মিছিল খন্দকারের ৬ কবিতা

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৯, ২০২০

আ-মরি কবিতা

কী যে সমীরণ, বাঁকা বায়ু বয়, আহা!
যাহাই কুহেলী, কুয়াশাও নাকি তাহা!

সতত সে তপে; ভ্রান্তি-ছলনে ফেলে
যেন মোরা কোনো সাগরদাঁড়ির ছেলে!

আজি শ্যাম হিয়া উথলি পরানে মেশে
জোড়াসাঁকো থেকে বজরা এসেছে ভেসে?

রণে যবে মম ক্লান্ত বাঁশরি দেখো,
একা পড়ে আছি আসানসোলের সাঁকো।

ঢের দিন হায় কাটিয়ে চিলের দলে
হয়তো মরব যে কোনো ট্রামের তলে!

সম্মুখে হেরি মাস্তুলে পাঞ্জেরি—
শীতে-কুয়াশায় নোঙরে রয়েছে ফেরি।

নাঙা পদধ্বনি, দিগন্তে চলে উট—
ধ্বস্ত নীলিমা লিখে গেছে চিরকুট।

ওদিকে আয়শা মক্তব থেকে ফেরে
চুল খোলা রোদে ঘাঁই মারে মাছ ঘেড়ে।

যে স্মিত দৃশ্যে রক্তিম হলে ফল,
রসালো ভুট্টা— বসে পড়ে চঞ্চল।

দুপুর নীরবে তাকায় হালিক টোনে
‘নাও, মেগ খাও’, বলে কালিদাস ফোনে।

আমি কিনা সব খুঁটিয়ে খাওয়ার কূলে—
প্যারাশুট তেল মাখি কুন্তলে-চুলে।

শালবনের ভেতরে একা

সন্ধ্যার মন্থর আলো নদীতে ভাসতে থাকবে। ক্রমে এ মানবশরীর রূপান্তরিত হবে রাতে। মিশে যাবে চেনা কুয়াশায়। দূর থেকে বাসের গর্জন শোনা যাবে। যেন কাছেই লোকালয়। হাইওয়ে। অথচ মনে হবে পৃথিবী তো চিরকাল জনহীন ছিল। দৌড়ে চলা গাড়ির ধাতব ইঞ্জিন যে শব্দ করে, বনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তা পাবে অরণ্যস্বভাব, যেন শিকারকে লক্ষ্য করে ছুটে যাওয়ার কালে কোনো অদেখা পশুর কেশর বেজে চলছে বাতাসে। এসবের মধ্যে বসে কিছুটা ভয় আর তন্দ্রাভাব নিয়ে নিজের ভেতরে তাকিয়ে বলব, চাই। বৃষ্টি নেমে আসবে সহসাই!

আমি যে তখন কাকে

একদিন সকল সন্তাপের ঝুলকালি-মাখা-মুখে বেরিয়ে পড়বো, না ফেরার ইচ্ছা গোপন করে। কিছুদূর গেলে মনে হবে, যে কোনো যাওয়াই মূলত ফেলে যাওয়ার বেদনাবোধ বহন করে সাথে।

পথে সন্ধ্যা আসবে রাতের পূর্বাভাস নিয়ে। কোনো নামহীন নদীর পাড়ে, ঝাউ বা কেওড়ার বনে আবহমান জোনাকিরা একই রকমভাবে জ্বলবে নিভবে জ্বলবে নিভবে জ্বলবে।

চারপাশের শব্দহীনতায় অস্থিরতা আরও চাপা হয়ে অস্থির হয়ে ধরা দেবে। বৃষ্টি আসবে ধেয়ে, চরাচর শূন্য শূন্য শূন্য করে দিয়ে। বর্ষার চাঞ্চল্যে পাশের পুকুরে, কোলায়, নদীতে পানির ফূর্তি দেখে দেখে দেখে— আমি যে তখন কাকে ঘুম থেকে তুলতে চাইবো গিয়ে ডেকে!

আয়নার সাধ

কী যে খাঁ খাঁ লাগে, আঁকাবাঁকা লাগে খালি
ধরণী আমার মুখে মেখে দেয় কালি।

পথে পথে কারা বিছিয়ে রেখেছে নুড়ি!
বুক থেকে গেছে পাঁজরের হাড় চুরি।

আকাশে ছুটছে কাফনের যত থান—
মরা মানুষেরা ফিরে পেতে চায় প্রাণ।

জীবিতেরা দেয় পাহাড়ের থেকে ঝাঁপ
গরুরা দিচ্ছে শকুনেরে অভিশাপ

ফলে তারা কিনা বিলুপ্ত প্রায় আজ,
বাজারের থেকে মাছরাঙা কেনে মাছ।

শেয়াল পাচ্ছে মুরগীকে নাকি ভয়—
সন্ধ্যা করছে সকালের অভিনয়!

রাত থেকে যত শীৎকার ছুটে এসে
অবদমিতেরে বিষাদে ধরছে ঠেসে।

কোথা থেকে ফলে উঠে আসে হাহাকার
নিজেকে দেখবে সাধ জাগে আয়নার।

বায়বীয় ছায়া

আমাদের বাগানের স্কুলে
যে সব সুদর্শন গাছ
দুই যুগ ধরে
শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত,
পুকুরের আয়নায় তাদের ছায়া
বাতাসে যখন দোল খায়;
অবাক চোখে তাকায় মাছেরা
ছায়ার রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ে।
প্রকৃত অর্থে, গাছকে তখন তারা
বায়বীয় ছায়া মনে করে!

চাই

কাকতাড়ুয়া ভয় পাওয়া পাখিদের
আমার পছন্দ নয়।
তার চেয়ে যে পাখি
তাড়ুয়ার মাথার উপর বসে
ফসলের সাফল্য দেখে
ঘষে খুশি ঠোঁট,
পৃথিবীর ফসলে ভাগ বসায়
তারই সুহৃদ হতে চাই।
কিন্তু সে মানুষ নিকটে গেলে উড়ে যায়।
তার মানে,
মানুষ সম্বন্ধে পাখিদের নেতি ধারণা আছে,
মাছেদেরও তাই।
মাছ ও পাখিরা মানুষকে ধরে নিয়ে
নদীতে ও বনে আটকে রাখুক— এটা আমি চাই।