চারু মজুমদার

চারু মজুমদার

মার্কসবাদ থে‌কে যোজন দূ‌রের ক‌মিউনিস্ট দল ও চারু মজুমদার

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুন ৩০, ২০২৪

বাংলা‌দে‌শের বামপন্থীরা শতভা‌গে নি‌জেরা যে বিভক্ত তার প্রধান কারণ ইতিহাস, সমাজ‌বিজ্ঞান, রাজনী‌তি, দর্শন, সা‌হিত‌্য কো‌নো ব‌্যাপা‌রেই তাঁ‌দের গভীর পড়াশুনা নেই। মার্কসবাদ বা মার্কস-এঙ্গেলস, লে‌নিন, স্টা‌লিন ও মাও‌ সেতুংয়ের লেখা কজন প‌ড়েন সেটা একটা প্রশ্ন। স্বভাবতই তারা যে শতভা‌গে বিভক্ত, সেটাই প্রমাণ ক‌রে তাঁ‌দের সক‌লের মতাদর্শ দুর্বল। সক‌লে য‌দি মার্কসবাদের ওপর গভীর জ্ঞান রাখ‌তেন তাহ‌লে তাঁ‌দের মতাদর্শ একই রকম হ‌তো। নি‌জে‌দের ম‌ধ্যে বি‌ভে‌দের প্রশ্ন উঠ‌তো না।

দুজন মার্কসবাদী তো আর নি‌জে‌দের ম‌ধ্যে মারামা‌রি কর‌তে পা‌রেন না। যার বড় প্রমাণ মার্কস-এঙ্গেলস। দুজ‌নে এতে স্বচ্ছভা‌বে সেই মূল চিন্তা‌কে ধারণ কর‌তেন যে, দীর্ঘ জীব‌নে কখ‌নো তাঁ‌দের দুজ‌নের ম‌ধ্যে বি‌রোধ দেখা যায়‌নি। কিন্তু এখানকার সমাজতন্ত্রী বা তথাক‌থিত‌দের ম‌ধ্যে দু’চার-দিন পরপর মত‌ভেদ দেখা দেয়ায় দল ভা‌ঙে। এস‌বের কারণ কি? মার্কসবাদ না বোঝা। দুজন একইভা‌বে বা গভীরভা‌বে মার্কসবাদ বুঝ‌লে একই প‌থে চল‌তেন, বি‌ভে‌দের প্রশ্নটাই আস‌তো না।

ভারতব‌র্ষের বাম রাজনী‌তির ক্ষে‌ত্রে কী লক্ষ‌্য করা যায়? দীর্ঘ এক‌শো বছ‌রের বেশি সম‌য়ে বিপ্লব হোক আর না হোক, বা বিপ্ল‌বের সম্ভাবনা দেখা দিক আর না দিক, তথাক‌থিত মার্কসবাদীরা ক‌দিন পরপর বি‌ভিন্ন গোষ্ঠী‌তে বিভক্ত হ‌চ্ছে। স‌ত্যিকার অর্থে বামপন্থী নামধারীরা য‌তে পরস্পর‌কে আক্রমণ ক‌রে‌ছে, কখ‌নো ডানপন্থী‌ দলগু‌লো‌কে তা ক‌রেনি। ভার‌তের সাম‌্যবাদীরা ছি‌লেন প্রথম থে‌কে কংগ্রেসের উপদল। কং‌গ্রেসের রাজনী‌তিই ছিল তা‌দের রাজনী‌তি। ফ‌লে সাম‌্যবাদী দল স্বাধীনতা লা‌ভের সময়কাল পর্যন্ত অনেকটাই ছি‌ল কং‌গ্রেসের অঙ্গ সংগঠন।

ঊনিশশো বিয়া‌ল্লিশ সা‌লে দ্বিতীয় মহাযু‌দ্ধে অংশ নেয়া না নেয়ার প্রশ্নে প্রথমবার কং‌গ্রেসের স‌ঙ্গে সাম‌্যবাদী‌দের বি‌রোধ আরম্ভ হয়। সাম‌্যবাদীরা তখ‌নো জনগণ‌কে স‌ঠিক ‌নি‌র্দেশনা দি‌তে ব‌্যর্থ হয়ে‌ছিল। বি‌শেষ ক‌রে ছেচ‌ল্লিশ সা‌লের নৌ‌বি‌দ্রো‌হে কং‌গ্রেসের দোদুল‌্যমান চ‌রিত্র ফু‌টে ওঠে। বুঝ‌তেই পারা গেল, বিপ্লব সংগ‌ঠিত করার সু‌যোগ হা‌তে পে‌য়ে তা হাতছাড়া হ‌লো স‌ঠিক বিপ্লবী চিন্তার অভা‌বে। য‌দি সে‌দিন সাম‌্যবাদীরা নৌ‌বি‌দ্রোহ‌কে সমর্থন দি‌তেন তাহ‌লে আজ‌কের ভারত পা‌কিস্তান বাংলা‌দে‌শের চেহারা অন‌্যরকম হ‌তো। কিন্তু ক‌য়েকজন ছাড়া তথাক‌থিত সাম‌্যবাদীরা সে‌দিন কং‌গ্রেসের পথ অবলম্বন ক‌রে‌ছি‌লেন। আসফ আলী ও তার স্ত্রীর মতন ক‌য়েকজন সেখা‌নে ব‌্যতিক্রম ছি‌লেন। সেই ইতিহাসের এক‌টি দিক নি‌য়ে নাটক লি‌খে‌ছেন উৎপল দত্ত ‘ক‌ল্লোল’।

খুব স্পষ্টভাবেই এখা‌নে ব‌লে রাখা দরকার, সে‌দিন সাম‌্যবাদী‌দের নৌ বি‌দ্রোহ‌কে সমর্থন না দেয়ার এই ঘটনাটা চারু মজুমদা‌রের পছন্দ হয়‌নি। পছন্দ হয়‌নি আরও অনেকের। চারু মজুমদার এভা‌বে বারবার সাম‌্যবাদী‌দের বিপ্লব বি‌রোধী আচর‌ণে বিরক্ত হ‌য়ে এক সম‌য়ে প্রতিবাদ স্বরূপ অতিবিপ্লবী পথ বে‌ছে নেন। ক‌মিউনিস্ট পা‌র্টি মা‌র্ক‌সিস্ট দল ছে‌ড়ে ক‌মিউনিস্ট পা‌র্টি মার্ক‌সিস্ট লে‌নিনস্ট গঠন করার কা‌জে নাম‌লেন। চারু মজুমদা‌রের রাজনী‌তির পরবর্তীকালে য‌ত ত্রু‌টি ধরা পড়ুক এটা স্পষ্ট হ‌য়েছিল যে, প্রকৃতপ‌ক্ষে ভার‌তে কো‌নো সাম‌্যবাদী দল তখন ছিল না। প্রায় সক‌লের মান‌সিকতায় ধরা প‌ড়ে নানারকম আপোস ও সংসদীয় রাজনীতির সুবিধাগ্রহণ।

নকশাল রাজনী‌তির য‌তই ত্রু‌টি ধরা পড়ুক, এটা সে‌দিন দি‌নের আলোর মতন প্রতিভাত হ‌য়ে‌ছিল ভার‌তে প্রলেতা‌রি‌য়েত স্বা‌র্থের প‌ক্ষে কো‌নো দল নেই। চারু মজুমদারসহ অন‌্যান‌্য অনেকে তখন প্রলেতা‌রি‌য়েত, দ‌লিত‌দের ভাগ‌্য পাল্টাবার জন‌্য নতুন সাম‌্যবাদী রাজনী‌তির কথা ভে‌বে‌ছি‌লেন। কারণ তখনকার তথাক‌থিত মার্কসবাদী দলগু‌লো প্রলেতা‌রি‌য়েত, দ‌লিত‌দের স্বার্থ না দে‌খে কং‌গ্রেসের মতন সামন্ত‌তের স্বার্থ রক্ষার কথা ভে‌বে‌ছিলেন। পরবর্তী বাম‌ সরকার যে ভূ‌মিসংস্কার কর‌তে বাধ‌্য হ‌য়ে‌ছি‌লেন তা কিন্তু নকশাল আন্দোল‌নের ফল। না হ‌লে এত দ্রুত নকশাল আন্দোলন‌কে ঠেকা‌নো যে‌ত না, এটা অনেকটা সোডা খে‌য়ে পেটব‌্যথা ভা‌লো করা। সমস‌্যার তাৎক্ষ‌ণিক সমাধান।

নকশালপন্থ‌ী আন্দোল‌নের আগে পু‌রোণ চান্দ যোশীর আম‌লে দেখা গে‌ছে সাম‌্যবাদী দ‌লের সামন্ত ও সরকা‌রের স‌ঙ্গে আপোস কর‌তে, ঠিক আবার রনদী‌ভের সম‌য়ে অতিবিপ্লবী মূ‌র্তিভাঙা আন্দোলনে যোগ দি‌তে। দুটাই প্রমাণ ক‌রে, তথাক‌থিত সাম‌্যবাদীরা মার্কসবাদী চিন্তা থে‌কে ক‌তো দূ‌রে ছি‌লেন। ভারতব‌র্ষে বে‌শিরভাগ ক্ষে‌ত্রেই সো‌ভি‌য়েত ইউনিয়‌নের বিপ্ল‌বের সাফল‌্যই কেবল তা‌দের সাম‌্যবাদী দল গঠ‌নে উৎসাহী ক‌রে‌ছিল। দলগু‌লোর স‌ঙ্গে যুক্তরা অনেকে ছি‌লেন সামন্ত এবং দ‌লের কার্যক্রম শহ‌রেই স‌ীমাবদ্ধ ছিল। ভিন্ন দি‌কে কং‌গ্রেসের সংগঠন ছিল প্রত‌্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। প্রত‌্যন্ত অঞ্চ‌লে সংগঠন না গ‌ড়ে, সেখানকার জনগ‌ণের স‌ঙ্গে যোগা‌যোগ স্থাপন না ক‌রে সংসদীয় পদ্ধ‌তি‌তে সাম‌্যবাদীরা ক্ষমতা গ্রহণ ক‌রে বিপ্লব করার কথা ভা‌বেন। কীরকম হাস‌্যকর চিন্তা।

চারু মজুমদার‌দের দৃষ্টি ছিল এর বিপরীত এবং তখনকার জন‌্য স্বচ্ছ। চারু মজুমদার‌কে যখন এর আগে ক‌মিউনিস্ট পা‌র্টি বড় পদ দি‌য়ে কলকাতা কার্যাল‌য়ে বসার ব‌্যবস্থা ক‌রে‌ছি‌ল, তি‌নি তা‌তে অসম্মত হন। চারু মজুমদার স্পষ্ট ক‌রেই ব‌লে‌ছি‌লেন, তিনি সাধারণ মানু‌ষের কা‌ছে থাক‌তে চান। তি‌নি ম‌নে কর‌তেন, বিপ্লব কর‌তে হ‌লে তাঁক‌ে প্রত‌্যন্ত মানু‌ষের স‌ঙ্গে থাক‌তে হ‌বে, তা‌দের দি‌য়েই বিপ্লব সংঘটিত কর‌তে হ‌বে। চারু মজুমদা‌রের রাজনী‌দির এক‌টি দিক এর ভিতর দি‌য়ে সক‌লের কা‌ছে প্রতিভাত হ‌বে। কিন্তু বি‌ভিন্ন রকম ত‌্যাগ তি‌তিক্ষা ও উৎসাহ প‌রিশ্রম স‌ত্ত্বেও দেখা যা‌বে তি‌নিও মার্কসবা‌দের প‌থে হাঁটেন‌নি। কিন্তু তি‌নি জনগ‌ণের স‌ঙ্গেই ছি‌লেন।

চারু মজুমদার মো‌টেই আপোসকামী ছি‌লেন না, সর্বহারা‌দের স্বা‌র্থে ঠিক ক‌রে‌ছি‌লেন ক্ষমতা দখল কর‌বেন। গা বাঁচা‌নো রাজনী‌তি থে‌কে স‌রে দাঁড়া‌লেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, বিপ্লব তাঁর কা‌ছে খুব সহজ কাজ ম‌নে হ‌য়ে‌ছিল। তি‌নি প্রচুর পড়াশুনা কর‌তেন, সবসময় তাঁর ঝোলার ম‌ধ্যে বই থাক‌তো। ছাত্রজীব‌নে তি‌নি পাঠ‌্যবই না প‌ড়ে বাইরের বই পড়‌তেন প্রচুর। কিন্তু মার্কসবাদ বা বিপ্লব সম্প‌র্কে, তাঁর রণনী‌তি ও রণনী‌তি সম্প‌র্কে তাঁর পড়াশুনার বা উপল‌ব্ধির ঘাট‌তি ছিল। ভিন্ন দি‌কে তাদের নতুন দ‌লে যখন চারুর অতি‌বিপ্লবী চিন্তা নি‌য়ে প্রশ্ন ওঠে, তখন চারু মজুমদার নি‌জের জন‌প্রিয়তা ও প্রভাব খা‌টি‌য়ে বহু সিনিয়র নেতা‌দের দল থে‌কে বাদ দেন। তি‌নি বিপ্ল‌বের জন‌্য তরুণ‌দের আকৃষ্ট ক‌রেন। সরকারি নানা কার্যক্রমে ক্ষুব্ধ যুবকরা নকশালবা‌ড়ির পু‌লিশ জনগ‌ণের সংঘর্ষের সংবাদ পাঠ ক‌রে তখন উদ্দীপ্ত। দ‌লে দ‌লে তারা নকশাল আন্দোল‌নে যোগ দিচ্ছি‌ল। কিন্তু মার্কসবাদ, রাজনী‌তি বা সমাজ‌বিজ্ঞান সম্প‌র্কে এদের সামান‌্য পড়াশুনা ছিল না।

চারু মজুমদা‌রের প্রতি‌টি বাক‌্য ছিল তা‌দের কা‌ছে পূজনীয়। ব‌্যক্তিপূজার জায়গা হ‌য়ে দাঁড়ি‌য়ে‌ছিল দল। দ‌লের লেখাপড়া জানা অনেক সি‌নিয়র সদস‌্যরা তখন বাদ প‌ড়ে‌ছেন মতাদর্শ নি‌য়ে গণতা‌ন্ত্রিক কে‌ন্দ্রিকতার প্রশ্ন‌টি সাম‌নে আনার জন‌্য। ব‌লে‌ছি‌লেন, দ‌লে কে‌ন্দ্রিকতা আছে কিন্তু গণতন্ত্র নেই। চারু মজুমদা‌রের লাইন‌কে ভ্লা‌দি‌মির লে‌নিন আগা‌গোড়া সমা‌লোচনা ক‌রে গে‌ছেন। লে‌নি‌নের বড় ভাই এই ধর‌নের রাজনী‌তি করার জন‌্য শাসক‌দের হা‌তে প্রাণ দি‌য়ে‌ছি‌লেন। কিন্তু চারু মজুমদার সেটা‌কেই স‌ঠিক পথ ম‌নে কর‌লেন। স‌রোজ দত্ত থে‌কে গে‌লেন চারু মজুমদা‌রের স‌ঙ্গে, চারু মজুমদা‌রের লাইনের জোরা‌লো সমর্থক তি‌নি। দুজ‌নেই তখন কট্টর ম‌নোভাব গ্রহণ ক‌রে‌ছেন ক্ষমতা দখ‌লের ল‌ক্ষ্যে।

স‌রোজ দত্ত তখন উগ্র রাজ‌নৈ‌তিক আক্রম‌ণে বিশ্বাসী। র‌নোদী‌ভের মতন তি‌নিও রবীন্দ্রনাথ ও বিদ‌্যাসাগর সক‌লের মূ‌র্তিভাঙার প‌ক্ষে। দ‌লের ভিত‌রে যাঁরা তখন স‌ক্রিয় যুবক, তারাও অনেকে তা মে‌নে নি‌তে পার‌লেন না। স‌রোজ দ‌ত্তের মূ‌র্তি ভাঙার চিন্তাটা ঠিক ছিল না। কিন্তু তাঁ‌দের  ক্রো‌ধের জায়গাটাও সেই স‌ঙ্গে বুঝ‌তে হ‌বে। রাম‌মোহন, বিদ‌্যাসাগর, বি‌বেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী প্রমুখ যাঁ‌দের মূ‌র্তি ভে‌ঙেছেন, কখ‌নো এঁরা কেউ দ‌রিদ্র মানু‌ষের প‌ক্ষে দাঁড়াননি, সমা‌জের জন‌্য তাঁ‌দের কেউ কেউ য‌তই নানারকম প্রগ‌তিশীল ভূ‌মিকা রা‌খেন না কেন। সেই ভূ‌মিকা সু‌বিধা‌ভোগী মধ‌্যবিত্তদের উপকা‌রে আস‌লেও সর্বহারা‌দের কা‌জে আসে‌নি। ব্রিটিশ শাস‌নে ব্রিটিশ সরকা‌রের সঙ্গে এঁরা আপোস ক‌রেই চ‌লে‌ছেন। দ‌রিদ্রকে কখ‌নো কখ‌নো দয়া ক‌রে‌ছেন, কিন্তু দ‌রি‌দ্রের অধিকার রক্ষা করার চেষ্টা ক‌রেননি। দ‌রিদ্রদের ভাগ‌্য পাল্টাবার জন‌্য আন্দোলনে না‌মেন‌নি। বরং উল্টোটাই ক‌রে‌ছেন, ব‌্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ।

বিদ‌্যাসাগরের মতন মহান মানুষ পর্যন্ত ব‌লে‌ছি‌লেন, দ‌রিদ্রদের ‌শিক্ষার দরকার নেই। ধনীরা শিক্ষা নি‌লেই চল‌বে। বিদ‌্যাসাগ‌রের সমাজ সংস্কা‌রের দ্বারা দ‌রিদ্র মানুষরা সামান‌্য উপকৃত হয়‌নি। এইসব মহান মানুষরা‌ য‌তই বড় বড় কথা ব‌লেন না কেন, ভিত‌রে ভিত‌রে নি‌জেরা জাতপাত বর্ণব‌্যবস্থা টি‌কি‌য়ে রাখ‌তে চে‌য়ে‌ছি‌লেন। দ‌লিত বা অস্পৃশ‌্যদের দুঃখক‌ষ্টের প্রতি সামান‌্য সহানুভূ‌তিশীল ছি‌লেন না। ফ‌লে স‌রোজ দ‌ত্তের মতন নকশাল‌দের কা‌ছে এটা স্পষ্ট ছিল, এঁরা দি‌নের শে‌ষে ক্ষুধার্ত ব‌ঞ্চিত মানু‌ষের শত্রু। শাসক‌দে‌র প‌ক্ষের লোক। শাসক‌দের বিরু‌দ্ধেই যখন নকশালরা শাসক‌দের উৎখা‌তের আন্দোলন কর‌ছে, তখন শাসকচ‌ক্রের দালাল‌দের প্রতি নমনীয় হওয়ার কী দরকার? বরং তা‌দের প্রতি সাধারণ মানু‌ষের ঘৃণা জা‌গি‌য়ে তোলা দরকার, তা‌দের সম্মা‌নের আসনটা ধ্ব‌সি‌য়ে দেয়া দরকার।

মূ‌র্তি ভাঙার ভুলটা ছিল এই যে, তাহ‌লে বড় বড় মানুষ‌দের প্রগ‌তিশীল কাজ‌কে অস্বীকার করা হয়। বিপ্ল‌বের আগে সমাজ শ্রেণি‌বিভক্ত থাকবে সেটাই স্বাভা‌বিক। মূ‌র্তি ভেঙে শ্রেণিঘৃণা সৃ‌ষ্টির ম‌ধ্যে নৈরাজ‌্য থা‌কে, তা মানুষ‌কে ইতিহা‌সসম্মতভা‌বে শ্রেণিদ্বন্দ্ব বুঝ‌তে সাহায‌্য ক‌রে না। মার্কস-এঙ্গেলস, লে‌নিন, মাও বারবার শ্রেণি-দ্বন্দ্বটা‌কে স্পষ্ট করার দি‌কে নজর‌ দি‌তে ব‌লে‌ছি‌লেন। স্বীকার ক‌রে‌ছি‌লেন, বিপ্লব এগি‌য়ে নি‌তে আগের যু‌গের অনেক বু‌র্জোয়া‌দের প্রগ‌তিশীল‌দের ভূ‌মিকা। বি‌শেষ ক‌রে তি‌নি টলস্ট‌য়ের কথা বারবার বল‌তেন, বল‌তেন কৃষক‌দের সঙ্কট বুঝ‌তে টলস্টয় ব‌্যাপক সাহায‌্য ক‌রে‌ছেন তাঁর লেখ‌নির মাধ‌্যম। নারদ‌নিকরা যখন দস্তয়ভ‌স্কি, টলস্টয় প্রমুখ‌দের আক্রমণ কর‌তে আরম্ভ ক‌রে‌ছিল, লে‌নিন তার সমা‌লোচনা ক‌রেন। ভ্লা‌দিমির লে‌নিন ব‌লে‌ছি‌লেন, বিপ্লব সংঘ‌টিত কর‌তে এইসব প্রয়াতদের অনেকের প্রগ‌তিশীল ভূ‌মিকা আছে।

স‌রোজ দত্ত ও চারু মজুমদার সেই সূক্ষ্ম কথাটা বুঝ‌তে চাইলেন না। চারু মজুমদার বহু বছর থে‌কে দ‌রিদ্র ও দলিত‌দের দ‌ুঃখ কষ্ট দেখ‌তে পা‌চ্ছেন। তি‌নি সে কার‌ণে ছি‌লেন ধনী ও জোতদার মহাজ‌নের ওপর ক্ষুব্ধ। প্রচণ্ড রাগ ছিল তাঁর এইসব ধ‌নীদের ওপর। কিন্তু এই রাগ প্রকাশ বা তাৎক্ষ‌ণিক ‌বি‌দ্রো‌হের স‌ঙ্গে মার্কসবাদী লড়াইয়ের পার্থক‌্য আছে। চাইলেই তাৎক্ষ‌ণিকভা‌বে বি‌দ্রোহ ক‌রে ক্ষমতা দখল করা যায় না। চারু মজুমদার বিশ্বাস কর‌ছি‌লেন, তরুণরা এবং সমা‌জের বিরাট অংশ এই বি‌দ্রো‌হে ঝাঁ‌পি‌য়ে পড়‌বে এবং তি‌নি ক্ষমতা দখল ক‌রে সব‌কিছু পা‌ল্টে দে‌বেন। চিন্তাটা মহৎ স‌ন্দেহ নেই কিন্তু আস‌লে তা ভাববিলাসিতা মাত্র।

চারু মজুমদা‌রের ঝাণ্ডা তখন সর্বত্র উড়ছে, পূজনীয় হয়ে উঠ‌ছেন তি‌নি শহুর‌ে তরুণ‌দের মধ্যে। তি‌নি ম‌নে কর‌ছেন, তি‌নি সাফ‌ল্যের দি‌কে এগি‌য়ে যা‌চ্ছেন। খুব শীঘ্রই বিপ্ল‌ব আসন্ন। তি‌নি ঘোষণা কর‌লেন, `সত্তর দশক বিপ্ল‌বের দশক`। তি‌নি ভয়াবহ যে কথাটা বল‌লেন তাহ‌লো, `শ্রেণি শত্রুর র‌ক্তে হাত না রাঙালে সে ক‌মিউনিস্ট নয়`। এটা ছিল সম্পূর্ণ মার্কসবাদ বি‌রোধী কথা। তি‌নি আরো ব‌লে‌ছি‌লেন, `শ্রেণিশত্রু খতম হ‌লো জনগণ‌কে সংগ‌ঠিত করার একমাত্র পথ`। এটাও ছিল তাঁর নিজস্ব মত। তি‌নি আস‌লে ক‌তটা মার্কসবাদী ছি‌লেন সে প্রশ্ন উঠে আসে এসব বক্ত‌ব্যে। কিন্তু মার্কসবা‌দের চিন্তা ও অনুশীলন ছাড়াই তি‌নি এই বিপ্লব কর‌তে চাইলেন। নকশাল আন্দোল‌নে তখন যুক্ত হ‌য়ে‌ছে অনেক শহর ও গ্রা‌মের তরুণ যুবকরা, কিন্তু মার্কসবাদ অধ‌্যয়ন অনুশীলন ছাড়াই তারা চারু মজুমদা‌রের বিপ্লবী সৈ‌নিক। কিন্তু মার্কস-এঙ্গেলস-‌লে‌নিন ব‌লে গে‌ছেন বিপ্লবী তত্ত্ব বাদ দি‌য়ে বিপ্লব হয় না। বিপ্ল‌বের সমাজ‌বিজ্ঞান না বু‌ঝে হা‌তে অস্ত্র নি‌লে, সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দি‌তে পা‌রে। নকশাল আন্দোল‌নে শেষ পর্যন্ত তাই হ‌য়ে‌ছিল। ১৮৫৭ সা‌লের বিক্ষুব্ধ বি‌দ্রোহী সৈ‌নিক মঙ্গল পাণ্ডে নিঃস‌ন্দে‌হে নমস‌্য ব‌্যক্তি। একইভা‌বে পরবর্তীকা‌লের ক্ষু‌দিরাম। কিন্তু তাঁ‌দের পথ মার্কসবাদী বিপ্ল‌বের পথ নয়। মার্কসবাদ হটকা‌রিতা‌কে প্রশ্রয় দেয় না। ব্রেশ‌টের এ ব‌্যাপা‌রে এক‌টি নাটক আছে ডি মাসনাহা‌মে যার অনুবাদ ক‌রে‌ছেন উৎপল দত্ত `সমাধান` না‌মে।

নকশাল আন্দোল‌নে প্রতিপ‌ক্ষের হা‌তে বহু মানুষের প্রাণ যে‌তে থাক‌লো। কলকাতা শহ‌রে লাশ পড়‌তে থাক‌লো। নকশাল‌দের হা‌তে মারা পড়‌তে থাক‌লো পু‌লিশ। পু‌লি‌শের হা‌তে ও সরকারের গুণ্ডা‌দের হা‌তে মারা পড়‌তে থাক‌লো নকশাল তরুণরা। দুপক্ষ থে‌কেই অন‌্যায়ভা‌বে হত‌্যাযজ্ঞ চল‌তে থাক‌লো। নকশাল‌দের হা‌তে মারা পড়‌তে থাক‌লো সাধারণ পু‌লিশ, ভুলভা‌বে শ্রেণি শত্রুর না‌মে হত‌্যা করা হ‌লো নি‌র্দোষ মানু্ষ‌কে। ভিন্ন দি‌কে নকশাল স‌ন্দে‌হে তরুণ‌দের হত‌্যা করা হ‌লো নির্মমভা‌বে। রাষ্ট্র বিনাবিচা‌রে নকশাল‌দের হত‌্যা করা আরম্ভ কর‌লো, নকশাল‌দের প‌ক্ষেও বদলা নেয়া চল‌লো। হত‌্যা চল‌লো বাম‌দের নি‌জে‌দের প্রতিপ‌ক্ষের ম‌ধ্যেও। খুনাখু‌নি হ‌লো দ‌লের অভ‌্যন্ত‌রে বিরুদ্ধ পক্ষ‌কে নিধন কর‌তে। রাষ্ট্র চাইছিল এসব ঘট‌তে থাক, এসব রক্তপাত ছ‌ড়ি‌য়ে পড়ুক, মানু‌ষ ভ‌য়ের ম‌ধ্যে দিন কাটাক। তাহ‌লে সমাজতা‌ন্ত্রিক আন্দোলন সম্প‌র্কে মান‌ু‌ষের মোহভঙ্গ হ‌বে। বিপ্ল‌বের হাত থে‌কে তাহ‌লেই রক্ষা পা‌বে ভার‌তের ধ‌নিকরা। ক‌মিউনিস্ট‌দের নি‌জে‌দের ম‌ধ্যে বি‌রোধ এবং সংঘ‌র্ষে প্রতি‌ক্রিয়াশীলরা নি‌জে‌দের রক্ষার মন্ত্র খুঁ‌জে পেল। প্রচার মাধ‌্যমে তাই প্রথম প্রথম চারু মজুমদার আর নকশাল‌দের সম্প‌র্কে ফু‌লি‌য়ে ফাঁ‌পি‌য়ে তোলা হ‌লো। তরুণরা আরো ঝুঁকে পড়‌তে থাক‌লো নকশালপন্থীর দি‌কে এবং প্রাণ দি‌তে থাক‌লো। হাজার চুরাশির মা উপন‌্যা‌সে তার কিছুটা চিত্র পাওয়া যায়।

চারু মজ‌ুমদার নি‌জেই মার্কসবাদ অনুশীলন বাদ দি‌য়ে বিপ্ল‌বের ঘো‌রে পড়‌লেন। তি‌নি বিপ্ল‌বের জন‌্য তা‌কি‌য়ে থাক‌লেন চী‌নের দি‌কে। এর আগেই তি‌নি ব‌লে‌ছি‌লেন, `চী‌নের চেয়ারম‌্যান আমা‌দের চেয়ারম‌্যান।` চীন কিন্তু চারু মজুমদা‌রের এসব কাজক‌ে সমা‌লোচনা কর‌লো। এই সময় চারু মজুমদার‌কে খুব এক‌রোখা, খুব আবেগী ম‌নে হ‌তে থা‌কে। য‌থেষ্ট স্বৈরাচারী ম‌নোভাব ফু‌টে ওঠে তার আচর‌ণে।‌ কিন্তু তি‌নি ব‌্যক্তিগতভা‌বে কো‌নো সুবিধা নি‌তেন না। কম খে‌য়ে খুব রোগা হ‌য়ে গি‌য়ে‌ছি‌লেন। ছাত্র জীবন থে‌কেই তার ম‌ধ্যে কষ্ট স‌হিষ্ণুতা ও সু‌বিধা না নেয়ার ম‌নোভাব লক্ষ‌্য করা গে‌ছে। কিন্তু বাম‌বিচ‌্যু‌তি‌তে পড়‌লেন তি‌নি। দ‌লের সি‌নিয়র‌দের কা‌ছে তাঁর গুরুত্ব কম‌তে থাক‌লো। চারু মজুমদার এরই ম‌ধ্যে সব ধর‌নের গণ সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন বা‌তিল করার কথা ব‌লে‌ছি‌লেন। শিক্ষাব‌্যবস্থা‌কে আক্রমণ কর‌লেন। যুবসমাজ‌কে বোঝা‌লেন, এই শিক্ষাব‌্যবস্থা সব‌চে‌য়ে ক্ষ‌তিকর, বিপ্লব বি‌রোধী ও জনগ‌ণের শত্রুপ‌ক্ষের অস্ত্র। তি‌নি বল‌লেন, `বর্তমান শিক্ষাব‌্যবস্থায় য‌ত লেখাপড়া শিখ‌বে তত প্রতি‌ক্রিয়াশীল হ‌বে`। কথাগু‌লো যে পু‌রোপু‌রি মিথ‌্যা ছিল তাও নয়, বরং অনেক বে‌শি সত‌্য ছিল। কিন্তু নতু‌নের ইমারত না গ‌ড়ে রাতারা‌তি এসব ধ্বংস কর‌তে চাইলে হিতের চে‌য়ে বিপরীতটাই বে‌শি ঘ‌টে। বহু তরুণ লেখাপড়া ছে‌ড়ে দিল, নি‌জে‌দের নকশাল ভাব‌তে তারা গর্ব অনুভব কর‌তো। সে একটা সময়, যখন তরুণরা বহু বিদ‌্যালয় পু‌ড়ি‌য়ে দি‌য়ে‌ছিল। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর কর‌লো। নকশাল‌দের ভ‌য়ে বা নকশাল‌দের স‌ঙ্গে একমত পোষণ ক‌রে বহু বিদ‌্যালয় বন্ধ হ‌য়ে গেল।

চীন এসব ঘটনার সমা‌লোচনাই ক‌রে‌ছিল।‌ নকশালরা যেমন মানু‌ষের ম‌নে আশা জা‌গি‌য়ে রাতারা‌তি আলোচনায় এসে‌ছিল, নানা হঠকা‌রিতায় দ্রুত আবার জনসমর্থন হারা‌লো নগ‌রে ও গ্রা‌মে। বিদ‌্যালয় পোড়া‌নো, গলাকাটা রাজনী‌তি এসব‌কে ঘি‌রে নকশাল‌দের প্রথম দি‌কের জনসমর্থন ক‌মে গেল। শ্রেণিশত্রু নিধন‌কে কেন্দ্র ক‌রে দ‌লিত ও সাধারণ কৃষকরা পর্যন্ত নকশাল‌দের থে‌কে দূ‌রে স‌রে যে‌তে থাক‌লো। বিশ হাজার মানু‌ষের সমর্থন ছিল যে অঞ্চ‌লে, সেখা‌নে দু‌শোজন‌কে আর খুঁ‌ঁজে পাওয়া গেল না নকশাল‌দের প‌ক্ষে। নকশাল‌দের বিরু‌দ্ধেও গেল না তারা। অনেকে নকশাল‌দের ভয় পর্যন্ত পে‌তে থাক‌লো। একাত্ত‌রের মু‌ক্তিযুদ্ধ‌কে ঘি‌রে তখন পুনরায় ইন্দিরা গান্ধীর জন‌প্রিয়তা বৃ‌দ্ধি পে‌য়ে‌ছিল। শাসক‌দের প‌ক্ষে সহজ হ‌লো নকশাল‌দের দমন করা। স‌রোজ দত্ত‌কে ধ‌রে এনে ১৯৭১ সা‌লের ৫ আগস্ট ভোরবেলায় ময়দা‌নে ক্রসফায়া‌রে দেওয়া হ‌লো। ভো‌র বেলায় হাঁটাহাঁ‌টি কর‌তে গি‌য়ে উত্তমকুমার দেখ‌তে পে‌লেন এই হত‌্যাকাণ্ড। ফ‌লে তি‌নি দুপ‌ক্ষের চা‌পে পড়‌লেন। পু‌লিশ বল‌লো, সে কিছুই দে‌খে‌নি সেটা যেন ম‌নে রা‌খে। নকশালরা বল‌লেন, যা দে‌খে‌ছে তা যেন উত্তমকুমার ব‌লে দেন। নি‌জের জীবন বাঁচা‌তে উত্তমকুমার তখন কিছু‌দি‌নের জন‌্য চ‌লে গে‌লেন মুম্বাই।

বাংলা‌দে‌শের স্বাধীনতা লা‌ভের ছয় মাস পর ঊনিশ‌শো বাহাত্তর সা‌লের ১৬ জুলাই ধর‌া পড়‌লেন চারু মজুমদার। কলকাতার এন্টালী রো‌ডের এক বাসা থে‌কে তাঁ‌কে গ্রেফতার করা হ‌লো। যখন তাঁ‌কে গ্রেফতার করা হয় তার আগে থে‌কেই তি‌নি অসুস্থ‌ ছি‌লেন। ২৮ জুলাই পু‌লিশ‌দের কা‌ছে অন্তরীণ অবস্থায় তি‌নি মারা যান। বলা হ‌লো, তি‌নি হৃদ‌রো‌গে মারা গে‌ছেন। যি‌নি ব‌লে‌ছি‌লেন সত্ত‌রের দশক‌কে ‌তাঁর দল মু‌ক্তির দশ‌কে প‌রিণত ক‌রবে, তি‌নি সত্ত‌রের দশ‌কের শুরু‌তেই প্রাণ দি‌লেন সরকা‌রের বা‌হিনী হা‌তে। সক‌লেই জা‌নেন তারপর কী  ঘটে‌ছিল, অনেকে মারা পড়‌লেন, অনেকে কারাগা‌রে নি‌ক্ষিপ্ত হ‌লেন, অনেকে বহু বছর কারাদণ্ড ভোগ কর‌লেন। তাঁ‌দের অনেকেই লি‌খে‌ছেন নকশাল আন্দোল‌নের পথটা ভুল ছিল। জনগণ থে‌কে বি‌চ্ছিন্ন হ‌য়ে বিপ্লব বা সরকা‌রের বিরাট বা‌হিনীর বিরু‌দ্ধে লড়াই করা যায় না। শুধু অস্ত্র আর মরণপণ লড়াই করার সাহস দি‌য়ে বিপ্লব হয় না। নানাভা‌বে চারু মজুমদার নি‌ন্দিত ও প্রশং‌সিত হ‌য়ে‌ছেন। তি‌নি য‌তটা ছি‌লেন মার্কসবাদী, তার‌চে‌য়ে অনেক বেশি ছি‌লেন সিধু কানাইয়ের মতন নির্ভীক স্থানীয় জননেতা। তি‌নি তবুও মার্কসবাদী‌দের মতন বিরাট রাষ্ট্র দখ‌লের স্বপ্ন দেখ‌তেন।

সব‌কিছুর পর সব সমা‌লোচনা পর চারু মজুমদার একজন নমস‌্য ব‌্যক্তি। ভার‌তের ক‌মিউনিস্ট পা‌র্টি য‌দি সু‌বিধাবাদী প‌থে পা না বাড়াতো তাহ‌লে চারু মজুমদার‌ বা অন‌্যান‌্য নকশালপন্থী‌দের এই প‌থে পা বাড়া‌তে হ‌তো না। চার‌দি‌কের মানু‌ষের ওপর নানা অত‌্যাচার চারু মজুমদার‌কে ক্ষুব্ধ ক‌রে তু‌লে‌ছিল, তি‌নি দ্রুত এর সমাধান চাইছি‌লেন। কিন্তু মার্কসবা‌দে শর্টকাট রাস্তা নেই, দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম দরকার জনগণ জা‌গি‌য়ে তুল‌তে, সমাজত‌ন্ত্রের প‌থে নি‌য়ে আস‌তে। বল‌তে গে‌লে তথাক‌থিত ক‌মিউনিস্ট‌ শাসকদের স‌ঙ্গেই প্রথম বি‌রো‌ধে জ‌ড়ি‌য়ে‌ছিল নকশালবা‌ড়ি, সেখান থে‌কেই নকশাল আন্দোল‌নের জন্ম। তথাক‌থিত ক‌মিউনিস্ট‌দের জোট সরকারই প্রথম জনগ‌ণের ওপর গু‌লি চালায় জঙ্গলমহ‌লে। ভার‌তের ক‌মিউস্টি পা‌র্টির নানা কর্মসূচির পর এটা এখ‌নো প্রশ্ন, ভার‌তে স‌ত্যিই ক‌মিউনিস্ট পার্টি আছে কি না। কারণ ভার‌তেও সাম‌্যবাদীরা নানা দল উপদ‌লে বিভক্ত। তাঁ‌দের পু‌লিশ নি‌র্দ্বিধায় জনগ‌ণের বু‌কে গুলি চালায়। সাম‌্যবাদীরা প্রায় সক‌লেই সংসদীয় প‌থে বিপ্লব কর‌তে চান। সেই ল‌ক্ষ্যে কখ‌নো কং‌গ্রেস, কখ‌নো বি‌জে‌পির স‌ঙ্গে ভিত‌রে বাইরে তাঁরা জোট তৈ‌রি ক‌রেন।

মার্কসবাদীরা অনেকেই ধর্মকর্মে অনেক আস্থাবান। বিলাস‌ী জীবন যাপ‌নে অভ্যস্ত। বহু দ‌লে বিভ‌ক্তির কারণ কী তা‌দের? ক্ষমতার ভাগ ও মার্কসবাদী চিন্তা সম্প‌র্কে বিভ্রা‌ন্তি। কিছু ক্ষে‌ত্রে য‌তটা বিভ্রা‌ন্তি তার চে‌য়ে বে‌শি ক্ষমতায় টি‌কে থাকার ভোগ‌বিলাস করার স্বার্থ বা ইচ্ছা। প‌শ্চিমব‌ঙ্গের একদা সম্মা‌নিত জ্যো‌তি বসু য‌তটা না কং‌গ্রেস বি‌রোধী ছি‌লেন, তার চে‌য়ে বহু গুণ নকশাল বি‌রোধী ছি‌লেন।

বাংলা‌দে‌শের ব‌াম রাজনী‌তি ও সাম‌্যবাদী‌দের চিন্তা কি এর চে‌য়ে আলাদা ছিল? ভার‌তের রণদী‌ভের আম‌লে বাংলা‌দে‌শের সাম‌্যবাদী মু‌নির চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল মুতি শরফু‌দ্দিন রবীন্দ্রবি‌রোধী হ‌য়ে গি‌য়ে‌ছি‌লেন। রবীন্দ্রনাথ‌কে পঞ্চা‌শের দশ‌কের শুরু‌তে তাঁরাও প্রতি‌ক্রিয়াশীল ব‌লে তকমা দি‌য়ে‌ছি‌লেন। পরবর্তী‌তে সাম‌্যবা‌দে বিশ্বাসী‌দের চীনপন্থী ম‌স্কোপন্থী বি‌ভেদ, ভিন্ন দি‌কে এই দু’প‌ক্ষের বিরু‌দ্ধে আবার অতিবিপ্লবী‌দের গোপন রাজনী‌তি, সিরাজ সিকদা‌রের সর্বহারা আন্দোলন, ক‌মিউনিস্ট প‌া‌র্টির সংসদীয় রাজনী‌তি‌তে আস্থা স্থাপন, সরকা‌রের স‌ঙ্গে আঁতাত গ‌ড়ে তোলা; সব‌কিছুই ঘ‌টে‌ছে বাংলা‌দে‌শে। স‌ত্যি বল‌তে, এদের কা‌রোরই কি মার্কসবাদ নি‌য়ে গভীর পড়াশুনা ছিল? তার কো‌নো প্রমাণ কি আছে? মার্কসবাদ সম্প‌র্কে তাদের কা‌রোর কি উচ্চমা‌নের কিছু রচনা আছে? সক‌লেই তাঁরা ক‌মিউনিস্ট হবার কথা ঘোষণা দি‌য়ে‌ছেন, ক‌মিউনিস্ট দ‌লের নেতা ব‌নে‌ছেন মার্কসবাদ সম্প‌র্কে স্পষ্ট ধারণা ছাড়াই। তাঁ‌দের চিন্তা, তাঁ‌দের লেখা‌লে‌খি, তাঁ‌দের প‌রিকল্পনা, তাঁ‌দের দ্বিধা, বিভ‌ক্তি সব‌কিছু তাই প্রমাণ ক‌রে।

বহু ক‌মিউনিস্ট নেতা উত্তরকা‌লে সরকারি দ‌লের লেজুরবৃ‌ত্তি ক‌রে‌ছেন, সরকারি দ‌লে যোগ দি‌য়ে মন্ত্রী হ‌য়ে‌ছেন, সরকারি দ‌লের দালালি ক‌রে‌ছেন এবং আবার সু‌বিধা মতন সরকা‌রের বি‌রো‌ধিতা ক‌রে বিপ্লবী সে‌জে‌ছেন। বাংলা‌দে‌শে কি মার্কসবাদী ধ‌্যান-ধারণায় গভীরভা‌বে উপল‌দ্ধিসম্পন্ন এমন কো‌নো ব‌্যক্তি আছেন যি‌নি সক‌লের কা‌ছে গ্রহণ‌যোগ‌্য? সমা‌জে ঘটমান সব‌কিছুর তাৎক্ষ‌ণিক মার্কসবাদী ব‌্যাখ‌্যা দি‌তে পা‌রেন? সততা ও সাধারণ জীবন যাপন করা অবশ‌্যই মার্কসবাদী হবার এক‌টি প্রধান দিক। সব‌চে‌য়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হ‌চ্ছে, দ্বা‌ন্দ্বিক বস্তুবাদ সম্প‌র্কে গভীর জ্ঞান ও প্রতি‌টি ক্ষে‌ত্রে তা প্রয়োগ কর‌তে পারা। দ্বা‌ন্দ্বিক বস্তুবাদ সম্প‌র্কে গভীর জ্ঞান ছাড়া য‌তই নি‌জে‌কে বিপ্লবী ব‌লে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হোক সেটা একটা হাস‌্যকর উপল‌ব্ধি মাত্র। সে কার‌ণে বাংলা‌দে‌শে যু‌ক্তিবাদ পর্যন্ত প্রতি‌ষ্ঠিত হ‌তে পারে‌নি, সব‌কিছুর শেষ নিয়‌তি হ‌য়ে দাঁড়ায় ধর্ম বা বহুজা‌তিক‌দের কা‌ছে আত্মসমর্পণ। বাম থে‌কে সরকারি দ‌লের দি‌কে, ক্ষমতার দি‌কে, আত্মপ্রচা‌রের দি‌কে ধা‌বিত হওয়া।

বর্তমান বি‌শ্বে মানুষ ভয়াবহ নিষ্ঠুর নির্যাত‌নের শিকার হ‌চ্ছে, স‌র্বোচ্চ রকম শোষ‌ণের শিকার হ‌চ্ছে, মানুষ চরম দরি‌দ্রের ম‌ধ্যে দিন কাটা‌চ্ছে, দ‌লিতরা অস্পৃশ‌্যরা অনেক সময় মানুষ হি‌সে‌বেই গণ‌্য হ‌চ্ছেন না। সারা‌বি‌শ্বের এইসব বৈষম‌্য বহু মানুষ‌কে ক্ষুব্ধ ক‌রে। যখন যন্ত্র সভ‌্যতা এলো, নানারকম প্রযু‌ক্তিগত উন্ন‌তি‌তে যখন বি‌ভিন্ন কারখানায় যন্ত্র বা মে‌শিন বস‌লো, শ্রমিকরা কাজ হা‌রি‌য়ে বেকার হ‌য়ে প‌ড়ে‌ছিল। শ্রমিক‌দের রাগ গি‌য়ে প‌ড়ে‌ছিল য‌ন্ত্রের ওপর। শ্রমিকরা তখন রা‌গে ক্ষো‌ভে যন্ত্র ভাঙতে আরম্ভ ক‌রে। কিন্তু তা‌তে শ্রমিক‌দের লাভ হয়‌নি কিছুই। মার্কস পরবর্তীকা‌লে ম‌নে কর‌লেন, শ্রমিক‌দের ক্ষোভ যৌ‌ক্তিক ত‌বে এই যন্ত্রভাঙাটা সমস‌্যার সমাধান নয়। মার্কস তার সমাধান চাইলেন। সারাটা জীবন লেখাপড়া আর লড়াইয়ের মা‌ঠে কাটা‌লেন সেই সমস‌্যার সমাধা‌নের পথ খুঁজ‌তে। প্রচুর চিন্তা আর লেখা‌লে‌খি রে‌খে গে‌লেন পরবর্তী মানু‌ষের জন‌্য। বিপ্লব করার আকাঙ্ক্ষা নি‌য়ে লে‌নিন তাই একইভা‌বে পড়াশুনা আরম্ভ কর‌লেন, মার্ক‌সের রচনাগু‌লি পড়‌লেন।

মাও সে তুং প্রথম বিপ্লব কর‌তে এসে নানান ভুল কর‌লেন। ব‌্যাপকভা‌বে মার্কসবাদ অধ‌্যায়ন ক‌রে নি‌জের চিন্তা‌কে শা‌ণিত কর‌লেন। কিন্তু আমরা লেখাপড়া না ক‌রে বিপ্লব কর‌তে চাই আর বারবার কানাগ‌লি‌তে আট‌কে প‌ড়ি। বিপ্লব করার লক্ষ‌্য আর আগায় না। শুধু ক্ষোভই প্রকাশ ক‌রি এবং বারবার ব‌্যর্থ হই।

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ