মাসুদ পথিক

মাসুদ পথিক

মাসুদ পথিকের তিনটে কবিতা

প্রকাশিত : মে ৩০, ২০২২

রেপিস্ট ধান ও ডুমুর হেজিমনি

আর আমাকে ডুমুরের সঙ্গেই থাকতে হয়
আমাদের মধ্যে একলা হয়ে যাওয়া পাখিরা এসে বসে

ডুমুর ও পাখির মধ্যবিন্দুতে তৈরি হয় দাম্পত্যের ভাষা
যদিও মাঠের সব ধানক্ষেতেরা জানে না তার ব্যাকরণ

তো, আমি ডুমুরের ক্রিয়া ও অব্যয় নিয়ে খেলা করি
সূর্য পড়ে এলে রাত অবধারিত
শীৎকারও বেড়ে যায় খেলায়
ফলে পাখিরা হাততালি দেয়

পাখিরাও ক্লান্ত হলে আমাদের সঙ্গে শুয়ে থাকে
আমরা পাখিদের সঙ্গে থাকি না
কেননা পাখি মানুষ আমরা মানুষ না

তবুও, আমাকে ডুমুরের সঙ্গেই থাকতে
ডুমুর আমার সঙ্গে থাকে কিনা জানি না

তবে ইদানীং ধানের সমাজেও একসঙ্গে থাকাথাকি নিয়ে
ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে আন্দোলন হয়

রেপিস্ট প্রেমিকেরা গান গায় ভালোবাসার
তখন ইউক্রেন-রাশিয়ার অমীমাংসিত সীমান্তে
সত্যিকারের চাষির মৃত্যু হয়

আমি ও ডুমুর লিভইন উপায়ে ক্ষেতের শিশির ভেজা আলে
গ্রামীণ সভ্যতার জন্ম দিই, দেন
সভ্যতা তার যৌনসঙ্গীর সঙ্গে চলে যেতে যেতে বলে,
তোমরা রেপিস্ট বাবা-মা

ইনবক্সে ইনবক্সে পড়ে থাকে আমাদের লাশ
দুর্গন্ধ ছড়ায় সমস্ত ভার্চুয়ালে
চাষ করতে আসা চাষিরা নাকটিপে ধরে
পাখিরা দূরে দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়

মুখরিত হয় স্লোগানে স্লোগানে, রেপিস্ট ধানের বিচার চাই
বিচার চাই বিচার চাই

বনলতা ২

দ্বিতীয়বার দেখা হলে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কি?
সে বললো, বনলতা
আমি আমার বুকের বাঁদিকের অরণ্য দেখিয়ে বললাম, বসতি গড়তে পারো
ক্লেদাক্ত শহর ঘুরে ঘুরে ঘেমে উঠলে যে!
মেয়েটি লজ্জা পেল

আমি বললাম, আমার ডান বুকে নিভৃত নদীও আছে এক, তুমি চাইলে চান করে নিতে পারো
কিন্তু সে আমার দিকে তাকাতে পারলো না
সে হাঁটতে শুরু করলো, আমি তার পিছু নিলাম

পিছু নিলাম পিছু নিলাম

রোকেয়া হলের গেইটের কাছে গিয়ে হঠাৎ ফিরে তাকিয়ে বললো, আর কিছু বললেন?

আমি থতমত খেয়ে তার চোখে না-তাকিয়ে আমার ডান বুকের নদী থেকে একটি কচুরিপানা ফুল বাড়িয়ে দিলাম
সে নিলো, এবং হলের ভেতরে যেতে যেতে বললো, আমি তো সাঁতার জানি না, তবুও
আমি বললাম, তবুও কি?

সে বললো, একদিন ঝাঁপ দেব, যদি বেঁচে যাই তবে আপনার অরণ্যের গভীরে কুঁড়েঘর বাঁধবো
জায়গা দেবেন তো?

নিশ্চয়, নিশ্চয়, এ তো তোমার জন্যই তৈরি করেছি এক কোটি বছর ধরে
মেয়েটি দিলো স্নিগ্ধ হাসি

আমি ফিরে আসতে আসতে মধুর কেন্টিনে এসে হারিয়ে ফেললাম স্বপ্নটা
কেননা একটা নারী নির্যাতনবিরোধী মিছিলে প্রকম্পিত হচ্ছে ক্যাম্পাস

আমি মিশে গেলাম শ্লোগানে, শ্লোগানের ধ্বনিতে পৃথিবীর কোনো কোমল শব্দ শোনা গেল না আর

দেন, একদিন কিছু বন্ধু দেখলো ভাষাবিজ্ঞানের ক্লাসে আমি বনলতা ধান বুনছি
সবাই খুব হাসলো এই আজব ধান চাষ দেখে
কিন্তু আমি জানি, একদিন বন্ধুদের পাঠ্যবই ভরে উঠবে সুফলা ধানগাছে, বনলতা ধান!

তারপর ক্লাসরুম লাগোয়া আনমনা নদীরটির স্রোতে, আমি যেন ভেসে চললাম অনন্তের দিকে
আর, আর কোনোদিন তীরে উঠতে পারলাম না, পারলাম না

বনলতা কি কোনোদিন এই নদীর তীরে এসে দাঁড়াবে?
ফেলবে  দু`এক ফোঁটা অশ্রু?

২.
মায়া দিলে মায়া পাবে, আর হৃদয়ের কাঁদা মাটি;
বিলের বিরল মাছ, জলের আদর, পাবে প্রেম খাঁটি।

আর কোনোদিন দেখা হবে না বাবা ও সন্তানের সঙ্গে

চায়ের কাপে নদীকে ডুবিয়ে পান করছি
নদী খুব কাঁদছে।

ঠিকানা হারাতে হারাতে পৌঁছেছি ফুটপাতের এই চা স্টলে
বয়ামে বয়ামে সাজানো নদী ভাঙনের কবলে পড়া সব কৃষি জমি।

গ্রামবাসী জানে আমিই সে পালাতক
দাদন ব্যবসায়ী আমাকে খুঁজছে
আমি সে পিতা, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ চাষা
বসত ভিটায় এখন অন্যের গরু চড়ে

আশ্রয়ের খোঁজে আসা ফিঙে পাখি বাবা ও সন্তানের কবরের ওপর
জিগাগাছের ডালে বসে খুঁটে খায় কবরের নির্জনতা
ব্যর্থদের ফেরার পথ থাকে না শূন্যতা ছাড়া, আর
বেওয়ারিশ হিসাবেই মানানসই এইসব সর্বহারা।

কবরও পায় না স্রোতে ভেসে যাওয়া অনুভূতির শব
কোনো বন্দরও পায় না বাস্তবতার এই জলযানগুলি।

ফুটপাতে দাঁড়িয়েই প্রাণান্তকর খুঁড়ি নিজের কবর
ঘামে ভিজে ভিজে কেবল আবার ভাবি, আর কোনোদিন দেখা হবে না
কোনোদিন দেখা হবে না মৃত বাবা ও সন্তানের সঙ্গে, যারা ঘুমিয়ে আছে
গ্রামের পরিত্যক্ত গোরস্তানে!

চায়ের কাপেই বয়ে বয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর শেষ নদী আর সর্বহারা ঢেউগুলি
গন্তব্যহীন জীবন আর কতদূর যেতে পারে?

শরীরের ঘামের তীব্র নদী ধরে তীরে উঠে আসি সাঁতরে
রিকশার প্যাডেল মেরেই চলি অচিহ্নিত সমাধি অবধি...