মারুফ ইসলামের গল্প ‘পুত্র পিতাকে’

প্রকাশিত : জুন ১৬, ২০১৯

খুব বেশি দিন যে বাড়িছাড়া ছিলাম তা নয়। এই তো এপ্রিলের মাঝামাঝি গেলাম আর ফিরে এলাম ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। মাঝখানে আট মাস।

আটটি মাস মাত্র। অথচ এর মধ্যেই কত কিছু ঘটে গেছে। কত ওলট পালট! যে মাকে রেখে গিয়েছিলাম সেই মা নেই, আছে নতুন এক মা। যে বাবাকে রেখে গিয়েছিলাম সেই বাবাও নেই, আছে এক অন্য বাবা।

কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল! এখন আমার মাথার ভেতর শুধুই স্মৃতি, চোখজুড়ে ভাঙনের ঢেউ। আমার কেবলই মনে হয়, এই বুঝি একটা শক্ত হাত আলতোভাবে নেমে আসবে আমার মাথার ওপর আর একটা ভরাট কণ্ঠ বলে উঠবে, ‘কষ্টে ভেঙে পড়তে নেই খোকা...।’

এমনিভাবে অনেকবারই আপনি আমার মাথায় হাত রেখেছেন, কাঁধে হাত রেখেছেন, বুকে জড়িয়ে ধরেছেন আর দৃঢ় গলায় বলেছেন, কষ্টে ভেঙে পড়তে নেই খোকা।
সেসব কী মনে পড়ে, বাবা? মনে পড়ে?

প্রথম স্মৃতিটা এক অমল ধবল শরৎকালের। ধুমছে চলছে শারদীয় দূর্গোৎসব। দশমীর দিন প্রতিমা দেখে আপনার সঙ্গে বাড়ি ফিরছি। আমার একহাত আপনার হাতের মুঠোয়, আরেক হাতে মেলা থেকে কেনা একটি মাটির ঘোড়া। ভারি সুন্দর। বারবার নেড়েচেড়ে দেখছি আর হাঁটছি। হঠাৎ হাত ফসতে ঘোড়াটা ধপাস! সাথে সাথে ঘোড়া নয়, যেন আমার বুকের অন্দরটাই চৌচির হয়ে গেল। কান্নায় দু চোখ ভারি হয়ে এলো। নাকের পাটা ফুলিয়ে ফোঁপাতে শুরু করলাম। ঠিক তখনই, আপনার মনে আছে বাবা, আমার দুচোখ মুছে দিয়ে বললেন, কষ্টে ভেঙ্গে পড়তে নেই, খোকা!

এরপরের স্মৃতি আরো করুণ। সেটা নির্দয় ম্যাট্রিক পরীক্ষার। নিশ্ছিদ্র নজরদারির মধ্যে চলছে পরীক্ষা, ঘাড় ঘুরালেই খাতা নেই! তবু এরমধ্যেই বামের জানালা পথে উড়ে এলো এক টুকরো কাগজ, পড়লো ঠিক আমার পায়ের উপকূলে। যেহেতু আমার কোনো শুভাকাঙ্খী নেই, বুঝে গেলাম পাশের ছাত্রের শুভাকাঙ্খীই ছুঁড়েছে নকলটি। কী করবো এখন? টুকরোটি যথাযোগ্য প্রাপকের হাতে তুলে দেব নাকি পদতলে চাপা দিয়ে রাখবো--সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই ম্যাজিস্ট্রেট হাজির। বেশ যত্নের সঙ্গে চিরকুটটি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলেন ভদ্রলোক। তারপর চোয়াল শক্ত করে আমার খাতার বুকে লাল কালিতে খসখস শব্দ তুলে কী যেন আঁচড় কাটলেন।

এরপর আর কী! ‘দূর হ’ টাইপ আচরণ করে আমাকে পরীক্ষার হল থেকে বের করে দেয়া হলো। আমি গুলি খাওয়া বাঘের মতো টলতে টলতে কেন্দ্রের বাইরে এলাম। আমার সামনের জগৎটা তখন বনবন লাট্টু কিংবা ঘূর্ণি হাওয়ায় ঝরা পতা। হটাৎ কী যে হলো, হাউমাউ শব্দে কেঁদে উঠলাম। আমাকে ঘিরে কৌতুহলী জনতার জটলা তৈরি হলো। ‘দ্যাখ দ্যাখ! ছেলেটা মনে হয় এক্সপেল হইছে!’ আরো জোরে কাঁদতে শুরু করলাম। ঠিক তখনই, মনে আছে বাবা, কোত্থেকে যেন ভিড়ের মাঝে উদয় হলেন আপনি; আমার কাঁধে হাত রাখলেন, বললেন, কষ্টে ভেঙ্গে পড়তে নেই খোকা!

পাশ করলাম পরের বছর। কলেজেও ভর্তি হলাম। গ্রামের কলেজ। তবু পয়লা দিনই চোখে পড়লো উল্লেখ করার মতো বেশ কিছু তরুণ তরুণী। সেদিন ক্লাস করতে গিয়ে কোনার দিকের শেষ বেঞ্চে বসে থাকা এক সুশ্রীতমার মুখের উপর চোখ আটকে গেল আমার। কী চমৎকার বাদামী চোখ, সোজা ভুরু, আপেলরঙা একটা মেয়ে।

আমার স্বপ্নের পালে হাওয়া লাগলো। আমি তাতে গুণটানা মাঝি হলাম। একা একাই এগিয়ে নিতে থাকলাম স্বপ্নতরী-‘পড়াটা শেষ করেই শহরে গিয়ে একটা ছোটখাটো চাকরি জুটিয়ে নেব। তারপর দুজনে ‘‘কবুল’’ বলব। ছোট্ট একটা সংসার হবে আমাদের। এবং অতি অবশ্যই সংসারটা হবে ‘‘তুমি-আমি, আমি-তুমি’’ মার্কা। কারণ, বাবা মা গ্রামেই থাকবেন। শত চেষ্টা করেও তাদের শহরে আনা যাবে না। এই নিয়ে প্রায়ই বাবা মার সঙ্গে মান অভিমান হবে আমাদের। আমরা অবশ্য ছুটির দিনগুলোয় ছুটে যাব গ্রামে। আমাদের দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে বাবা মার মুখ। সমস্ত অভিমান ভুলে মা মাটির চুলায় আগুন জ্বালবেন পিঠা বানাতে। বাবা জাল নিয়ে নামবেন পুকুরে, সবচেয়ে বড় মাছটি ধরতে।

এই স্বপ্ন এ পর্যন্তই। কে না জানে, সুখের স্বপ্ন কখনো দীর্ঘায়িত হয় না। আমারও হলো না। হঠাৎই দেশজুড়ে শুরু হলো ওলটপালট। স্বাধীনতা, মুক্তি, জয় বাংলা, মিলিটারি... কী সব নতুন নতুন শব্দ চারপাশজুড়ে। এতো এতো শব্দের উৎপাতে আমার ‘ভালোবাসা’ শব্দটি হারিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক।

স্বাভাবিক ঘটনাই ঘটলো। আমি মুক্তিদের খাতায় নাম লেখালাম। আপনি বাধা দিলেন, মা চোখের পানি নাকের পানি একাকার করলো, আমি ওসব কিছুই তোয়াক্কা করলাম না। বেয়াদবের মতো সামনেই পা বাড়ালাম। সেই প্রথম, মনে আছে বাবা, আমি আপনাদের অবাধ্য হলাম।

ফিরে এলাম দেশ স্বাধীন হলে। এই সময়ের স্মৃতি মানেই ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’। শূন্য ভিটা, বিরান বাড়ি। মা, মা বলে হাঁক ছাড়তে ছাড়তে উঠোনে পা রাখলাম। মা এলো না। মা’র বদলে ভাঙা দেউড়ি ঠেলে বের হলেন আপনি। আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বললেন, তোর মাকে মিলিটারি উঠাই নিয়া গেছেরে খোকা! তারপর সে আর ফির‌্যা আসে নাই।

অনেক দিন বাদে আমার দুচোখ আবার সরসী হলো। বুকের গহীন থেকে উথলে উঠলো কান্না। আমি অশ্রু আড়াল করতে আকাশ পানে চাইলাম। আপনি বললেন, ঘরে চল, নতুন মাকে দেখবি।

সেই সঘন সন্ধ্যায় আমাকে আর ঘরে যেতে হলো না। নতুন মা নিজেই পিদিম হাতে উঠোনে এসে উপস্থিত। ঘনিয়ে আসা অন্ধকার, পিদিমের কম্পমান আলো, তবু চিনতে আমার একটুও ভুল হলো না সেই এক জোড়া বাদামী চোখ, সোজা ভুরু, আপেলরঙা...।

চোখটা জ্বালা করে উঠলো। লোনা জল কী সব আয়োজন করছে কে জানে! পলক ফেললেই হয়তো দু এক ফোঁটা ঝরে পড়বে জমিনে। আমি তাই জোরজবরদস্তি চেষ্টায় জলটুকু চোখেই ধরে রাখি। মাথাটা ঘুরছে যদিও চক্কর দিয়ে তবু নিজেকে অনড় দাঁড় করিয়ে রাখি। মনে মনে বলি, কষ্টে ভেঙ্গে পড়তে নেই, খোকা...