মির্জা তাহের জামিল
মির্জা তাহের জামিল ও একটি পরাবাস্তবতার গল্প
লতিফ জোয়ার্দারপ্রকাশিত : জানুয়ারি ২২, ২০২৫
কতদিন কতকাল আর যাওয়া হয় না অ্যাডওয়ার্ড কলেজের কলাভবনে। ঘাসের জমিনে বসে আর আড্ডা হয় না। ইংরেজি বিভাগের সিঁড়িতে বসে বন্ধুর হাত ধরে গল্প বলা হয় না। সেই ইটের রাস্তায় আর হাঁটা হয় না। মনার চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেওয়া হয় না। সেই লিচু গাছের ছায়ার কাছে আর কখনও কোনোদিন যাওয়া হবে না আমার।
কখনও মনে হয়, আবার একদিন চুপিসারে ঘুরে আসবো কলা ভবনের ওলিগলি ধরে। সেই মনার চায়ের দোকান এখন হয়তো আর নেই। কত কিছুই তো হারিয়ে যায়। পায়ের চিহ্ন মুছে যায়। শুধু পরে থাকে স্মৃতির রোজনামচাগুলো। সেই তারুণ্য নির্ভর কবিতার সাথে এখনও আছি আমি। শুধু নেই কেউ কেউ! এভাবেই আমিও একদিন হারিয়ে যাব।
দূর আকাশের নক্ষত্র হয়ে যাব। কোনোদিন আর কারো সাথে দেখা হবে না। কথা হবে না! তবুও এখনও আমি কোনো এক কুয়াশায় ডুবে যাওয়া সকালবেলায় আমার সেইসব দিনের কাছে ফিরে যাই। অথচ কখনও আমার মনে হয়, একটা লেখা লিখতে না পারার ব্যর্থতা পেয়ে বসেছে আমায়। মাঝে মাঝে কিছুই লিখতে পারি না আমি।
কত সময়, কত দিন চলে যায়! কত মাস অলস মাছের মতো চুপ করে থাকি। এই না পারার বহুবর্ণিল ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে ব্যথার বিষাদমাখা একটা দিন সামনে আসে আমার। একটা ক্ষণ আমাকে স্তব্ধ করে দেয়। কিছু সময়ের জন্য আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। এমন কিছু ব্যথা আছে যা কাউকে কখনও বলা যায় না। অথচ বুকের ভিতর ডুকরে কেঁদে ওঠে।
চোখের পাতা একাকী ভিজে যায়। একটা মৃত্য সংবাদ আমার স্বাভাবিক জীবনে ছন্দ-পতন ঘটায়। আমি ভেবে পাই না! আমার তো এমন হবার কথা নয়। আমার তো দু’চোখ জলে ভেজার কথা নয়। কারণ আমাদের অভিমান এক জনমে শেষ হবার কথা ছিল না। পাঠক মাত্রই এখনও বুঝতে পারেননি, আমি কার কথা লিখছি। আমি কার কথা বলছি।
সে হয়তো আমার গল্পের চরিত্র নয়। তাকে নিয়ে আমি কোনোদিন কোনো কবিতাও লিখিনি। আমাদের দেখা-সাক্ষাতের সাদা পাতা বারবার ছিঁড়ে ফেলেছি আমি। কোনো উচ্ছ্বাসমাখা দিনের কাছে আর ফেরা হয়নি আমাদের। অথচ আমাদের দুরত্ব মাত্র ত্রিশ কিলোমিটার। অভিমান এমনই হয়। এই সামান্য দুরত্বও মনে হয় ত্রিশ হাজার বছরের।
যার কথা লিখছি তার নাম মির্জা তাহের জামিল। সদ্যপ্রয়াত মির্জাকে নিয়ে লিখতে বসার পর, আমার মনে হচ্ছে সে কী আমার বন্ধু ছিল! নাকি বন্ধুর মতো ছিল। দীর্ঘ সময় একসাথে চলার সঙ্গী ছিল। না! মূলত মির্জা তাহের জামিল আমার লেখক বন্ধু ছিল। আমার সহপাঠী ছিল। এক কলেজে একসাথে চারটি বছর কাটিয়েছি আমরা।
বয়ঃসন্ধিক্ষণে আমরা মনের আল্পনার জলরঙে সাদা পাতায় বন্ধু শব্দটি বারবার লিখেছি। বন্ধুত্বের বিলাপের কাছে হাহাকার ধ্বনি শুনেছি। একটা বৃক্ষ কতকাল বেঁচে থাকে! আকাশ ছোঁবে বলে কতটা উচ্চতায় গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে! সেই বৃক্ষের মতোই একদিন মির্জা তাহের জামিল স্বপ্ন দেখেছিল, সে একদিন আকাশ ছোঁবে।
ছড়া দিয়ে লেখালেখি শুরু করলেও এক সময় গল্পে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল সে। তার লেখা দু’একটি গল্প পড়ার সৌভাগ্যও হয়েছিল আমার । সে এক অন্য ভুবনের গল্প। কল্পনা আর বাস্তবতার মিশেল দিয়ে যে পিরামিড তৈরি করতো মির্জা, সেখানে হয়তো অনেকেই প্রবেশ করতে পারতো না। মির্জা তাহের জামিলের গল্প ছুঁতে না পারার ব্যর্থতা অনেকেই আছে।
সেই যে পরাবাস্তবতার গল্প। সেখানেই এক উঁচু পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মির্জা তাহের জামিল। মির্জা তাহের জামিল কী আমার প্রিয় গল্পকার ছিল? তা হয়তো আমি বলতে পারবো না। কারণ দু’চারটি গল্প পড়েই কাউকে প্রিয় গল্পকার বলা যায় না। তবুও তাকে যতটুকুন পাঠ করেছি আমি, তাকে আমি প্রিয় গল্পকারই বলবো বারবার।
১৯৮৬ সালে প্রথম আমাদের দেখা হয়েছিল, অ্যাডওয়ার্ড কলেজ মাঠে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে। আচ্ছা প্রথম দিন কী আমাদের মধ্যে কোনো কথা হয়েছিল। না! কানো কথা হয়নি। কথা হয়েছিল তার কয়েকদিন পর। সেদিন ছিল আমাদের এইচ এস সির প্রথম ক্লাস। একটা ক্লাসে প্রায় আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম সেদিন।
ক্লাসের প্রথম দিনই কথা হয়েছিল মির্জার সাথে। অল্প দিনেই মির্জা আমার লেখক বন্ধু হয়েছিল। মির্জা তাহের জামিলের মাধ্যমেই পাবনা লেখকদের সাথে পরিচয় ঘটেছিল আমার। মনে পড়ে তার অনুপ্রেরণাতেই সেই ১৬ বছরে বয়সে আমি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনায় হাত দিয়েছিলাম। আমার সম্পাদিত সেই সাহিত্য পত্রিকার নাম ছিল ‘কমলা’।
তখন আমরা পাবনা কবি কণ্ঠের আসরে যেতাম। মির্জা কী যে অসাধারণ ছড়া লিখতো। আর আমায় বলতো, এতটুকুন বয়সে যে ছেলে লিখতে পারে:
দূর আকাশ দেখতে তোমায় দেখি
জোনাকজ্বলা রাতে একা
সেই করতলে কত কথোপকথন
আবহমান কাল ধরে এক একটি কবিতা
মনে করো তোমার এলো চুলের মতো রাত
বেদনার কালো ছায়ায় ঢেকে দেয় আলো
সেই ছেলে তো একদিন বড় কবি হবেই হবে। সাহিত্যের সাথে কী যে নিবিড় যাত্রা ছিল আমাদের। তাকে এক প্রকার অসুখ বলা যেতে পারে। সেই অসুখে আমি ভুগতাম, মির্জা তাহের জামিল ভুগতো। এইচ এস সি পাশ করে আমরা ঢাকাতে গেলাম একদিন। সাহিত্য চর্চার জন্য আমরা হয়তো ঢাকা থাকতে চেয়েছিলাম। অথচ কারোই আর ঢাকাতে পড়া হলো না।
ঢাকাতে থাকা হলো না। আমরা আবার পাবনার মাটিতে ফিরে এলাম। পাবনা শহরে আমরা বেড়ে ওঠার গল্প লিখলাম। একদিন একটা আগুনফুল হয়ে ফুটেছিল মির্জা তাহের জামিল। সবাই ভেবেছিল বাংলা সাহিত্যে একটা বড় জায়গা করে নেবে সে। আর এভাবেই দিন যেতে যেতে আমি হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলাম। ক্ষণজন্মা ফুল হয়ে। আর ফিরবো না আমি।
আর কখনও কোনদিন লিখবো না আমি। আমরা একে অপরের জন্য দুরত্ব রচনা করলাম আবার। অতঃপর আবার যখন দেখা হলো তখন জীবন থেকে কুড়িটি বছর চলে গেছে। পনের বছর পর তখন আবার লিখছি আমি। জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস লিখে খানিকটা পরিচিতিও পেয়েছি আমি। আর মির্জা কবে কখন আবার ঢাকাতে ফিরেছিল, তাও জানি না।
আবার কখন কীভাবে ব্যর্থতার অজুহাতে ফিরে এসেছিল ঘরে। এর কিছুদিন পরেই আবার দেখা হলো আমাদের। বড় গল্পকার হিসেবে মির্জা তাহের জামিল বেশ পরিচিত তখন আর আমি আমার মতো করে লিখছি। উপন্যাসের পাশাপাশি আবার কবিতায় ফিরেছি আমি। আবার লিটলম্যাগ সম্পাদনা করছি। এভাবেই একদিন আমার লিটলম্যাগের জন্য মির্জা তাহের জামিলের কাছে একটা গল্প চাইলাম।
ও বললো, জানো লতিফ, দুই বছরে আমি একটি গল্প লিখি মাত্র। তোমাকে আমি গল্প দেব কী করে। তবে আমি যতই অল্প লিখি, একদিন আমার গল্প সবার সব গল্পকে ছাড়িয়ে যাবে। আমি যেদিন থাকবো না, সেদিন আমার লেখা গল্প নিয়ে সবাই কথা বলবে আবার।
এরপর থেকে কোনো এক অজানা অভিমানে আমাদের মনের দুরত্ব বাড়তে থাকলো। আর কখনও কোনোদিন দেখা হয়নি আমাদের। মির্জা তাহের জামিলও শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল একদিন। সবার থেকে সবকিছু থেকে একদিন নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিল। লেখালেখিও ছেড়ে দিয়েছিল বলে শুনেছি।
কেন, কী কারণে যে এভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল মির্জা, তার কিছুই জানি না আমি। তবে শুনেছি চিরকুমার মির্জা তাহের জামিল সিগারেটের আগুন থেকে সিগারেট ধরিয়ে নিজেকে পুড়াতো বারবার। কিসের অভিমান, কার ওপর অভিমান, তার কিছুই জানি না। একজন লেখক কীভাবে নিজেকে শেষ করার আয়োজন করতে পারে, সেই গল্প আমার কাছে অজানা থাকলেও,আমার জানাটা উচিত ছিল।
সে কারণে এখন নিজেকে অপরাধী মনে হয় আমার। মির্জা তাহের জামিল এখন দূর আকাশের তারা। আর কখনও কোনোদিন দেখা হবে না আমাদের।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক