মাহমুদ দারবিশের পাঁচটি কবিতা
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২১
মাহমুদ দারবিশ ফিলিস্তিনের মানবতাবাদী কবি। তার কবিতার প্রতিটি বর্ণ স্বর্ণছোঁয়া। তিনি ছিলেন প্রতিবাদী কবি। তার বেশিরভাগ কবিতাই ফিলিস্তিনকে ঘিরে আবর্তিত। শুধু ফিলিস্তিন নয়, গোটা আরবজুড়েই তার সুখ্যাতি। তিনি ছিলেন আরবি কবিতার উন্নয়ন প্রতিভূ। তার পাঁচটি কবিতা ইংরেজি থেকে বাঙ্লায়ন করেছেন ফারুক ইমন।
ফিলিস্তিনের একজন প্রেমিক
তার চোখজোড়া ফিলিস্তিন
তার নাম ফিলিস্তিন
তার পোশাক আর তার দুঃখগুলো ফিলিস্তিন
তার মাথায় বাঁধা রুমাল, তার পা জোড়া আর তার শরীর ফিলিস্তিন
তার কথা তার নীরবতা ফিলিস্তিন
তার কণ্ঠ ফিলিস্তিন
তার জন্ম এবং তার মৃত্যু ফিলিস্তিন
জেরুজালেম
একটা প্রাচীন দেয়ালের আড়ালে আমি জেরুজালেমে
হেঁটে যাই যুগ যুগ ধরে কোনও
স্মৃতি ছাড়াই। যেখানে মহাপুরুরষেরা তাদের
পবিত্র স্মৃতি নিয়ে বিরাজ করেন... বেহেশতের সিঁড়ি বেঁয়ে
অন্ধকার ও হতাশা মিলিয়ে গিয়েছে, কারণ প্রেম
এবং প্রণয়ই পবিত্র এবং তারা আসছে শহরজুড়ে।
আমি নিজের চিন্তার ঢাল ধরে হেঁটে যাই... ভাবি,
সেই মানুষেরা কীভাবে বলেছিলেন সরল কিন্তু পাঁথরের মতো ভারি কথাগুলো?
এটা কী সেরকম এক পাঁথর, যাতে যুদ্ধের দামামা জেগে ওঠে?
আমি আমার ঘুমের ভেতর হাঁটি। আমি ঘুমের মধ্যে তাকিয়ে থাকি। দেখি,
পারাপার জুড়ে কোথাও কেউ নেই।
সকল গন্তব্য আমার জন্যই। আমি হাঁটি। আমি আলোকবর্তিকা হই। আমি ভেসে
বেড়াই অন্যরূপে। বহুরূপে প্রকাশিত হই। শব্দগুলো
অঙ্কুরিত হয় ঘাসের মতো, যেন নবি ঈশার বার্তাবাহকের থেকে আসা শব্দ,
‘তুমি বিশ্বাস করতে চাও না, তাই তুমি বিশ্বাস করো না।’
আমি হাঁটি অন্য কেউ হয়ে। আর আমার নিভৃতে একটা ঐশ্বরিক সাদা গোলাপের ক্ষত
এবং আমার হাত দুটো একজোড়া কবুতর হয়ে ক্রুশের ওপর ঝুলে থাকে
অনাদিকাল এই পৃথিবীর ভার বয়ে... আমি তখন হাঁটি না
আমি ভাসি, অন্য কেউ হয়ে, বহুরূপে আমার প্রকাশ ঘটে...
দেশ নেই, কাল নেই। তাহলে কে আমি?
আমি কেউ নই, আমি অনাহূত উপস্থিতিমাত্র।
কিন্তু আমি নিজেকে ভাবি, একা। নবী মুহাম্মদ যে ভাষায় কথা বলতেন
তা আমারই মাতৃভাষা...
‘তুমি আর কি বলবে?’
‘তারপর?’
একজন নারী সৈনিক চিৎকার করে বলল, আবার এসেছো? আমি না তোমাকে হত্যা করলাম?
আমি বললাম, তুমি আমাকে খুন করেছিলে... এবং আমি ভুলে গেছি, তোমার মতো, আমি মৃত্যুকে মনে রাখিনি।
আত্মভিমান ও ক্রোধ
হে আমার জন্মভূমি! হে ঈগল,
শিরা উপশিরা থেঁতলে যাচ্ছে,
তোমাকে জ্বলন্ত দেখে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে!
আমি সমস্ত রকম মৃত্যুর সম্মুখে আজ
জ্বলছি পুড়ছি।
আমার হৃদয়টিকে একটি গাছের মতো রোপণ করে দিও,
যেন আমার কপালে একটা সাদা রঙের পাখি বাসা বাঁধতে পারে।
হে ঈগল,
তোমার সুদৃশ্য ডানার পালক হবার যোগ্য নই আমি,
তাই যেন একটা মুকুটের শোভা হই।
হে আমার জন্মভূমি!
আমরা জন্মেই তোমাকে দেখেছি ক্ষত-বিক্ষত,
তোমার বৃক্ষের ফল খেয়েছি,
সাক্ষী হয়েছি তোমার প্রতিটি সকালের।
হে নিস্তেজ বন্দি ঈগল,
হে আকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হে...
তোমার জ্বলজ্বলে ক্ষত ডুবে আছে আমার চোখের ভেতর।
আমি যেখান থেকে এসেছি
আমি সেখান থেকে এসেছি, যেখানে আমার স্মৃতি আছে
মানব জন্মের, আমার একজন মা আছেন
আছে অনেক জানালাকাটা একটা ঘর,
আছে ভাই, বন্ধু এবং একটা ঠাণ্ডা জানালার কারাকক্ষ।
সমুদ্রচিলের লাঞ্ছনার মতো, আমার নিজস্ব ঢেউ আছে,
আমার আছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি
এবং একান্ত আপনতম ঘাস।
শব্দের নৈঃশব্দ্যের ভেতর একটি চন্দ্র আছে আমার,
অনেক পাখি আছে,
আর আছে চিরন্তন জলপাই গাছগুলো।
এই ভূমিতে আমি হেঁটে গেছি অবিরাম
তরবারির রাজত্বের বহু আগে থেকে।
আমি সেখান থেকে এসেছি, তার জন্য আমি আকশে প্রতিভাত হয়েছি
এক আকাশজুড়ে যখন আকাশ কেঁদে উঠেছে তার মায়ের জন্য
এবং আমি নিজেকে আবিষ্কার করি ফিরে যাওয়া একটা শীতের মতো
আমার জানা শব্দগুলো আমাকে শিখতে হয়েছে রক্তের ওপর পা ফেলে ফেলে
যার কারণে নিয়মভাঙা আমার খেয়ালের অধিক কিছু নয়।
আমি যত শব্দ শিখেছি আর যত শব্দ ভেঙেছি, সবই
শুধু একটিমাত্র শব্দের জন্য, জন্মভূমি...
ওরা আমাকে পরিচয়হীন মনে করে
আবছা অন্ধকার আমার পাসপোর্টের রঙগুলো সব শুষে নেয়
আর যেন বেড়াতে আসা এক পর্যটকের খেয়ালি শখে সংগ্রহে রাখা ফটোগ্রাফের মতো
আমার ক্ষতগুলোকে বাজারে বিকানো পণ্য বানাই।
ওরা আমাকে পরিচয়হীন ভাবে
দ্যাখো... এখনই চলে যেও না
আমার হাতের ওপর কড়া রোদ নেই এখন
কারণ আমি বৃক্ষের তলায় দাঁড়িয়েছি
জ্যোৎস্নাহীন চাঁদের মতো বিবর্ণ আমাকে রেখে, চলে যেও না!
...
যেসব পাখির দল জেনেছিল আমার হাতের তালু
অদূরবর্তী বিমানবন্দরের ফটক
যত শষ্যের মাঠ
বন্দিশালা
সফেদ সমাধির পাথরগুলো
কাঁটাতার ঘেরা সীমান্ত
বাতাসে দুলতে থাকা কারুকাজগুলো
সকল দৃষ্টি
ছিল আমার নিজের,
অথচ আমার পাসপোর্ট থেকে সকল কিছু কারা যেন উধাও করে দিয়েছিল
...
আমার নাম-পরিচয় মুছে দিতে চাও?
যে মাটিতে বেড়ে উঠেছি আশৈশব সেই মাটিতে?
আজ আর্তনাদে
আকাশ কেঁপে ওঠে
আমাকে আরেকবার জাগিও না!
ওহে ভদ্রমহোদয়, ওহে অবতারগণ,
বৃক্ষদের কাছে তাদের নাম জানতে চেয়ো না
জানতে চেয়ো না উপত্যকাদের কাছে তাদের আদি পরিচয়
আমার কপাল থেকে বিচ্ছুরিত হয় আলো, তৈরি হয় তরবারির দীপ্তি
আর আমার হাতের নিচ থেকে প্রবাহিত ঝর্ণার পানি মেশে ওই নদীতে
সকল আত্মায় মিশে আছে আমার পরিচয়
বরঞ্চ তুমি আমার পাসপোর্ট নিয়ে যাও!