মালিক নতজানু, সার্ভেন্ট বসে থাকে রাজার মতো
জগলুল আসাদপ্রকাশিত : মার্চ ১৬, ২০২০
যারা বিসিএস দিয়ে কোনো না কোনো ক্যাডারে আছেন, তারা ছাড়া বেশির ভাগ মানুষই বিসিএস বলতে বোঝে প্রধানত ম্যাজিস্ট্রেট, অর্থাৎ প্রশাসন ক্যাডার বা এএসপি অর্থাৎ পুলিশ ক্যাডারকে। অন্যান্য ক্যাডার সম্পর্কে আমাদের বিদ্বজ্জন মহলেও নিদারুণ অজ্ঞতা বিরাজ করে। এমনকি যারা রাষ্ট্র, সমাজ বা রাজনীতি নিয়ে ভাবেন তারাও অবগত নন রাষ্ট্রের বিবিধ প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে চলে, তারা কী কাজ করে। এবং এই সব প্রতিষ্ঠানে জনগণের অধিকারের কী কী বিষয় আছে সে সম্পর্কেও বেশির ভাগ মানুষ অনবহিত। অনেকেই রাষ্ট্রের বা ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করে হাওয়াইভাবে, মূর্ত আমলাতন্ত্রকে প্রশ্ন করা ও পর্যালোচনা বাদ দিয়ে।
যাই হোক, ক্ষমতা ও দায়িত্বের দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী যে ক্যাডার তার নাম প্রশাসন ক্যাডার। যাকে প্রচলিতভাবে আমলাতন্ত্রও বলা হয়। আধুনিক রাষ্ট্রকে বুঝতে হলে আমলান্ত্রকে বা bureaucracy কে বুঝতে হবে। আমলাতন্ত্রকে না বুঝলে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে রাজনীতি চলে, সেটা বোঝা যাবে না। অনেক রাজনৈতিক সমস্যাই আসলে আমলাতান্ত্রিক সমস্যা। এই যে যাকে আমরা সরকার বলি বা সরকারি সিদ্ধান্ত বলি, তা আসলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমলাতন্ত্র বা আমলাতন্ত্রের মাধমেই জারি হয়। ধরা যাক, স্থানীয় পর্যায়ে ডিসি বা ইউএনও যখন কোনো নির্দেশ জারি করে, সেটা সরকারি সিদ্ধান্ত হিসেবেই প্রচারিত হয়। অন্যান্য ক্যাডারের এই ক্ষমতাটুকু নাই, অন্যরা সরকারের স্পোক্সম্যান নয়।
সরকারি চাকরির সর্বোচ্চ পদ হচ্ছে, সচিব। এদের মধ্যে ক্রমসোপানের সর্বোচ্চে আছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। প্রশাসনের যে পদসোপান এটার সাপেক্ষেই আধুনিক রাষ্ট্রীয় অন্যান্য পদগুলোকে তুলনা করা হয়। যেমন, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আমলাতন্ত্রের সচিব পদের ইমিডয়েট যিনি নিচে আছেন অর্থাৎ এডিশনাল সেক্রেটারি তার সাথে তুলনীয়। সুতরাং শিক্ষা সচিবকে ভিসি স্যার স্যার বলেন। সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ তিনি উপসচিবের সমতুল্য। ডিসিও একজন উপসচিব। কিন্তু একজন অধ্যক্ষও ডিসির শান-শাওকাত ও কর্মব্যপ্তি বিবেচনায় তার সামনে দীন-হীন থাকেন, বিরল ব্যতিক্রম বাদে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিকরা ডিসিকে তোয়াজ করেই চলে। সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন তো নিতে হয় জেলা প্রশাসনের কার্যালয় থেকে, জেলার আইন শৃংখলা পরিস্থিতির নজরদারি, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে শাস্তি দেয়ার কাজগুলো প্রশাসন ক্যাডার করে বলে তাদের মন জুগিয়ে চলে নেতারা তো বটেই, জনগণও। জনকল্যাণ, পাবলিক পরীক্ষা, জমিজমা সংক্রান্ত বহুবিধ কাজের দায়িত্ব ন্যস্ত করা থাকে জেলা ও উপজেলা পরিষদের বিবিধ দপ্তরে। সংবিধান অনুসারে তারা গণসেবক বা সিভিল সার্ভেন্ট হলেও জনগণই তাদেরকে মাস্টার ভাবে আর নিজেদেরকে ভাবে সার্ভেন্ট। যদিও জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উল্টোটি হওয়ার কথা ছিল। আইন ও বিধি প্রণয়নের কাজ এরা করে বলে রাজনীতিবিদগণও ধরা থাকেন তাদের হাতে। মন্ত্রণালয় পরিচালনায় মন্ত্রীও নির্ভরশীল থাকেন আমলাতন্ত্রের উপর প্রায় সর্বার্থেই।
দেখবেন, রাজনীতিবিদরা জেল খাটে, জুলুম সহ্য করে, আমলাতন্ত্রের প্রায় কেউই জেল-জুলুমের শিকার হবে না। রাষ্ট্রীয় কর্মে অনভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ প্রায়শই নির্ভর করে আমলাতন্ত্রের উপর, ফলে আমলাতন্ত্রের ক্ষমতাবলয় রাজনীতিবিদদের চেয়েও বৃহৎ যদিও তারা একে অপরের যোগসাজসে টিকে থাকে। আর আমলাতন্ত্রে জবাবদিহিতা সরাসরি জনগণের কাছে নেই, তাই তাদের ক্ষমতাও মূলত অধিক স্থায়ী, রাজনৈতিক ক্ষমতার চেয়ে।
প্রসাশন ক্যাডারের সবচেয়ে জুনিয়র যে কর্মকর্তা (সহকারী কমিশনার) সেও সাধারণ পুলিশের স্যালুট পায়। তাকে হাঁটাপথের অফিসটুকুতেও দিয়ে আসা ও আনা হয় গাড়ি দিয়ে। গাড়ির দরজা সে নিজে খুলে না বা লাগায় না; খুলে দ্যায় ও লাগিয়ে দেয় ড্রাইভার। আরেকটু সিনিয়র হলে অফিসরুমে ঢোকা বা বেরুনোর সময় চাপরাশি আগে যেয়ে পর্দাটা টেনে ধরবে, যাতে স্যারের ভেতরে ঢুকতে বা বের হতে এতটুকু কষ্ট না হয়। তাদেরকে এমনভাবেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যাতে সবক্ষেত্রে তারাই সর্বাধিক গুরুত্ব ও মনোযোগের দাবিদার এটা প্রতিষ্ঠিত থাকে। জেলা প্রসাশক যেনো জেলার সম্রাট, তার বিশাল বাংলো, সজ্জিত কামরা, ফুলেল প্রাঙ্গণ, সতর্ক প্রহরা আর সারাক্ষণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যতিব্যস্ততা মনে করিয়ে দেয়, উপনিবেশ আমলের সাহেবদের কথা। যে জনগণ রাষ্ট্রের মালিকপক্ষ, সে-ই থাকে নতজানু ভিখিরির দাবিমুখরতা নিয়ে, প্রবেশের অনুমতির জন্যে উন্মুখ থাকে, আর যিনি সার্ভেন্ট তিনি বসে থাকেন রাজার মতো। মালিক দেখে যার দাঁড়ানোর কথা সে বসে থাকে আয়েশে। পাশ্চাত্যের অনেক দেশে, সরকারি অফিসে জনগণ এলে নাকি কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে যায়, যেহেতু রাষ্ট্রের মালিকপক্ষের আগমন ঘটেছে। ডিসি বা এসপির সামনে দাঁড়িয়ে একজন রিক্সাচালক যখন নিঃসংকোচে বলতে পারবে, ‘আমি জনগণ, আমাকে ভয় করো।’ খনি বোঝা যাবে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাওয়া গেছে। তা না-হলে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রই নিয়তি।
সমাজে প্রশাসনে চাকরিঅলাদের শান-শওকত তরুণদের ও অভিভাবকদের মধ্যে তাদের মতো হবার স্বপ্ন-সাধ জাগিয়ে দেয়। বিসিএসে তাই প্রায় সবারই প্রথম পছন্দ থাকে প্রশাসন ক্যাডার। যে সমাজে জ্ঞানকে শক্তি মনে করা হয়, সেখানে শিক্ষক হবেন সবচেয়ে মর্যাদাবান; যে-সমাজে ক্ষতি করার ক্ষমতাকেই মূলত ক্ষমতা ভাবা হয় সে সমাজে পুলিশ ও আমলারাই হবে সবচেয়ে সম্মানিত। অন্য ক্যাডারের সিনিয়র কর্মকর্তাকে প্রশাসনের খুব কম কর্মকর্তাই স্যার ডাকে। এবং শোনা যায়, এগুলো তাদের ট্রেনিং-এরও অংশ। যে ছেলেটি সদ্য ইউনিভার্সিটি পাশ করে বেরিয়ে সহকারী কমিশনার হয়েছে, সেও কোন কলেজের অধ্যক্ষকে হয় প্রিন্সিপ্যাল সাহেব ডাকে, অথবা সম্বোধনহীনভাবে অভিভাষণ করেন। কিন্তু ওই কর্মকর্তাই তার নিজ ক্যাডারের এক ব্যাচ সিনিয়রকেই এক বাক্যে ৪/৫ বার স্যার বলে সম্বোধন করে। এভাবে তারা নিজেরাই নিজেদের সম্মানের এক বলয় তৈরি করে,ও অন্য মানুষও ঔপনিবেশিক মানসের কারণে তাদেরকে এইভাবেই দেখতে অভ্যস্ত হয়। কোনো সরকারি অফিসে বা সচিবালয়ে, হাসপাতালে বা অন্য কোনো সার্ভিস সেক্টরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর বয়সের কোনো অধ্যাপকও এতটা সম্মান ও গুরুত্ব পাবেন না, যা ২৫ বছর বয়সী নবাগত কোনো ম্যাজিস্ট্রেট পাবে। আমাদের রাষ্ট্র ও ঔপনিবেশিক মনোকাঠামো ও সাংস্কৃতিক মান বুঝবার জন্যে এই নজিরগুলো অধ্যয়নের দরকার আছে।
আমলাতন্ত্রকে জনমুখী করা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য শর্ত। আমাদের আমলাতন্ত্র ঔপনিবেশিক লিগাসি বহন করে চলেছে প্রায় অক্ষরে অক্ষরে। আমলাদেরকে দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়, এটা সত্যি। ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করলে কিন্তু এই মেহেনতটুকু ভাগ হয়ে যায়। কিন্তু ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মধ্য দিয়ে, জাস্ট একটু আয়েশের বিনিময়ে, কে হারাতে চায় আধিপত্য ও ক্ষমতার জৌলুশ! গণমুখী আমলাতন্ত্র ও অনাড়ম্বর প্রশাসন ইনসাফপূর্ণ রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রধান ধাপ।
যারা আজকের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রশাসনে যাবার প্রথম ধাপ উত্তীর্ণ হওয়ার স্বপ্ন দেখছ, কয়েক ধাপ পর তারা যখন চাকরিতে সুপারিশপ্রাপ্ত হবে, তারা যেন জনমুখী ও বিউপনিবেশিত গণসেবক ও সত্যিকার গণকর্মচারী হতে পারে ও রাষ্ট্রের সেবার দর্শন মাথায় নিয়ে কাজ করতে পারে, আপাতত এই দোয়া থাকবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক