মিরাকল বেবি
মারিয়া সালামপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৮
চুপচাপ বসে আছি। সবাই ভাবছে, অতি শোকে আমি পাথর হয়ে গেছি। একজন মাথায় হাত রেখে বলছে, কাম অন, তুমি আমার দেখা সবচেয়ে স্মার্ট মেয়ে, তোমার ভেঙে পড়লে চলবে না, তুমি মন শক্ত করো, সব আল্লাহর ইচ্ছা।
ঠিক এ কথাটাই মানতে পারছি না। সবাই ভাবছে, আমি চিন্তা শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। না-হলে এ অবস্থায় কেন কান্নাকাটি বাদ দিয়ে চুপচাপ বসে আছি! বাড়ির অন্য সবাই কাঁদছে, আমার শ্বশুর একটু আগেই ফিট লেগে গেছিল, এখন তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। কিন্তু আমার শোক করার সময় নেই। আমার হাতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময়, এর মধ্যেই আমাকে একটা উপায় বার করতে হবে। এভাবে মেনে নিতে পারবো না, একটা শেষ চেষ্টা করতে হবে, কিন্তু সেটা কিভাবে, সেই চিন্তাই করছি এখন।
উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। আমাকে বের হতে হবে, এখনি, হাতে সময় কম। বাথরুমের দিকে যেতেই একটু টাল খেলাম, শরীর বেশ দুর্বল। আজ সাতদিন ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করতে পারিনি। তবে মনের জোর আছে। আমি জানি, এই লড়ায়ে আমি জিতে যাব। মাঝে মাঝে সৃষ্টিকর্তার সাথে লড়াই করতে হয়, আর জিততেও হয়।
আমার বাপি এসে হাত ধরে বসাতে চাইলো। বলল, বুড়ি, তুমি অস্থির হয়ো না, কিচ্ছু হবে না। আমার খালা বলল, মা তুমি একটু ঘুমাও, বলেই সে ইঞ্জেকশন রেডি করতে গেল। আমি ঘুমালে কিভাবে বাঁচাব আমার ছেলেকে! আমি হ্যান্ডব্যাগটা নিলাম, আমাকে এক্ষুনি বের হতে হবে, সময় শেষ হয়ে আসছে।
আমার মা আটকালো, কোথায় যাচ্ছিস তুই? আমি একটু কাজে যাচ্ছি মা, এসে পরবো তাড়াতাড়ি। এখন বাচ্চার চিন্তা করা ছাড়া তোর আর কি কাজ? কেন এমন পাগলামি করছিস? তুই কি আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে চাচ্ছিস না?
আমার পার্টনার হাত ধরে বসাতে চাইলো আমাকে, আমি হাত ছাড়িয়ে গেটের দিকে যেতে থাকলাম, পেছনে তার বন্ধু বলতে লাগলো, মেয়ে মানুষকে অনেক ধীরস্থির হতে হয়, তার মধ্যে এসব নাই, বাচ্চা পেটে নিয়ে রাত নাই, দুপুর নাই, বাইরে বাইরে থেকেছে, সবাইকে পেট দেখিয়ে ঘুরেছে, নিয়ম মানেনি বলেই আজ এরকম হলো।
তাতে আমার কিছু এসে গেল না। আমি জানি, আমি কোনো ভুল করিনি। আমি চাকরি করেছি, পেটে বাচ্চা নিয়েও রাতদিন অফিসে কাজ করেছি, নাইট শিফট করেছি, আমি পেরেছি, তাই করেছি, এটা আমার সক্ষমতা। বাচ্চা অসুস্থ দেখে সব দোষ আমার বাইরে যাবার, কিন্তু বাড়িতে যে আমি কাজ করেছি! রান্না করেছি, বাড়ি পরিষ্কার করেছি, কাপড় ধুয়েছি, সেসব নিয়ে কেউ কথা বলে না কেন? এসব কি কাজ না? নাকি এসব করতে কষ্ট লাগে না? আমাকে বাড়ির কাজ করতেও অবশ্য মানা করা হয়েছিল, কিন্তু আমিতো পারতাম আর একদম সুস্থ ছিলাম।
দুই.
ডা. হানিফ বললেন, আপনি কে? এভাবে হাঁফাচ্ছেন কেন? পানি খাবেন? আমি বললাম না, পানি লাগবে না। আমার সাতদিনের ছেলে খুব অসুস্থ, ক্লিনিকে বলে দিয়েছে বড়জোর আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত ও বাঁচবে। আমি এখন কারো কথা বিশ্বাস করছি না, আমি জানি আমার ছেলের কিছু হবে না। আপনি হাজার হাজার শিশুর কথা ভেবে, ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন, আপনি আমার ছেলেকে একটু দেখুন, আপনি যা বলবেন আমি মেনে নেব।
উনি সব কিছু জানতে চাইলেন। আমি বললাম, ওর জন্ম নরমাল হয়েছে, আগে কোনো সমস্যা ছিল না। তবে আগের দিনে রান্না করার সময় আমার লিকিং মেমব্রেন হয়েছিল। কিন্তু বাচ্চা হবার পরে একদম সুস্থ ছিল বলে আমার ডাক্তার বাচ্চার কোনো মেডিকেল চেকআপ না করে ওইদিনই আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। দুপুরে সে ভালোই ছিল, রাতে কলাপস্ করলো। তারপর থেকে লাইফসাপোর্টেই আছে।
উনি মনযোগ দিয়ে সব রিপোর্ট দেখে আমাকে বললেন, এখনই বিশেষ ব্যবস্থায় বাচ্চাকে শিশু হসপিটালে নিয়ে আসুন। দেখি আমি কিছু করতে পারি কীনা।
শিশু হসপিটালের গেটে বিশাল এক জটলা। কাছে গিয়ে দেখি, একমাসের একটা বাচ্চার লাশ নিয়ে এক মা চিৎকার করে কাঁদছে, সে বাচ্চাকে সুস্থ না করে বাড়ি ফিরে যাবে না, তাকে কিছুতেই গাড়িতে তোলা যাচ্ছে না। আমি রাস্তায় বসে পড়ি। ক`জন মহিলা আমাকে ধরে ওই গাড়িতে তুলতে যান, আমি হাত ছাড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াই।
এম আর খানের সামনে বসে আছি। উনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রিপোর্ট দেখছেন। মুখ তুলে বললেন, আপনি যেয়ে রেস্ট নেন মা। আমি আসছি, আমি এখনি দেখবো আপনার ছেলেকে। ডা খালেদ নূর বললেন, আপনার ছেলের নামে আমার রাজশাহীর বাড়ির নাম, নির্ঝর। আমার খুব মায়া লাগছে, ওকে আপনি আমার এখানে নিয়ে আসুন, আমি যা করার করবো।
ক্লিনিকে ফিরে দেখি, এম আর খান আমার ছেলেকে দেখতে এসেছেন। আমাকে ডেকে বললেন, মা, আপনি অনেক শক্ত মানুষ, মনকে তবু আরো শক্ত করতে হবে। ওর আর কোনো চিকিৎসা বাকি নেই, দেশের বাইরে নিলেও আর কিছু হবে বলে মনে হয় না। তবে মিরাকল হতে পারে, হয়! আপনি অনেক ক্রিটিকাল কন্ডিশনে ওকে জন্ম দিয়েছেন, আর ও কি স্ট্রাগল করে, কত ফাইট করে যে পৃথিবীতে এসেছে, আপনাদের কোনো ধারণা নাই। ওর তখনি মরে যাবার কথা। কিন্তু ও এখনো ফাইট করে যাচ্ছে, ও মিরাকল বেবি, তাই আমরা এখন একটা শেষ চেষ্টা করবো, দেখি ও নিতে পারে কীনা। আমরা এখন ওর শরীরের সব রক্ত ফেলে নতুন রক্ত দেব। আরেকটু ফাইট দিতে পারলে, আপনি ওকে নিয়ে বাড়ি যেতে পারবেন।
আমি কেবিনের জানালায় বসে আছি, একা। বাকিরা এনআইসিউয়ের সামনে জটলা করছে। মওলানা এসে দোয়া করছেন। আমার সাথে খালি কাকদুটো বসে আছে। এদের নাম দিয়েছি, জীবন আর মরণ। আমি জানি, এদের মধ্যে একজন শেষপর্যন্ত থাকবে, আর একজন উড়ে যাবে, আমি সেই অপেক্ষায় বসে আছি। আমার ছেলের সাথে পাখিদের কী অদ্ভুত একটা যোগ আছে, ওর জন্মের তিনদিন আগে থেকেই এক লক্ষ্মীপেঁচা কোথায় থেকে এসে ঠিক আমার রুমের জানালার পাশের গাছটায় ঠাঁই বসে ছিল। জন্মের দিন ওকে বাসায় আনার সাথে সাথেই সেই পেঁচাটা গ্রিলের ফাঁক গলে বারান্দায় এসে পড়লো। আমরা তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আর নির্ঝরকে ক্লিনিকে আনার পর থেকেই, জীবন-মরণ ঠাঁই এই জানালার পাশে বসে আছে, বৃষ্টি হলেও উড়ে যায় না। আমি জানি, এদের একজন শেষপর্যন্ত আমার সাথে থাকবে, আর একজন উড়ে যাবে, তার সময় হলেই। আমি অপেক্ষায় আছি।
ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল সেদিন। ডাক্তারদের বেঁধে দেয়া সময় শেষ হয়ে আসছে প্রায়। আমি জীবন-মরণের উপর থেকে চোখ সরাতে পারি না। আমি জানি, ওদের একজন ঠিক এখনি উড়ে যাবে। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমি সৃষ্টিকর্তাকে ডাকি না, তাকে আমি ডাকবো না, তার সাথে আমার এই ঠাণ্ডা লড়াইটা চলতে থাক।
হঠাৎ একটা কাক উড়ে গেল। কে চলে গেল আমি জানি না। আমার চোখ ফেটে পানি নামছে এই প্রথম। আমি কি হেরে যাব? তুমি কি জিতে যাবে হে খোদা? আশপাশটা ঝাপসা হয়ে আসছে... দরজায় নক পড়ছে, ঠক ঠক ঠক...