‘মাস্কবাদী কবিতা’ পড়তে পড়তে যা মনে এল

মুয়ীন পারভেজ

প্রকাশিত : মার্চ ০৯, ২০২২

হয়তো এভাবে বলা ঠিক না, কিন্তু জীবনের মধ্যগগনে এসে আজ বলতে দ্বিধা নাই যে আমার ক্ষুদ্র বন্ধুবৃত্তে মেরুন হরিয়ালই সবচাইতে বেশি ফু‍র্তিবাজ এবং মানবিক। ভানহীন, কপটতাহীন, দ্বিচারিতাহীন সরল মনের এক মানুষ। শোনা যায়, বিপদে বন্ধুর পরিচয়। তাকে দেখছি, বন্ধুর চরমতম সংকটমুহূর্তে পায়ের সমস্যা নিয়েও কী অপার উৎকণ্ঠায় ছোটাছুটি করতে, কতবার! ভাল্লুকের মুখে অসহায় বন্ধুকে ফেলে সে পালায় না। কবিতায় সে নিজেই যেমন বলছিল, ম্যানগ্রোভ-মনে প্রতিদিন শ্বাসমূল তুলে দিই।

তার সঙ্গে অনেক বিষয়েই মতের মিল হয় না, এমনকী নান্দনিক কাজকারবারেও, কখনও-কখনও। কলেজজীবনে সে ছিল আল মাহমুদের ভক্ত, আমি শামসুর রাহমানের। এ নিয়ে টানাপড়েন হইছে নীরবে অনেকবার, বিচ্ছেদ ঘটে নাই। তো সেসব পোড়খাওয়া দিনে সে আমাদের বাড়িতে এসে ‘মাতাল ঋত্বিক’ নিতে চাইছিল, অভিমানবশত দিই নাই। মনে-মনে হয়তো বলছিলাম, যাও, বখতিয়ারের ঘোড়াকে দানা খাওয়াও গা!

কবিতাচর্চার পাশাপাশি সে বেশকিছু সমালোচনামূলক গদ্য লিখছিল শূন্য দশকে, মূলত বন্ধু সাইদুল ইসলামের তাড়নায়। শ্রীখোকন কায়সারের ‘চোখে চশমা বগলে ইট’ গল্পবইয়ের ঈষৎবঙ্কিম সমালোচনা লিখে সে যেন ভেজা সলতেতে আগুন ধরাইয়া দিল। পরে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে খোকন ভাই মৃদু হেসে শুধু যে-শব্দবন্ধটি উচ্চারণ করছিলেন তা ছিল অনেকদিন চেরাগির মুখরোচক আড্ডার বিষয়। জীবনের রূপমাধুর্য ও রহস্য বুঝতে চাওয়ার রসিকজনোচিত চিরবাসনা এবং সমাজের খুঁত বা অসংগতির দিকে নিঃশব্দ শর ছুড়ে দেওয়ার একলব্যীয় প্রবণতা আছে মেরুনের, ফলে তার আশ্রয় হইয়া ওঠে অপ্রতিরোধ্যভাবে শ্লেষ, বক্রোক্তি এবং প্রায়শ বৃত্তানুপ্রাস—কবিতাবইয়ের নামের মধ্যেও তো সে গুঁজাইয়া রাখছে শ্লেষাভাস। এর মানে অবশ্য এই না যে, তার কবিতা শব্দক্রীড়াপরায়ণ, বরং সে স’রে গেছে নিরাভরণ স্বরের দিকেই, বারেবারে:

কিছু-কিছু শব্দ আছে যাদের উচ্চারণের সাথে-সাথে
আমি বেবুনান্তরিত হতে থাকি
এই তো সেদিন একটি উচ্চারণে
কালো বেবুন হয়ে ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়েছি।
যেদিন এমন কিছু ঘটে সেদিন আমার
কেমন যেন লাগে!
মানিব্যাগ ফেলে আসি বাসায়
ফুটপাথে হাঁটতে গেল রাস্তার গর্তে
নেমে পড়তে চাই
কিংবা মাছের বাজারে শুয়ে পড়তে চাই।
আমি বেবুনদশা থেকে মুক্তির জন্য
প্রতি পাল্‌সে মূল্যহ্রাস-এর বিশাল সাইনবোর্ডের কাছে
প্রা‍র্থনা করতে করতে ভূমিসাৎ হয়ে যাই!

আকৈশোর আঁকাআঁকিতে আসক্ত মেরুন, এই আসক্তি তাকে নিয়ে গেছে গ্রাফিক্স ডিজাইনের জটিলরঙিন জগতে। একবার, মনে পড়তেছে, আমরা দুজন গোসল করতে গেছি খালে, আমাদের বাড়ির পাশে; খালপাড়ের গোধূলিরঙা নরম এঁটেল মাটিতে সে তর্জনী দিয়ে আঁকতেছিল ছবি। পরব‍‍র্তীকালে চান্দগাঁওয়ের যে-ছোট বেড়ার ঘরটিতে থাকত, যেখানে বর্ষাকালে বানের পানি খাটের পায়া জড়াইয়া রাখত আর আমরা হইতাম দ্বীপের গাছ, সেখানেও সে একই খাতায় আঁকত ছবি লিখত কবিতা, এবং লুকাইয়া রাখত লোকচক্ষুর আড়ালে। জীবনানন্দীয় লাজুকতা ছিল তার। বহু কষ্টে যে-কবিতাটি ছিনাইয়া নিতে পারছিলাম, সেখানে কাটাকুটির ঝোপে মৃদু জোনাকির মতো জ্বলতেছিল:

তোমায় দেখি সকালবেলা
যখন তুমি লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে যাও
দুপুরবেলা, যখন তুমি ফিরে আসো
আমি তখন কম্পুটারে মাউস চাপি
মাউস ছেড়ে ফিরি যখন
তখন তুমি দুপুরঘুমে।
দেখি তোমার ভেজাশাড়ি
আমার হৃদয় হয়ে দুলছে
মৃদু হাওয়ায়
চিলেকোঠায়।

শহরের দগ্ধ চিলেকোঠা থেকে ঢেউভেজা কক্সবাজার—মেরুনের ‘ম্যানগ্রোভ-মন’ সদাপ্রসারিত। ওর মতো যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানোর বাই আর কারও আছে কি না জানি না। ওকে যদি মজা ক’রেও বলি, ‘চলো, কুয়াকাটা যাই’, সে তন্মুহূর্তে তৈরি! মানে ভাবখানা এমন: ‘একটু খাড়াও, জামাটা বদলাইয়া নিই!’ এখনও কোথাও যাওয়ার কথা ভাবলে মনে আসে তার কবিতার নাম: ‘চুলটা লম্বা করছি: কক্সবাজার যাব’। সেলুনে চুল ছাঁটাইতে গেলে ভাবি, আমার না চুল লম্বা রাখার কথা! এই ইটপাথরের শহরের ধুলোবালি ছেড়ে আমার না কক্সবাজার যাওয়া দরকার অন্তত আরেকবার! আমার না আবরাহার উদ্দেশে বলা দরকার এই কথাগুলো, যেমন বলছে মেরুন!

এমনকী ভেজাল নিশ্বাস নিতে নিতে
বুকে তলপেটে জ’মে যাচ্ছে পাথর
আবরাহা, তুমি হস্তিযূথ নিয়ে
এখনও রওনা দিলে না?
তোমার দিকে ছুড়ে না দিলে যে বাঁচব না!

মাস্কবাদী কবিতা
মেরুন হরিয়াল
প্রচ্ছদ: খালিদ আহসান
প্রকাশক: বেঙ্গমা
প্রকাশকাল: মা‍র্চ ২০২২
মূল্য: ১৩০ টাকা (বিশেষ ছাড়ে ১০০ টাকা)
প্রাপ্তিস্থান: চট্টগ্রাম বইমেলায় ‘বলাকা’ ও ‘তৃতীয় চোখ’-এর স্টলে

একুশে বইমেলা ২০১৮