিতের সূত্রাদি, বিজ্ঞানের সূত্রাদি এবং আরও হাজারটা বিষয় আত্মস্থ করা সম্ভব নয়, প্রয়োগ করাও সম্ভব নয়। বিশেষ করে ২০২১ সালের পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের পটভূমিতে এই বিতর্ক জোরালো হয়ে উঠেছে।

এই বিতর্কে কিছু ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ আছে। মুখস্ত করা বলতে আমরা কী বুঝি? এই বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। মুখস্ত করা হলো, কোনো কন্টেন্ট বা পাঠ বারবার আওড়িয়ে স্মৃতিতে ধারণ করে রাখার চেষ্টা এবং পরীক্ষার খাতায় হুবহু তা লেখার প্রয়াস। যেমন রচনা মুখস্ত করা, সারাংশ-সারমর্ম মুখস্ত করা, ভাবসম্প্রসরাণ মুখস্ত করা, কোনো প্রশ্নের উত্তর হুবহু মুখস্ত করা, এমনকি গণিত অথবা জ্যামিতি মুখস্থ করা ইত্যাদি। যারা হাফেজ হন তারা এই পদ্ধতিতে পবিত্র কুরআন শরিফ মুখস্ত করেন। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূলত অতি অল্প সময়ের মধ্যে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার জন্য কোনো বিষয় বারবার আওড়িয়ে স্মৃতিতে ধারণ করার প্রাণান্তকর চেষ্টাকে বলে মুখস্তবিদ্যা।

এই মুখস্তবিদ্যার বিরুদ্ধে শিক্ষাবিজ্ঞানীদের অবস্থান।  যারা শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেন এবং শিক্ষার্থী মূল্যায়নের কৌশল ও বিধিবিধান প্রণয়ন করেন তারা এমনতর মুখস্তবিদ্যাকে নিরুৎসাহিত করেন। কারণ এর সঙ্গে কগনেশনের ক্ষীণ সম্পর্ক আছে অর্থাৎ অনুধাবন, প্রয়োগ, সংশ্লেষণ, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের কোনো সম্পর্ক থাকে না। সুতরাং এই হলো মুখস্তবিদ্যা।

অন্যদিকে আমরা প্রত্যেকেই প্রতিনিয়ত কথা বলছি কিংবা লিখছি। সেই লেখা পরীক্ষার খাতায় হতে পারে অথবা অন্য কোনো কারণেও হতে পারে। কথা বলা ও লেখার জন্য আমাদের কিছু বিষয় স্মৃতিতে ধারণ করতে হয়। আমরা আমাদের মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়- স্বজনের নাম মনে রাখতে পারি। মুখস্ত করতে হয় না। অনেক স্থানের নাম, পশুপাখির নাম, গাছগাছালি ও ফুল- ফলের নাম আমাদের মনে থাকে। মুখস্ত করতে হয় না। পঠন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে বিচিত্র বিষয় আমাদের মনে স্থান করে নেয়। কিংবা দেখে, শুনে, স্পর্শ করে, গন্ধ নিয়ে নানা তথ্য আমাদের মনে আশ্রয় গ্রহণ করে। এগুলো মুখস্ত করা নয়।

আমি যদি বলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল প্রাইজ লাভ করেছেন। এই কথাটুকু বলতে গেলে আমাকে  ১৯১৩ ও গীতাঞ্জলি  ইত্যাদি তথ্য স্মৃতিতে ধারণ করে রাখতে হয়। এই বিষয়টিকে মুখস্ত বলে না। এগুলো হচ্ছে মানুষ হিসেবে আমাদের সহজাত ও সাধারণ প্রবণতা। আমাদের মস্তিষ্কের বৈশিষ্ট্য এই যে, সে কিছু তথ্য ধারণ করে রাখে এবং সেটা খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এজন্য সারাক্ষণ আওড়িয়ে মুখস্ত করতে হয় না। স্মৃতিতে ধারণ করা ওইসব তথ্য বিভিন্ন সময় ব্যবহার করা হয়। সেই ব্যবহার হতে পারে আলাপচারিতায়, কথা বলায়, বক্তৃতায়, লেখায় কিংবা পরীক্ষায়।ৎ

সুতরাং আমাদের কিছুতেই ভুললে চলবে না যে, যাকে মুখস্তবিদ্যা বলে তার সঙ্গে অবলীলায় স্মৃতিতে ধারণ করে রাখার বিষয়টি এক নয়। একজন মানুষ যখন কিছু দেখে, স্পর্শ করে, পড়ে বা শোনে তখন স্বাভাবিকভাবেই বেশ কিছু তথ্য তার স্মৃতিতে জমা হতে থাকে। এইসব তথ্য বারবার আউড়িয়ে, বারবার পড়ে, বারবার বলে স্মৃতিতে ধারণ করে রাখতে হয় না। এইসব তথ্য আপনা থেকেই আমাদের স্মৃতিতে সংরক্ষিত হয়। একে কিছুতেই মুখস্তবিদ্যা বলা যাবে না। সুতরাং, এই বিভ্রান্তি থেকে আমাদের মুক্ত হওয়া প্রয়োজন যে, মুখস্তবিদ্যা আর তথ্যাদি স্মৃতি ধারণ করা বা অবলীলায় সংরক্ষিত হওয়া এক নয়।

লেখক: শিক্ষাবিদও সাহিত্যিক