মিজানুর রহমান আজহারীর প্রবন্ধ ‘ইসলামে হালাল-হারাম’

প্রকাশিত : জুন ০৫, ২০২০

আমাদের জীবনের সবচেয়ে দামি জিনিস হচ্ছে, সময়। আল্লাহর দেয়া সবচেয়ে বড় নিয়ামত সময়। এজন্য আমরা যেন সময়কে খারাপ কাজে, অকল্যাণের কাজে ব্যয় না করি। আমাদের একটা শক্ত সিদ্ধান্ত পারে আমাদেরকে জান্নাতি বানাতে। অন্যদিকে, আমাদের একটা দুর্বল সিদ্ধান্ত পারে আমাদেরকে জাহান্নামের লাকড়ি বানাতে।

সুতরাং, সিদ্ধান্ত আপনার। আপনি কোনদিকে যাবেন? ডানে নাকি বামে? ডানে গেলে জান্নাত আর বামে গেলে জাহান্নাম। সো, আমরা কোনদিকে যাব? ডানদিকে যাব। আমরা ডানপন্থী। সকল নবিরা কোন পন্থী ছিলেন? ডানপন্থী। আমরা যেন ডানপন্থী থেকে আমাদের জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি, আল্লাহ তুমি আমাদেরকে তাওফিক দাও।

আজকের ওয়াজের বিষয় হলো, হালাল-হারাম। হালাল চলে গেছে একদিকে, হারাম চলে গেছে আরেদিকে। আমরা কোনদিকে যাব? হালালের দিকে। হালালে বরকত বেশি, হারামে কোনো বরকত নাই। একটা উদাহরণ দেই। একলোক অবৈধ পথে মাসে এক কোটি টাকা ইনকাম করে। গিয়ে দেখুন, প্রতি মাসে হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে তার চলে যায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। বউয়ের ক্যান্সার, ছেলে ইয়াবা খায়, বাড়ি ভাড়া, গাড়ি ভাড়া দিয়ে দেখা যায়, মাস শেষে তার আরো বিশ লক্ষ টাকা ঋণ।

আর একজন রিকশাঅলার মাস শেষে ইনকাম পনেরো হাজার। বাড়ি ভাড়া দুই হাজার, ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ এক হাজার, খরচপাতি দশ হাজার, চিকিৎসা খরচ এক হাজার, মাস শেষে দেখা যায় হাতে আছে এক হাজার। প্রথম লোক এক কোটি টাকা ইনকাম করেও মাস শেষে বিশ লক্ষ টাকা ঋণের বোঝা বহন করছে, আর দ্বিতীয় লোক পনেরো হাজার টাকা ইনকাম করে মাস শেষে এক হাজার টাকা হাতে আছে। কারণ, তার পুরো টাকাগুলো হালাল।

আরেকটা উদাহরণ দেই। গরু খাওয়া হালাল নাকি হারাম? হালাল। আর কুকুর খাওয়া হালাল নাকি হারাম? হারাম। কুরবানির ঈদে কী জবাই হয়? সুন্নতে খৎনার অনুষ্ঠানে? বিয়ের অনুষ্ঠানে? কসাইর দোকানে? গরু জবাই হয়। কোথাও কি শুনেছেন, এসব জায়গায় কুকুর জবাই হতে? গাভী বছরে বাচ্চা দেয় কয়টা? মাত্রা একটা। আর কুকুর? চারটা, পাঁচটা, আটটা? দেখুন, গাভী বাচ্চা দিলো কম, কুকুর দিলো বেশি, গরু জবাই হয় বেশি, কুকুর জবাই হয় না, আমরা গরু খাই, কিন্তু কুকুর খাই না। তাহলে আমাদের আশপাশে সবচেয়ে বেশি কী থাকার কথা, গরু নাকি কুকুর? কুকুর। কিন্তু আমাদের আশপাশে কী আছে বেশি? গরু।

গরু খাওয়া হালাল। আর হালালে বরকত ঢুকিয়ে দিয়েছেন কে? আল্লাহ। এজন্য সিদ্ধান্ত আপনার। হালাল খাবেন নাকি হারাম খাবেন। হালাল হলো পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যসম্মত, রুচিশীল। এটাতে কোনো ভেজাল নাই। হালাল অল্প খেলেও লাভ, এটার মধ্যে বরকত আছে। এজন্য আল্লাহ বলেন, “হে মানুষ, জমিনে যা রয়েছে তা থেকে হালাল পবিত্র বস্তু আহার করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা বাকারা: ১৬৮)

শয়তান আমাদের সামনে হারাম জিনিস চাকচিক্যময় করে দেখায়। বুঝাতে চায় হারামে আরাম। এখন আমি যদি প্রশ্ন করি, আমরা আমাদের উপার্জনে কী খাই? হালাল খাই নাকি হারাম খাই? হালাল খাই। আর যদি হারাম খাওয়ার সুযোগ পাই তাহলে ‘ওমনি ধরে ঘাপুস ঘুপুস করে খাই’। না, ঘাপুস ঘুপুস করে হারাম খাওয়া যাবে না। অনেকেই আছে দেখবেন, ইনকাম করে হারাম পথে আর খাবার খাওয়ার জন্য হালাল খোঁজে। হারাম পথে লক্ষ লক্ষ টাকা দুই হাতে কামায়। সে শুকরের মাংস খাবে না, কারণ ওইটা হারাম। কিন্তু ঠিকই ঘুষ খায়। ঘুষ খাওয়া কি হালাল?

বিশ্বনবি ঘুষ দাতা ও গ্রহীতা, উভয়কেই অভিশাপ দিয়েছেন। (সুনানে আবু দাউদ: ৩৫৮০) আমাদের মুসলমানদের একটা সমস্যা হলো, আমরা খাবার খেতে গিয়ে হালাল খুঁজি, আর ইনকামের বেলায় হালাল-হারামের কোনো বালাই রাখি না। আপনার পোশাক হতে হবে হালাল, আপনার খাবার হতে হবে হালাল, আপনার বিনোদন হতে হবে হালাল, তারচেয়ে বড় কথা আপনার উপার্জন হতে হবে হালাল। উপার্জন হালাল না হলে দু’আ কবুল হবে না।

বিশ্বনবি বলেন, “একলোক দীর্ঘ সফরে বের হলো। তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, কাপড়ে ধুলোবালি মিশে আছে। এরপর সে আকাশের দিকে হাত তুলে দু’আ শুরু করলো, ‘হে আমার রব, হে আমার রব।’ অথচ তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, সে হারামভাবে লালিত-পালিত হয়েছে; এ অবস্থায় তার দু’আ কিভাবে কবুল হবে?” (সহীহ মুসলিম: ১০১৫)

ছেলেরা সোনা পরতে পারবে না, রেশমের কাপড় পরতে পারবে না, গলায় চেইন পরতে পারবে না, হাতে ব্রেসলাইট পরতে পারবে না। দাড়িতে কালো রঙ দেয়া যাবে না। বিশ্বনবি বলেন, “যে ব্যক্তি ধোঁকা দেয়, প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” (সুনানে আবু দাউদ: ৩৪৫২)

একবার বিশ্বনবি মদিনার বাজার মনিটর করতে গেলেন। গিয়ে দেখলেন খেজুরের দোকানে উপরে শুকনো খেজুর আর নিচে ভেজা খেজুর। জিজ্ঞেস করলেন, এমন কেন? দোনাকদার বললো, ‘বৃষ্টি হয়েছিল, এজন্য।’ কিন্তু বৃষ্টি হলে তো আশপাশে বৃষ্টির ছাপ থাকবে। কোথাও তো বৃষ্টির ছাপ নেই। তখন বিশ্বনবি কঠিন হুঁশিয়ারি দেন, যে ব্যক্তি প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।

আমার কথাগুলো তখনই সার্থক হবে, যখন আমরা সবাই মিলে এই সিদ্ধান্তে আসতে পারবো—আমরা হারাম খাব না, হালাল দিয়ে জীবন সাজাবো। অনেক নারীরা ফ্যাশন করে। টাইট-ফিট পোশাক পরে, পরচুলা লাগায়, অন্য ধর্মের পোশাক পরে। এগুলো করা যাবে না। সুতরাং, আমরা হালালের পক্ষে আর হারামের বিপক্ষে।

হালাল মেনে চলার কিছু প্রিন্সিপ্যাল বা মূলনীতি আছে। এই মূলনীতিগুলো যদি মেনে চলেন তাহলে জীবনটা হালাল দিয়ে সাজাতে পারবেন। হালাল-হারামের চারটি মূলনীতি। মূলনীতিগুলো আমি সহজে উপস্থাপনের চেষ্টা করবো; যদি সহজে উপস্থাপন করাটা কঠিন। একবার রবীন্দ্রনাথকে একজন বললেন, “আপনি আপনার লেখাগুলো আরেকটু সহজ করে লিখেন না কেন?” রবীন্দ্রনাথ লোকটির প্রশ্নের উত্তর দেন তার একটা কবিতায়।

সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে,
সহজ কথা যায় না লেখা সহজে।

তবুও আমি যতটা পারি সহজে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। বিশ্বনবি বলেন, “তোমরা সহজ পন্থা অবলম্বন করো, কঠিন পন্থা অবলম্বন করো না। মানুষকে সুসংবাদ দাও, বিরক্তি সৃষ্টি করো না।” (সহীহ বুখারী: ৬৯)

আমরা দ্বীনকে কঠিন করে ফেলি। একজন হিন্দু মুসলমান হতে এসেছে, আমরা টানাটানি শুরু করে দিই। তাকে সুন্নী বানাবে, ওয়াহাবী বানাবে, আহলে হাদীস বানাবে নাকি হানাফী বানাবে এই নিয়ে শুরু হয় ঝগড়া। সে বলে, আমি আগেই তো ভালো ছিলাম। প্লিজ ভাইয়েরা, এরকম ঝগড়া করবেন না।

হালাল-হারামের প্রথম মূলনীতি হলো, আল আসলু ফিল আসিয়াহি আল-ইবাহা। অর্থাৎ, মৌলিকভাবে সবকিছু হালাল। পৃথিবীতে আমরা যা দেখি, খাবারদাবার, মৌলিকভাবে সবকিছু হালাল। অল্পকিছু হারাম। যদি এমন হতো, পৃথিবীতে যা আছে সবই হারাম, অল্প কিছু হালাল, তাহলে চিন্তা করুন কী অবস্থা হতো!

কোনো কিছুকে হালাল সাব্যস্ত করতে দলিল লাগে না, কিন্তু হারাম বলতে দলিল লাগবে। বিশ্বনবি একবার তাঁর স্ত্রীদের সাথে কথা বলতে গিয়ে তাঁদের সন্তুষ্টির জন্য মধুকে নিজের জন্য ‘হারাম’ ঘোষণা করেন। (সহীহ বুখারী: ৫২৬৭)। যার ফলে আল্লাহ রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর কিছুটা অসন্তোষ হলেন। এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহ কুরআনে একটি আয়াত নাযিল করেন। “হে নবি, আল্লাহ তোমার জন্য যা হালাল করেছেন, তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি কামনায় তুমি কেন তা হারাম করছো?” (সূরা আত-তাহরীম: ১)

সুতরাং, কোনো কিছুকে হারাম প্রমাণ করতে হলে অকাট্য দলিল লাগবে। আল্লাহ আমাদেরকে ‘সবকিছু’ হালাল করে দিয়েছেন। এজন্য হারাম-হারামের জিকির না করে এখন থেকে হালাল-হালালের যিকির শুরু করতে হবে। কফি খাওয়াকে এক সময় হারাম ঘোষণা করা হয়েছিল, ইংরেজি শিক্ষাকে একসময় হারাম ঘোষণা করা হয়েছিল। সময়ের বিবর্তনে এগুলো এখন হালাল।

একবার এক লোক বিশ্বনবির কাছে এসে বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, গোশত খেলে আমার যৌন উত্তেজনা বেড়ে যায়। এজন্য আমি নিজের জন্য গোশত খাওয়া ‘হারাম’ করেছি। (জামে আত-তিরমিজি: ৩০৫৪) লোকটি হালাল জিনিসকে হারাম করার প্রেক্ষিতে আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন। “হে মুমিনগণ, আল্লাহ যেসব উৎকৃষ্ট বস্তু তোমাদের জন্য হালাল করেছেন, সেগুলোকে তোমরা হারাম করো না।” (সূরা মায়িদাহ: ৫:৮৭)

সুতরাং, যেকোনো জিনিসের দলিল পাবার আগপর্যন্ত এটাকে আমরা ‘হারাম’ বলতে পারবো না।

দ্বিতীয় মূলনীতি হচ্ছে, হালাল হলো আনলিমিটেড আর হারাম হলো লিমিটেড। হারাম সসীম আর হালাল অসীম। আল্লাহ কুরআনের যত জায়গায় হালালের ঘোষণা দিয়েছেন, ব্যাপকভাবে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, “তোমাদের গৃহপালিত (সকল) পশু হালাল, শুধুমাত্র যেগুলোকে হারাম করা হয়েছে সেগুলো ছাড়া।” (সূরা মায়িদাহ: ১) সাগরের বেলায়ও একই কথা। সাগরের যত প্রাণী আছে সব হালাল, অল্প কয়েকটা ছাড়া। (সূরা মায়িদাহ: ৯৬)

তারমানে যখনই আল্লাহ হালালের ঘোষণা দেন, ব্যাপকভাবে দেন। আর যখনই আল্লাহ তা’আলা হারামের ঘোষণা দেন, গুণে গুণে দেন। যেমন: রক্ত খাওয়া হারাম, মরা প্রাণী খাওয়া হারাম, শুকর খাওয়া হারাম, আল্লাহর নাম ছাড়া অন্য নামে জবাই দেয়া হয়েছে এমন প্রাণী খাওয়া হারাম, শিংয়ের গুঁতো খেয়ে যে প্রাণী মারা গেছে সেটা খাওয়া হারাম। (সূরা মায়িদাহ: ১)। এরকম গুণে গুণে অল্প কয়েকটা জিনিস হারাম করা হয়েছে।

আবার যদি জিজ্ঞেস করা হয় ,কাদেরকে বিয়ে করতে পারবো? (মুসলিম) সবাইকে বিয়ে করতে পারবেন। বাংলাদেশের মেয়েদেরকে বিয়ে করা হালাল, ভারতের মেয়েদেরকে বিয়ে করা হালাল, পাকিস্তানের মেয়েদেরকে বিয়ে করা হালাল, অ্যামেরিকার মেয়েদেরকে বিয়ে করা হালাল, সিলেটের মেয়েদেরকে বিয়ে করা হালাল, চট্টগ্রামের মেয়েদেরকে বিয়ে করা হালাল, ঢাকার মেয়েদেরকে বিয়ে করা হালাল। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করেন, কাকে কাকে বিয়ে করা হারাম? তখন আল্লাহ গুণে গুণে চৌদ্দ জনের নাম বলে দিলেন। (সূরা নিসা: ২৩)

ইসলাম কত সহজ! দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া ফরজ। দাঁড়াতে পারছেন না, বসে নামাজ পড়ুন। পানি দিয়ে অজু করে নামাজ পড়া ফরজ। পানি নাই, অসুস্থ, পানি ছাড়া তায়াম্মুম করে নামাজ পড়ুন। বিয়েতে মোহরানা দেয়া ফরজ। কিন্তু মোহরানা দেবার সামর্থ্য নাই। কী করবেন? এক লোক রাসূলের (সা.) কাছে গেল বিয়ে করার জন্য। রাসূল (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মোহরানা দেবার সামর্থ্য আছে? লোকটি বললো, না। শেষমেশ তার কুরআনের কিছু অংশের মুখস্তকে মোহরানা ধরে বিয়ে দেয়া হলো (সহীহ বুখারী: ৫০২৯)

তৃতীয় মূলনীতি হলো, ইসলাম যখনই একটা কাজকে হারাম ঘোষণা দিয়েছে, সাথে সাথে একটা বিকল্পও বলে দিয়েছে। আমি বলে দিলাম, এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, এমনটা হবে না। কোনটা করা যাবে না বলে দেবার পাশাপাশি কোনটা করা যাবে সেটাও আমাকে বলে দিতে হবে। ইসলাম আমাদেরকে ঘোষণা দিয়েছে সুদ খাওয়া হারাম। বিপরীতে ঘোষণা দিয়েছে ব্যবসা করা হালাল। আল্লাহ বলেন, আল্লাহ বেচাকেনা হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। (সূরা বাকারা: ২৭৫)

ইসলাম বলেছে, তোমরা যিনার নিকটবর্তী হয়ো না। নিশ্চয় তা অশ্লীল এবং মন্দ পথ। (সূরা ইসরা: ৩২)। তাহলে আমরা যৌন চাহিদা মিটাবো কিভাবে? ইসলাম বলে, আমি যিনাকে হারাম করেছি, বিয়েকে তো হারাম করিনি। বিশ্বনবি বলেন, “বিয়ে আমার সুন্নাত। যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত মেনে চললো না, সে আমার দলভুক্ত নয়।” (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৮৪৬)

বিয়েকে সহজ করে দিন, আল্লাহ বরকত দিবেন। আমাদের দেশে বিয়ে করা সহজ না কঠিন? কঠিন। বিয়েতে গাড়ি লাগবে, বাড়ি লাগবে, চাকরি লাগবে আরো কতো কিছু লাগবে। মেয়ের বাবারা, ছেলের বাবারা, প্লিজ বিয়েকে আপনারা সহজ করে দিন। যে সমাজে বিয়ে করা কঠিন হবে, সেই সমাজে যিনা ছড়িয়ে যাবে। যে সমাজে বিয়ে করা সহজ হবে, সেই সমাজে যিনা বন্ধ হয়ে যাবে।

বিয়ে হলো জান্নাতি সম্পর্ক। সাইয়্যিদিনা আদম (আলাইহিস সালাম) আর হাওয়াকে (আলাইহাস সালাম) বিয়ে পড়িয়েছিলেন কে? আল্লাহ। উনাদের কোনো শৈশব ছিল না, কোনো কৈশোর ছিল না, যৌবন দিয়েই শুরু। আল্লাহ মদকে হারাম ঘোষণা করেন। (সূরা মায়িদাহ: ৯০)। কিন্তু আমরা বললাম, ‘ও আল্লাহ, শীতপ্রধান দেশে তো শরীর উষ্ণ রাখার জন্য মদ খেতে হবে। এখন মদ হারাম হলে আমরা তো ঠাণ্ডায় মারা যাবো’। আল্লাহ মদ হারাম করলেও শরীর উষ্ণ রাখার একটা বিকল্প ব্যবস্থা রেখে দিয়েছেন। মদ হারাম করেছেন, কিন্তু মধুকে হালাল রেখেছেন।

আল্লাহ মিউজিককে হারাম করেছেন, নাচানাচিকে হারাম করেছেন, ঢোল-তবলাকে হারাম করেছেন। তাহলে আমরা বিনোদন করবো কী দিয়ে? আল্লাহ একমুখের দফকে হালাল রেখেছেন। সাহাবিদের বিয়ের দিন ছোটোছোটো মেয়েরা দফ বাজিয়ে বদরের শহিদদের স্মরণ করতেন। (সহীহ বুখারী: ৪০০১)

ইসলাম কী সুন্দর চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স করেছে। ভারসাম্য রেখেছে। একটাকে হারাম করছে, তো বিকল্প একটা রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছে।

চতুর্থ মূলনীতি হলো, ইসলাম যে জিনিসকে হারাম করেছে, তার পেছনে যুক্তি আছে। তিনটি কারণ থাকায় ইসলাম কোনো জিনিসকে হারাম ঘোষণা করে।

এক. অপবিত্র। যেমন— পেশাব-পায়খানা, গরুর গোবর-মূত্র। এগুলো খাওয়া যাবে না।
দুই. ক্ষতিকর। যেমন— ইয়াবা খাওয়া, মদ খাওয়া, সিগারেট খাওয়া এগুলো ক্ষতিকর। সিগারেটই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র খাবার যার কাভারে বদনাম লেখা থাকে, ধূমপানে ক্যান্সার হয়, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তবুও মানুষ সেটা খায়। একটা বিস্কুটের প্যাকেটে যদি লেখা থাকে, ‘এই বিস্কুট যে খাবে তার ডায়েরিয়া হবে’ তাহলে কি কেউ বিস্কুটটি খাবে? দোকানদারকে বলবেন, রাখ তোর বিস্কুট।
তিন. সেটার মধ্যে অশ্লীলতা আছে। যেমন— পর্ণোগ্রাফি দেখা হারাম।
পৃথিবীতে যতো জিনিসকে আল্লাহ ‘হারাম’ ঘোষণা করেছেন, খুঁজে দেখুন সেগুলোর মধ্যে এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের অন্তত একটি আছে।

পঞ্চম মুলনীতি হলো, হারামের সূচনা করাও হারাম। একজন বেগানা নারীর দিকে তাকিয়ে থাকাটা হারাম। হারাম শুরু হয় এভাবেই। প্রথমে তাকানো, তারপর মুচকি হাসি বিনিময়, তারপর মোবাইল নাম্বার আদানপ্রদান হয়, ফেসবুকের আইডি আদানপ্রদান হয়, চ্যাটিং শুরু হয়। হারামের ধাপগুলো আস্তে আস্তে চলতে থাকে। চোখের যিনা, হাতের যিনা, মুখের যিনা, পায়ের যিনা থেকে শেষে এসে ধর্ষণ। এজন্য ইসলাম একটা হারামকে সমূলেই কেটে দিয়েছে। আল্লাহ প্রথমে পুরুষদের এবং পরে নারীদেরকে বলেন, দৃষ্টি সংযত রাখতে। (সূরা নূর: ৩০-৩১)

কিন্তু তারপরও যদি চোখ পড়ে যায়? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আলীকে (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “প্রথমবার চোখ পড়লে চোখ সরিয়ে নিও। আল্লাহ প্রথমবারের জন্য ক্ষমা করে নিবেন কিন্তু দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমা করবেন না। (জামে আত-তিরমিজি: ২৭০১)

ষষ্ঠ মূলনীতি হলো, হারাম খাওয়ার জন্য কৌশল করাও হারাম। হারামকে হালাল বানিয়ে খাওয়াও হারাম। ঘুষকে যদি ‘বখশিস’, ‘চা-নাস্তার খরচ’ কিংবা ‘উপহার’ নাম দিয়ে খান, তাহলে ঘুষ হালাল হয়ে যাবে না। যিনাকে ‘রুমডেট’, চোখের যিনাকে ‘ক্রাশ’, মদকে ‘ড্রিংকস’ নামে খেলে সেগুলো হালাল হয়ে যাবে না। বিশ্বনবি বলেন, “আমার উম্মতের কিছু লোক মদ পান করবে এবং একে তারা ভিন্ন নামে ডাকবে। (সুনানে আবু দাউদ: ৩৬৮৮)

সুতরাং, আজকের আলোচনা থেকে আমরা বুঝলাম, কোনটা হালাল আর কোনটা হারাম। আমরা এখন থেকে হালাল দিয়ে জীবনটা সাজাবো। হালাল দিয়ে জীবন সাজালে জীবনে বরকত ঢেলে দিবেন কে? আল্লাহ।

ওয়াজটি মিজানুর রহমান আজহারী কসবার কালিয়ারায় করেন। ভিডিও লিংক https://bit.ly/2x4ykUK ওয়াজটির শ্রুতিলিখন ও রেফারেন্স সংযুক্ত করেছেন আরিফুল ইসলাম