মারুফ ইসলামের গল্প ‘সুখের অসুখ’

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৬, ২০২০

অফিস ফিরতি চাকরিজীবীর দৃশ্য নাকি ফুটপাতজীবী ভিক্ষুকের দৃশ্য দিয়ে গল্পটা শুরু করব, এই সিদ্ধান্ত নিতে নিতে মধ্যরাত পেরিয়ে ভোর হলো। বৃক্ষশাখের পাতায় পাতায় শেষরাতের হিম জমে উঠল এবং সকালের সূর্যকিরণে তা মিলিয়েও গেল, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারলাম না আমি। শেষতক দুটো দৃ্শ্যকেই খারিজ করে দিয়ে আমি মতিন সাহেবের দৃশ্য দিয়ে গল্প লেখা শুরু করি।

ড. মতিন উদ্দিন খান এ গল্পের প্রধান চরিত্র। প্রধান চরিত্রকে দিয়ে গল্প শুরু করা নিশ্চয়ই দোষের কিছু নয়। গল্প শুরু হচ্ছে একটি ডাইনিং টেবিলের সামনে। সময় আনুমানিক সকাল সাড়ে দশটা। মতিন সাহেবের শরীরে তখনো নিশিপোশাক লম্বা গাউন। তিনি কোমরে গাউনের বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে দেখলেন, নাস্তা সাজানো হয়নি তখনো। ঘড়িতে তাকালেন—দশটা তেইশ মিনিট। এত বেলা হয়ে গেছে তবু তার জন্য নাস্তা প্রস্তুত হয়নি। দারা-পুত্র-পরিবার সকলে নিদ্রামগ্ন। মতিন সাহেব ঊনত্রিশটি কোম্পানির মালিক। প্রাণিকূলের মধ্যে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ দাবি করা কতশত মানুষ তাকে তোয়াজ করে চলে। অথচ নিজ বাড়িতেই যেন দু’পয়সা দাম নেই তার!

জব্বার! অ্যাই জব্বার! হুংকার ছাড়লেন মতিন সাহেব। গৃহকর্মী জব্বার ছুটে এলো। ভীত ভঙ্গিতে কম্পিত গলায় বলল, স্যার, এহন তো মাহে রমজান মাস!

মতিন সাহেব একটু লজ্জা পেলেন। অনেক কিছুই মনে রাখতে পারেন না ইদানীং। দিন কয়েক আগে স্ত্রীর নামটাও ভুলে গিয়েছিলেন। সংগোপনে ছুটে গিয়েছিলেন ডাক্তারের কাছে— ডক্টর ডক্টর, আমাকে উদ্ধার করুন। আমার স্ত্রী যদি কোনোক্রমে জানতে পারে যে, আমি তার নাম ভুলে গেছি, সংসার টিকবে না। বিরাট ক্যালেঙ্কারি হয়ে যাবে!

ডাক্তার হাস্যমুখে বলেছিল, চিন্তা করবেন না। এটা প্রবীণ বয়সী সমস্যা।
মতিন সাহেবের তখন মনে হয়েছিল, তিনি তো কখনো টাকা পয়সার হিসাব ভোলেন না। বার্ধক্যজনিত সমস্যা হলে তো সবই ভুলে যাওয়ার কথা। কী খেয়ে যে এরা ডাক্তার হয়েছে, খোদাপাক মালুম! প্রশ্নপত্র ফাঁশ হওয়া যুগের ডাক্তার মনে হয়। মতিন সাহেব ভীষণ বিরক্ত হয়ে পারিবারিক চিকিৎসক ডা. সাকলায়েনকে বিদায় করে দিয়েছিলেন।

এখন ভুলে গেছেন রমজান মাসের কথা। বিস্মিত ভ্রুযুগল কপালে তুলে বললেন, আচ্ছা, জব্বার, আমি কি সেহরি খেয়েছি?
জব্বার বলল, হ স্যার। খাইছিলেন।
মতিন সাহেব নিজকক্ষে ফিরে এসে একান্ত সহকারীকে ফোন করলেন—আজ আমার সিডিউল কী, অলোকেশ?
অলোকেশ বাবু বললেন, এগারোটায় সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং টিমের সাথে একটা মিটিং আর বিকেল তিনটায় একাউন্টস সেকশনের সাথে মিটিং আছে স্যার। আর সিঙ্গাপুরের ডেলিগেটসদের সাথে হোয়াটস অ্যাপে যে মিটিংয়ের কথা ছিল বিকেল পাঁচটায়, সেটা শিফট করে রাত ন‘টায় নেয়া হয়েছে স্যার।

মতিন সাহেব ফোন রেখে শরীর থেকে নৈশগাউন খুলে ফেললেন। এগারোটার মিটিংয়ের জন্য এখনই প্রস্তুত হতে হবে। হাতে খুব একটা সময় নেই। লকডাউনের এই সময় অবশ্য সব মিটিংই তিনি গুগল মিট, জুম অথবা হোয়াটস অ্যাপে করছেন।

‘হোয়াট অ্যাবাউট দ্যা অ্যাড? ছোট্ট একটা বিজ্ঞাপন বানাতে বলেছিলাম। ওটা কদ্দুর এগোলো?’ সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং টিমের কাছে জানতে চাইলেন মতিন সাহেব। টিম লিডার মেশকাতুর রহিম বলল, ‘সব রেডি স্যার। ফাইনাল এডিটিং চলছে। সন্ধ্যার মধ্যেই নামিয়ে ফেলতে পারব।’

কর্পোরেট চাকরিজীবীরা বসদের সামনে অকারণে গদগদ করে। অকারণে মুখে হাসি ধরে রাখে। অকারণে গলা খাদে নামায় আবার উপরে তোলে। পৃথিবীতে কার্যকারণহীন আচরণের যদি তালিকা করা হয় তবে তালিকায় একদম উপরের দিকে থাকবে এইসব কর্পোরেটজীবীদের আচরণ, তাতে সন্দেহ নেই। মেশকাতুর রহিম নামের এই চাকরিজীবী নিয়ম মেনেই গদগদ করছিল।

মতিন সাহেব বললেন, ‘দ্যাটস গ্রেট! যেভাবে বলেছিলাম স্টোরিটা সেভাবে সাজিয়েছ তো? মূল থিম হচ্ছে, তিনটা চরিত্র দেখাবা, একজন ভিক্ষুক, একজন ছাপোশা কেরানি আর একজন বড়লোক ব্যক্তি। এরা কেউই নিজের অবস্থানে সুখী নয়। সবশেষে ব্যাকগ্রাউন্ড ভয়েসে বলবা, আমরা যদি প্রত্যেকে নিজের অবস্থানে সুখী হই তাহলে পৃথিবী সুখী হয়ে উঠবে। ভয়েস শেষ হওয়ার সাথে সাথে স্ক্রিনে একটা লেখা ভেসে যাবে, জনসচেতনতায় খান গ্রুপ অ্যান্ড কোং। ওকে?

‘ওকে স্যার। আমরা সেভাবেই স্টোরি সাজিয়েছি।’ টিম লিডার বলল। ঠিক তখনই টিমের সবচেয়ে জুনিয়র অফিসার, তিন মাসও হয়নি যার চাকরির বয়স, সে বলে উঠল, ‘কিন্তু এটা কি জনসচেতনতামূলক কাজ স্যার? আমরা তো হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা মাস্ক দিচ্ছি না কিংবা কোভিড নাইন্টিন থেকে বাঁচতে কী করবেন এই টাইপের পরামর্শও দিচ্ছি না।’

মতিন সাহেব হাসলেন। বললেন, ‘আমরা মানুষকে মানসিকভাবে সচেতন হতে বলছি। তারা যেন মনের মধ্যে অসন্তোষ পুষে না রাখে। যা আছে তাই নিয়ে যেন সন্তুষ্ট থাকে। এটা কি সচেতনতামূলক বার্তা নয়?’

কেউ কোনো কথা বলল না। মিটিং শেষ হলো। মতিন সাহেব এরপর লম্বা সময় নিয়ে স্নান করলেন। বাথটাবে শুয়ে থাকতে থাকতে যোহরের আজান পড়ল। তিনি স্নান সেরে অজু করে নামাজ পড়লেন। তারপর দীর্ঘ সময় নিয়ে কোরান তেলাওয়াত করলেন। এরমাঝে ঘড়ির কাঁটা তিনটার কাছাকাছি চলে এলো। অলোকেশ বাবু ফোন করলেন। মতিন সাহেব ফোন রিসিভ করে বললেন, ‘হ্যাঁ, অলোকেশ, মনে আছে, মনে আছে। তিনটায় মিটিং তো, মনে আছে আমার।’ তিনি কোরান শরিফ বন্ধ করে তিনটার মিটিংয়ের জন্য প্রস্তুত হলেন।

একাউন্টস সেকশনের সঙ্গে মিটিং। মতিন সাহেব জানতে চাইলেন, ‘একাউন্টসের কী অবস্থা?’ অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক ফজলুল হক নিয়োগী বললেন, ‘আজ তেইশ তারিখ স্যার। আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এমপ্লয়ীদের বেতনের ব্যাপারে। হোয়াট সুড উই ডু ইন দিস প্যানডেমিক সিচুয়েশন?’

‘সবাই তো...’ বলতে গিয়ে কথা আটকে গেল মতিন সাহেবের। তিনি বিশ্রিভাবে গলাখাকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন। ইদানীং কি যে হয়েছে! একটু পরপর গলায় কফ জমে যায় তার। একটু পরপর গলাখাকারি দিতে হয়। বিশ্রি ব্যাপার! এটাও কি বয়সজনিত সমস্যা কিনা, বুঝতে পারছেন না মতিন সাহেব। তিনি বললেন, ‘সবাই তো হোম অফিস করছে, নাকি?’

ফজলুল হক নিয়োগী বললেন, ‘জি স্যার। আমাদের প্রত্যেক এমপ্লয়ী হোম অফিস করছে।’
‘দ্যাটস গুড।’ মতিন সাহেব বললেন।

ফজলুল হক নিয়োগী এবার কর্পোরেট নিয়ম মেনে গদগদ হয়ে উঠলেন। কণ্ঠ থেকে গলগল করে তেল ঝরিয়ে বললেন, ‘হোম অফিস করলেও আমাদের রেভিনিউ ফ্লো ব্রেক করেনি স্যার। থ্যাংকস গড যে আমরা রেভিনিউ স্ট্যাবল রাখতে পেরেছি।’

মতিন সাহেব আবারও গলাখাকারি দিলেন। পরিষ্কার গলায় বললেন, ‘ফিফটি পার্সেন্ট স্যালারি দিয়ে দেন।’
ফজলুল হক নিয়োগী বললেন, ‘ওকে স্যার। ওকে ওকে। আর একটা বিষয় স্যার, বোনাসের বিষয়টা... মানে ঈদ ফেস্টিভ্যাল ইজ নকিং অ্যাট দ্য ডোর।’

‘বোনাস বাদ দিন নিয়োগী সাহেব। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, অনেক প্রতিষ্ঠানই বোনাস দিচ্ছে না এবার। অনেকে তো বেতনই দিচ্ছে না। আমরা তা-ও ফিফটি পার্সেন্ট দিচ্ছি। আমাদের মতো সৎভাবে আর কে বিজনেস করে, বলেন?’

ফজলুল হক নিয়োগী বললেন, ‘অফকোর্স আপনার মতো অনেস্ট বিজনেসম্যান এ দেশে নাই স্যার। খান গ্রুপের সবকিছুই ট্রান্সপারেন্ট। আমরা যদিও হানড্রেড পার্সেন্ট স্যালারি ও বোনাস দিতে পারতাম, কিন্তু অন্যরা যখন দিচ্ছে না তখন আমরা কেন দিতে যাব? তাছাড়া ঝড়ের মধ্যেই আম কুড়াতে হয়, এটা তো ব্যবসায়িক নীতি স্যার। আমরা নিশ্চয়ই অন্যায় কিছু করছি না।’

মতিন সাহেব উৎফুল্ল গলায় বললেন, ‘একজ্যাক্টলি। এ জন্যই আপনাকে এত পছন্দ করি নিয়োগী সাহে। ইউ আর টু মাচ ব্রিলিয়ান্ট।’

প্রশংসা শুনে ফজলুল হক নিয়োগী সামান্য লজ্জাবোধ করলেন। বারবার তোতলাতে তোতলাতে বলতে থাকলেন, ‘নো নো... আই অ্যাম নট ব্রিলিয়ান্ট স্যার... আই অ্যাম নট... ইটস ওকে স্যার, ইটস ওকে স্যার।’ তারপর বললেন, ‘আমরা গবমেন্টের কাছে একটা প্রণোদনার অ্যাপ্লাই করেছি স্যার। হোপ সো, ইনটেনসিভটা আমরা পেয়ে যাব।’

মতিন সাহেব বললেন, ‘দ্যাটস ফাইন। অসরের নামাজের সময় হয়ে এলো মনে হয়, না? আমি তাহলে উঠি নিয়োগী সাহেব। আপনারা প্রয়োজনে মিটিং কন্টিনিউ করেন।’

ড. মতিন উদ্দিন খান এরপর আসরের নামাজ পড়লেন। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা কেউ এর মাঝে তার খবর নিল না। তারা জানে মতিন সাহেব অফিসের কাজে ব্যস্ত আছেন। তারা এটাও জানে, আসরের নামাজের পর মতিন সাহেব ঘুমাবেন। এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। ঘুম থেকে উঠবেন ঠিক মাগরিবের সময়।

আজও তার ব্যত্যয় হলো না। মতিন সাহেব মাগরিবের একটু আগে ঘুম থেকে উঠলেন। ইফতারের আগে ডাইনিং টেবিলে দেখা হলো পরিবারের লোকজনের সঙ্গে। মতিন সাহেব পুত্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন, পড়ালেখার খবর কী? ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া পুত্র জানালো, ‘গোয়িং অন স্মুথলি।’ মতিন সাহেব প্রত্যুত্তরে স্মরণ করিয়ে দিলেন, ‘শুধু স্মুথলি চললেই হবে না।  সোহরাব সাহেবের ছেলের খবর জানো তো? মিডলসেক্স ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। ব্যাপারটা মাথার মধ্যে গেঁথে নাও। যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট হইয়ো না।’

এরপর কন্যার দিকে তাকালেন। কন্যা ছোটবেলা থেকেই পিতাকে ভয় পায়। সে বাবার দিক থেকে চোখ নামিয়ে বলল, আমার ইন্টার্নশিপ শেষ হয়ে যেত এই জুনেই। কিন্তু লাকডাউনের কারণে...।

মতিন সাহেব বললেন, ‘তা ঠিক আছে। এক সময় লকডাউন শেষ হবে, ইন্টার্নশিপ শেষ হবে, তারপর কী করবে ভেবেছ? ভেবে আমাকে জানাও। আর তোমাকেও বলি, নিজের অবস্থান নিয়ে কখনো সন্তুষ্ট হইয়ো না।’

এরই মধ্যে আজান পড়ল। ইফতার সেরে এবং মাগরিবের নামাজ আদায় করে একগাদা ফাইলপত্র নিয়ে বসলেন মতিন সাহেব। নয়টার মিটিংয়ের আগে একটু ব্রেন স্টোর্মিং করা দরকার। সিঙ্গাপুরের বিজনেসটা চলছে বটে, তবে প্রফিট মার্জিনটা আরও হাই করা দরকার। সোহরাব সাহেব সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় পাঁচ নম্বরে ঢুকে গেল, অথচ মতিন সাহেব এখনো পঞ্চাশের মধ্যেই ঢুকতে পারলেন না, এটা মানা যায়? গড়ান ব্রিজের টেন্ডারটা পেলে একটা বড় দান মারতে পারতেন। মন্ত্রী, সচিব, পিডি—সবাইকেই কয়েক কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে রেখেছেন, তবু কেন যে টেন্ডারটা ঝুলে আছে বুঝতে পারছে না। আরে ভাই, আরো ঘুষ চাইলে আরো দেব। কত চাস তোরা বলবি তো?

মতিন সাহেব গড়ান ব্রিজের ফাইলে একটা লাল কালির দাগ দিয়ে আলাদা জায়গায় সরিয়ে রাখলেন। তারপর মোবাইলে ফাইলটার ছবি তুলে সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজারের হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিলেন। ছবির সঙ্গে লিখলেন, হাউ ফার দ্য প্রোগ্রেস অ্যাবাউট দিস? তিনি অবশ্য ভুলে গেছেন এখন রাত আটটা পেরিয়ে গেছে, এটা অফিস আওয়ার নয়। অফিস আওয়ারের বাইরে এমপ্লয়িদের নক করা অভদ্রতা, এটা প্রায়সই ভুলে যান ড. মতিন উদ্দিন খান।

ঘড়ির কাঁটা ন‘টার সন্নিকটে। তিনি মিটিংয়ের জন্য প্রস্তুত হলেন। সিঙ্গাপুরের এক রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিটিং। মালয়েশিয়ায় মতিন সাহেব একটা বাড়ি কিনেছেন। এবার সিঙ্গাপুরেও একটা কিনতে চান। সেসব নিয়েই মিটিং আর কি। তিনি দেশের উঠতি শিল্পপতিদের একজন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাইয়ে বাড়ি না থাকলে কী হয়? তার অবস্থান তো প্রমাণ করতে হবে, নাকি?

ড. মতিন উদ্দিন খান মিটিং শেষ করে মেইল চেক করলেন। বাহ! মার্কেটিং টিমের লিডার মেশকাতুর রহিমের মেইল এসেছে। সে ভিডিওটা পাঠিয়েছে। মতিন সাহেব ভিডিও ফাইল ওপেন করলেন। শুরুতেই দেখা গেল, একজন ভিক্ষুক ফুটপাতের উপর শুয়ে আছে। তার সামনে দাঁড়ালো একটি রিকশা। রিকশা থেকে নামল এক যুবক। হাতে এক কাদি কলা। ভিক্ষুককে দেখে মায়া হলো তার। সে কলার কাদি দিয়ে দিল ভিক্ষুককে। ভিক্ষুক কলা খেয়ে আবার ফুটপাতে শুয়ে পড়ল। তার চোখের সামনে বিশাল এক বিল্ডিং। সে বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে আফসোস করে বলল, আহারে! আমার যদি একটা ঘর থাকত। আমি একটু আরাম করে ঘুমাইতে পারতাম! দৃশ্য শেষ।

পরের দৃশ্যে দেখা গেল রিকশার ওই যুবক নিজের বাসায় ঢুকছে। ঢোকার পরই স্ত্রী জানাল বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়ার জন্য যা তা বলে গেছে। যুবকের মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে ততক্ষণাৎ বাড়িওয়াল কাছে গিয়ে নরম সুরে বলল, এ মাসে বেতন পেতে একটু দেরি হচ্ছে, চারিদিকে লকডাউন তো। বেতনটা পেলেই সে ভাড়া দিয়ে দিবে। কিন্তু বাড়িওয়ালা যুক্তি শুনতে নারাজ। আজই তার ভাড়া চাই। না হলে এক্ষুণি বাসা ছাড়তে হবে। বিষণ্ণ মনে বাসা থেকে বের হয়ে আসে যুবক। আর মনে মনে বলে, তার যদি একটা নিজস্ব ফ্ল্যাট থাকত তাহলে বাড়িওয়ার অপমান সইতে হতো না।

তৃতীয় দৃশ্যে দেখা গেল ওই প্রতাপশালী বাড়িওয়ালা বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। তার ঘুম আসছে না। কাজের লোককে বলছে ঘুমের ওষুধ দিতে। বাড়িতে আর কেউ নেই। বাড়িওয়ার ছেলেমেয়ে সব বিদেশে থাকে। সে বিছানা থেকে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরের ফুটপাতে দেখতে পায় একটা ভিক্ষুক নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। বৃদ্ধ বাড়িওয়ালা তখন মনে মনে বলছে, আমার এত কাড়ি কাড়ি টাকা আছে, আরামের বিছানা আছে তবু ঘুম আসে না। আহা ওই ভিক্ষুকের মতো যদি ঘুমাতে পারতাম।

দৃশ্য শেষ। স্ক্রিন কালো হয়ে গেল। ব্যাকগ্রাউন্ড ভয়েসে ভেসে এলো—আমরা যদি প্রত্যেকে নিজের অবস্থানে সুখী হই তাহলে পৃথিবী সুখী হয়ে উঠবে। ভয়েস শেষ হওয়ার সাথে সাথে স্ক্রিনে একটা লেখা ভেসে উঠল— জনসচেতনতায় খান গ্রুপ অ্যান্ড কোং। ভিডিওটি নিজের ফেসবুকে ওয়ালে পোস্ট করে ঘুমিয়ে পড়লেন ড. মতিন উদ্দিন খান।