মারুফ ইসলামের গল্প ‘যত ক্ষত যত ক্ষতি’

প্রকাশিত : জুলাই ১১, ২০২৩

এখন তাহলে কী করা যায়?
প্রায় মিনিট দশেক বাক্যহীন থাকার পর শাওন হঠাৎ এই উদ্বেগঠাসা প্রশ্ন আহুত সমাবেশের দিকে ছুড়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে সম্ভাব্য প্রতিক্রয়ার। সবার মাথা তখনও ঝুঁকে আছে ভূমির দিকে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মতো।

 

সন্ধ্যা পালাই পালাই করছে ধানমণ্ডির এই রবীন্দ্র সরোবরের জনকল্লোল থেকে। ডানা মেলা শকুনের মতো ধীর পায়ে নেমে আসছে রাত। শাওন একবার দক্ষিণে, একবার উত্তরে দৃষ্টিটাকে ঘোরালো। অন্যদিন হলে বুকের অতল থেকে হতাশ্বাস টেনে কাঙালের গলায় বলত, জোড়া জোড়া ভালোবাসায় লেক ছয়লাব হয়ে গেলরে! আজ অবশ্য কিছুই বলল না। আজকের পরিবেশটা ঠিক মজা করার অনুকূলে নয়। রবীন্দ্র সরোবরের বামপাশের এই কড়ই গাছের নিচের আড্ডাটা আজ লেকের জলের মতোই নিস্তরঙ্গ। আড্ডাস্থ চার তরুণের প্রত্যেকের অন্তরে আজ হুলুস্থুল অশান্তি। উদ্বেগের পাথরে খোদাই করা যেন এক একটি মুখ। শাওন তাই পূর্ববৎ সওয়ালের মই বেয়ে কিঞ্চিৎ ওপরে উঠে বলল, ওর বাড়িতে মনে হয় ব্যাপারটা জানানো উচিত।

 

ক্রুশবিদ্ধ একটা মাথা সোজা হলো এবার। মাথাটা সঞ্জুর। এক রাতের ঘুমশূন্য লালাভ চোখজোড়া সরাসরি স্থাপন করল শাওনের ওপর। তারপর কুয়োর জলের মতো শীতল আর গভীর কণ্ঠে বলল, উচিত হবে না।

 

শাওন বলল, কিন্তু খালাম্মা তো এক সময় ঠিকই জেনে যাবে, নাকি?
হ্যা, হ্যা..ফরহাদ মুখ থেকে কুলুপ সরায় এবার। ‘শাওন ঠিকই বলেছে।’
‘আচ্ছা থানায় একবার...’ জাহিদ ধুলোপড়া রেকর্ড বাজানো স্বরে কী একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সঞ্জু অকস্মাৎ নেড়ি কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে ওঠে--তুই থাম তো! যেটা বুঝিস না সেটায় নাক গলাতে আসিস না! তারপর অনাবশ্যক গলাখাকারি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করার ভান করে সমবেত সভাসদদের উদ্দেশে বলে, থানা-পুলিশ কিংবা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে গেলে ঝামেলা আরও বাড়বে। আর খালাম্মাকে জানানোর কথা বলছিস, উনি গ্রামে থেকে করবেনটা কী বল, শুধু শুধু টেনশন করা ছাড়া?

 

কারও মুখে কোনো কথা নেই। যেন মোক্ষম যুক্তি ছুঁড়েছে সঞ্জু। সে যুক্তির চপেটাঘাতে কাবু সবাই।

 

কিছুক্ষণ নীরব থেকে শাওন এবার কাহিল কণ্ঠে কৌতুহল ফুটিয়ে তুলল, আচ্ছা ওই হিন্দু মেয়েটার কাছে যায়নি তো?
‘না যায়নি।’ ফরহাদ তৎক্ষণাৎ শাওনের কৌতুহলের বেলুনে সুঁচ ফুটিয়ে বলল, কাল রাতেই খোঁজ করেছি ওখানে।

 

শাওন চুপসে গেল হাওয়াশূন্য বেলুনের মতো।
এদিকে কোন ফাঁকে রাত্রি ঝপাৎ করে অন্ধকারের জাল ফেলেছে প্রকৃতিজুড়ে টের পায়নি এরা কেউ। লেকপাড় ফাঁকা হয়ে গেছে অনেকটাই। যুগল অভিসার অন্তে ভালোবাসারা ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। আকাশজুড়ে কৃষ্ণমেঘের আড্ডাবাজি। দুই দিন যাবৎ কী যে আয়োজন করছে ওরা, তা ওরাই জানে।

 

সঞ্জু একবার আকাশ পানে চাইল, একবার এই বেদনার পানে। কী করবে এখন সে। অনেক কবিতা লেখার সময় তো এখন নয়।

 

জাহিদ হঠাৎ অনভ্যস্ত কণ্ঠে গলাখাকারি দিয়ে সমবেত উপস্থিতির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল। তরপর সরাসরি ধান ভানা বাদ দিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে শীবের গীত গেয়ে যা বোঝালো তার মমার্থ অনেকটা এরকম: আজকের রাতটা অন্তত অপেক্ষা করা যাক। তারপর আগামীকাল অবস্থা বুঝে চূড়ান্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে।

 

সঞ্জু এবার পূর্ববৎ খেঁকিয়ে উঠল না। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করল। জাহিদের প্রস্তাবটা মনে হয় মনঃপুত হয়েছে। ওর দেখাদেখি ফরহাদ, শাওন আর জাহিদও উঠে দাঁড়াল। এবং কোনো রকম বিদায়-জাতীয় আনুষ্ঠানিকতায় না গিয়ে যে যার গন্তব্যে পা বাড়াল।

 

২.
এদের মনের প্রান্তরজুড়ে ঝুঁকেপড়া মেঘাক্রান্ত আকাশ; চোখমুখজুড়ে বিপন্নতার কালিঝুলি। এদের অসহায় অভিমানী বিপর্যস্ত চেহারায় ফুঁটে আছে সদ্য বানভাসি কৃষকের লÐভÐ শস্যখেত। এদের এক বন্ধু রাজু, লাপাত্তা তিন দিন যাবৎ। এরা তাই ফের সমবেত হয়েছে এই রবীন্দ্র সরোবরস্থ কড়ইতলায়। সঞ্জু, শাওন, জাহিদ, ফরহাদ।
‘তিনটা দিন কিন্তু পার হয়ে গেল।’
‘হ্যাঁ, দেখতে দেখতে তিনটা দিন...! এভাবে আর বসে থাকা ঠিক হচ্ছে না।’
‘কী করবি তাহলে?’
‘অন্তত খালাম্মাকে জানানো দরকার। আফটার অল তিনিই রাজুর অভিভাবক।’
হুমম...। পকেট থেকে সঞ্জু সেলফোনটা বের করে। ‘হ্যালো, আমি ঢাকা থেকে রাজুর বন্ধু বলছিলাম। রাজুর আম্মাকে একটু ডেকে দেয়া যাবে?’
‘জি, আচ্ছা... আচ্ছা...।’
কী বলল রে?
পাঁচ মিনিট পর ফোন দিতে বলল।

 

লেকের এ পাশটা আজও সরগরম। চানাচুরওয়ালা হেঁকে যাচ্ছে চানাচুররররর...। ওজনমাপক যন্ত্র ডেকে যাচ্ছে ওয়েল কাম... ওয়েল কাম...। ল্যাম্প পোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে দুটি পথকিশোর উপভোগ করছে প্রেমিক-প্রেমিকাদের খুনসুটি। লেকের ও-পাশে মসজিদের মাথায় বিশাল একখণ্ড চাঁদ। আকাশ গঙ্গায় জোছনার লুটোপুটি। শুধু এখানে এই কড়ইগাছের তলায় মা কালীর চুলের মতো একরাশ অন্ধকার। বিষাদিত কয়েকটা জীবন। ঝড়াপাতার করুণ বিউগল...।

 

রাত বাড়ে। বাড়ন্ত রাতের বুক চিরে ভেসে যায় পড়শি বাতাস আর সিকিউরিটি গার্ডের বাঁশির শিস। স্তব্ধ, বিবশ এ চারটি প্রাণী যেন তার কিছ‚ই টের পায় না।

 

৩.
সঞ্জুর আশঙ্কাই সত্যি হলো। রাজু নিখোঁজ হওয়ার পঞ্চম দিনের মাথায় ঘটল আরেকটি দুর্ঘটনা। রাজুর মায়ের দুর্বল হৃৎপিণ্ড একমাত্র ছেলে হারানোর এত বড় বেখবরটি নাকি সইতে পারেনি। তাই ছেচল্লিশ বছর বয়সেই বার্ধক্য চেপে বসা হৃৎপিণ্ডটা টুপ করেই বন্ধ করে দিয়েছে তার যাবতীয় কার্যকলাপ। খবরটি জানালো রাজুর গ্রামের সেই ফোন-ফ্যাক্স দোকানি।

 

সঞ্জু এখন কী করবে? এক ঘোরলাগা অবসন্নতায় কেটে গেল কয়েকটি মুহূর্ত। তার পর এক সময় সেল ফোনটি তুলে নিল হাতে। একে একে ডায়াল করল শাওন, ফরহাদ ও জাহিদকে। ‘আধ ঘণ্টার মধ্যে চলে আয় কল্যাণপুর বাস কাউন্টারে। রাজুর গ্রামে যেতে হবে।’

 

৪.
এদের মাথার ভেতর ধসে পড়া পাহাড়, চোখের ভেতর লবন-পানির কোলাহল আর মনকে ঘিরে দানাদার বিমূঢ়তা। এরা ফিরছে রাজুর মায়ের শেষকৃত্য শেষে। ট্রেনের কামরায় মুখোমুখি চারটি প্রাণী। সঞ্জু, শাওন, জাহিদ, ফরহাদ। অবশেষে শাওনই স্তব্ধতা ভাঙে। ‘ঈশ্বর কেমন নিষ্ঠুর দেখেছিস!’ সঞ্জুর চোখ তখন জানালার বাইরে। সেদিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই বলে, ‘তার হিসাবগুলোও বড় গোলমেলে।’ ফরহাদ আচমকা গান ধরে, ‘কী খেলা খেলিছ তুমি শূন্যেতে বসিয়া...।’ জাহিদের হঠাৎ কী হয় কে জানে, ও চুপচাপ উঠে গিয়ে দরজার হাতল ধরে দাঁড়ায়। কালো চিতার মতো নিকষ আঁধার ঠেলে গোঁ গোঁ শব্দে এগিয়ে চলছে জান্তব ট্রেন। পথের পাশের ঝোপ-ঝাড়জুড়ে জোনাক পোকার আলোর উৎসব। ঝিঁঝিঁপোকার করুণ কোরাস। সেদিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে জাহিদ।

 

খানিক পর সঞ্জু উঠে আসে। হাতের আড়াল করে বাতাস বাঁচিয়ে সিগারেট ধরায়। তারপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, কী ভাবছিস?
‘রুপু (রাজুর বোন) এখন কী নিয়ে বাঁচবে, ভেবে দেখেছিস? বাপ তো সেই কবেই মরেছে। ভাইটাও নিখোঁজ হলো। ছিল এক মা, সে-ও মরে গেল!’
সিগারেটে টান দিতে গিয়ে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সঞ্জু। ‘মেয়েটা কেমন পাথর হয়ে গেছে দেখেছিস? একেকটা মানুষ যে কী পরিমাণ দুঃখ নিয়ে পাথর হয়!’ আরও একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে সঞ্জুর।
‘রাজুর ওই জ্ঞাতি চাচা তো বললেন, তিনিই এখন দেখবেন রুপুকে।’
‘কত দিন দেখেন সেটাই দেখার বিষয়!’
‘হুমম...’ বলে জাহিদ নিরবে হাত বাড়ায় সঞ্জুর দিকে। ‘সিগারেট দে।’
কোন অজান্তে শাওন আর ফরহাদ এসে দাঁড়িয়েছে এদের পেছনে এরা জানেনি। চারটি প্রাণী ফের মৌনতার সাধনায় ধ্যনস্থ হয়।

 

৫.
ঢাকায় ফেরার পর কেটে গেল আরও দুই দিন। সময়ের চোরা স্রোত তলে তলে পলি জমিয়ে তুলছে। খুব শিগগিরই চর জাগিয়ে তুলবে সন্দেহ নেই।
অতঃপর তৃতীয় দিন। রোদাক্রান্ত এক দুপুর। বাতাস অগ্নিময়। ঢাকা আজ প্রবল লু হাওয়ার, সেই সঙ্গে উজ্জ্বল রোদের। হঠাৎ দরজায় করাঘাত--ঠক ঠক। অনেকটা অবহেলা অনেকটা বিরক্ত নিয়ে দরজা খোলে সঞ্জু।
‘এখানে কি সঞ্জু নামের কেউ থাকেন?’
‘আমিই সঞ্জু।’
‘আপনার একটা চিঠি আছে।’
ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা বিদেশি খাম বের করে দিয়ে বিদায় নেয় পিয়ন। খামটা ছিঁড়তে গিয়ে অপরিসীম উত্তেজনায় হাত কাঁপে সঞ্জুর। অতঃপর...

 

দোস্ত!
কেমন আছিস তোরা? আমাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তাই না? প্লিজ, ভুল বুঝিস না আমাকে। আমি এক আত্মপীড়িত দোপেয়ে প্রাণী; কিন্তু বেড়ে উঠেছি চতুষ্পদ জন্তুর মতো। আমায় নিয়ে ভাবিস না তোরা। মানুষের মতো দেহ নিয়ে আমি এক অদ্ভ‚ত প্রাণী--প্রতি মহুর্তে আত্মপীড়িত। আমি পীড়িত বোধ করি আমার মায়ের জন্য, আমি পীড়িত বোধ করি আমার বোনের জন্য। তোরা তো জানিস, বাবা মারা যাওয়ার পর মা কী নিদারুণ কষ্ট সয়ে আমাকে লেখাপড়া করিয়েছে! তার চাওয়া ছিল শুধু এটুকু, একদিন তার সন্তান তার চোখের কোণের শীর্ণ অশ্রুধারাটুকু মুছিয়ে দেবে। তোরা জানিস, সে চেষ্টার পথে কী প্রাণান্ত হেঁটেছি আমি। একটা চাকরির জন্য কত জোড়া জুতার শুকতলা ক্ষয় করেছি তোরা তো সাক্ষি! কী পেয়েছি, বল? শুধু চোখভরা জল আর পাঁজর কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস ছাড়া?
বোনটার বিয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে। মায়ের অসুস্থতা দিন দিন বাড়ছে। আমার তাই আত্মপীড়ন বাড়ে। শেষমেশ কোনো ক‚ল না পেয়ে একটা কিডনি বিক্রি করে চলে এলাম দুবাই। রাজ মিস্ত্রিদের হেলপার হিসেবে কাজও পেয়েছি একটা।
অনেক দিন ধরেই এসব গোছাচ্ছিলাম আমি। কিন্তু তোদের কাউকেই জানাইনি। ব্যাপারটা তোরা সহজভাবে নিবি না বলে। এ ছাড়া আমার কী-ই বা করার ছিল বল? এই বিচিত্র পৃথিবীতে অনেকেরই অনেক কিছু আছে, কিন্তু আমার যে কিচ্ছু নেই এক মা আর বোন ছাড়া!
শোন, মাকেও একটা চিঠি লিখেছি। তবু তোরা মাকে একটু বুঝিয়ে বলিস। মায়ের দুঃখঘোচাতেই তো আমার এত দূর আসা...।

 

সঞ্জু আর পড়তে পারে না। দ্রুত পা বাড়ায় বেসিনের দিকে। চোখ জোড়ায় লোনা জলের উৎসব শুরু হয়েছে। মাথার ভেতর ইতিমধ্যেই ধসে পড়েছে পাহাড়।