মারিয়া সালামের গল্প ‘সময়ের কাছে’
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৯
বছরের এই সময়টা চৌরাস্তার এদিকটা একদম শুনশান থাকে। মাঝে মাঝে দু`একটা রিকশা কিম্বা সাইকেল টুংটাং ঘণ্টা বাজিয়ে বড় রাস্তার দিকে যেতে যেতে ঝুপ করে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। বিকেল থেকে বড় বটগাছটার গায়ে ঠেস দিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকি। আধঘণ্টা, এক ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টা। এই বড় বটগাছটার নিচে কোনো কোনো দিন সন্ধেটা এত গাঢ় হয়ে নামে, আমার গা ছমছম করে। তবু আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকি, আমার আর কোনো উপায় থাকে না।
সময় কাটানোর জন্য ব্যাগ থেকে গল্পের বই বের করে মনোযোগী পাঠকের অভিনয় করি, কিছুই পড়া হয় না। চোখ থাকে পথের বাঁকে, যেখান দিয়ে সাদিয়া রোজ আসে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পা’দুটো ফুলে ওঠে। পায়ের পাতার নীল রগগুলো আমি চশমা ছাড়াই দিব্যি পরিষ্কার দেখি। এক পা দিয়ে অন্য পা ডলতে ডলতে আমি সাদিয়া যে পথে আসবে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার আর কোনো উপায় থাকে না।
কলেজ থেকে রিকশা ভাড়া করে বাড়ি গেলে দিন হিসেবে মাসে লাগবে দেড়শো টাকা। কিন্তু একটু কষ্ট করে ঘণ্টাখানেক বা আর একটু বেশি দাঁড়িয়ে থাকলেই, সাদিয়াকে পেয়ে যাই। আমি আন্তরিক একটা হাসি দিয়ে টুপ করে ওর রিকশায় উঠে পড়ি। আমার হাসির বিনিময়ে প্রায় প্রতিদিন আমাকে ওর ভ্রু কুঁচকানো মুখ দেখতে হয়। আমার খুব লজ্জা করে, আমি গলার কাছে দলা পাকানো কষ্টটা গিলে নি। আগ বেড়ে গল্প জমানোর চেষ্টা করি। দেড়শো টাকা আমার কাছে থাকে, থাকে না তা নয়। মাসের শুরুতেই বড় মামী মুখ কাল করে আমার হাতে তিনশো টাকা গুঁজে দেন।
‘তোদের লজ্জা লাগে না নিজের বাপ বেঁচে থাকতে পরের বাড়িতে পড়ে থাকিস? সব টাকা তোদের পিছে ঢালতে ঢালতে একদিন আমাদেরই পথে নামতে হবে।’ টাকা ক‘টা দিতে দিতে বড় মামী প্রতিমাসেই এই একই কথা বলেন। আমার লজ্জা করে না, তা নয়। আমি মাথা নিচু করে টাকা ক‘টা হাত পেতে নি। বেঁচে থাকার যুদ্ধে টিকে থাকতে আমাদের মতো অনেকেরই আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে হয়। সারাদিন পরে তিন ভাইবোন খোলা আকাশের নিচে শুয়ে যখন তারাখসা দেখি, এই বেঁচে থাকাটাও আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এই টাকাতে আমাদের অনেক কিছু কিনতে হয়। বাজারের পুরাতন বইয়ের দোকান থেকে খুঁজে খুঁজে গল্পের বই, টুকটাক জ্বর, সর্দিকাশির জন্য হোমিওপ্যাথি ওষুধ, সন্ধ্যার নাস্তা, নারকেল তেল, ঠোঁটের পমেড, অনেক অনেক কিছু। রিকশা চড়ে এই টাকা খরচ করা তাই আমার কাছে বিরাট বিলাসিতা।
সাদিয়া আর আমাকে নিয়ে রিকশাটা কুয়াশার বুক চিড়ে টুংটাং ঘণ্টা বাজিয়ে এগিয়ে চলে। মোড়ের শিক কাবাবের দোকানের সামনে এসে রিকশা থামে। ‘তিনটা শিক প্যাকেট করে দ্যান’, সাদিয়া হুডের ভেতর থেকে মুখ বের করে দোকানিকে বলে। আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখি। ছোট ভাইটার কথা খুব মনে পড়ে। বিড়বিড় করে সাদিয়াকে বলি, আজও আমার জন্য একটা নিস, আজ নিয়ে তোর ত্রিশটাকা পাওনা হবে, নিয়ে নিস।
পুড়তে থাকা কাবাবের কালো ধোঁয়ায় সাদিয়ার মুখটা অনেক বেশি কালো মনে হয় আমার কাছে। আমার হাতে কাবাবের প্যাকেটা তুলে দিয়ে আরো গম্ভীর হয়ে বসে। সাদিয়া আমাদের প্রতিবেশী, আমরা এখন যে বাড়িতে থাকি তার দু`বাড়ি পরেই ওরা থাকে। বাড়িতে ঢুকতেই আমার ছয় বছরের ভাইটা এসে ছোঁ মেরে ব্যাগটা নিয়ে এক দৌড়ে আমাদের জন্য বরাদ্ধ চিলেকোঠার ঘরটায় গিয়ে কপাটটা ভিড়িয়ে দেয়। তৃপ্তি নিয়ে ওর কাবাব খাওয়ার দৃশ্যটা আমার কোনোদিনই দেখা হয় না। ঝাপসা চোখে আমি পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
আর তিনদিন পরেই অন্তুর জন্মদিন, ছয় শেষ করে সাতে পড়বে অন্তু। এই বয়সে বাচ্চারা কতকিছু চায়! অন্তুর তেমন কোনো বায়নাই নাই সেই অর্থে। তিনবেলা আধপেটা খেতে হয় বলেই হয়তো খাবারের চাহিদা অনেক বেশি। বিকেল হবার সাথে সাথেই ওর ক্ষুধা বাড়তে থাকে। মাঝে সাঝে আমি বাড়ি ফেরার পথে কিছুই আনতে পারি না। সেই দিনগুলোতে অন্তু আমার দিকে অনেক্ষণ অবিশ্বাস নিয়ে চেয়ে থাকে। বড় মামির খোঁটা, সাদিয়ার কোঁচকানো ভ্রু এসবের চেয়ে ক্ষুধার্ত অন্তুর অবিশ্বাসের চাহনি আমার কাছে অনেক নির্মম মনে হয়। যে দিনগুলোতে আমি খালি হাতে বাড়ি ফিরি, সন্ধ্যাটা অনেক ভারি হয়ে নামে আমাদের চিলেকোঠার ঘরটায়।
আমাদের মা মারা গেছে পাঁচ বছর আগে, অন্তু তখন মাত্র দুই বছরের আর মিতু দশ বছরের। বছর না ঘুরতেই আমাদের বাবা নতুন বউ ঘরে তোলে। আমাদের জায়গা হয় নানিবাড়ির চিলেকোঠার। মাসে একদিন এসে আমাদের বাবা চাল, ডাল, মাছ, মাংস এসব দিয়ে যায়। এরচেয়ে বাড়তি কিছু তার পক্ষে দেয়া সম্ভব না, এটা সে পরিষ্কার করেই বলে গেছে। তাতেও তেমন সমস্যা নেই। সমস্যা হলো, আমাদের নানি সেই খাবারের অর্ধেকও আমাদের দেয় না।
আমাদের পড়ালেখার খরচ দেয় আমাদের মেজ চাচা আর বছরে একবার জামা কাপড় দেয় বড় খালা। আমাদের আরতো তেমন কিছু লাগে না, শুধু অন্তুটার ক্ষুধা লাগলে আমার খুব কষ্ট হয়। ব্যাপারটা এমন না যে, আমি হাতপা গুটিয়ে বাসায় বসে থাকি। আমি নিজেও প্রাইভেট টিউশন দি। তাতেও তিনশো টাকা পাই। সেটা খরচ হয় নিজের টিউশনের পিছে, অন্যগুলো মোটামুটি সামলে নিলেও রসায়ন পড়া একা ঠিকঠাক মতো হয় না।
অন্তুর খাওয়া শেষ হতেই মিতু ধড়মড় করে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল তুলে দেয়। হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, ‘নিতুপু বড় ঝামেলা বেঁধে গেছে রে। সামনে তোর কঠিন বিপদ।’ আমি ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝি না। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাই, না, আজ তো মাসের ২৭ তারিখ। বড় বিপদের দিন মাসের এক তারিখ থেকে পাঁচ তারিখের মধ্যে। এরমধ্যেই বড় মামি আসে। রাগী রাগী মুখে আমার হাতে তিনশো টাকা গুঁজে দিয়ে নানিকে বলে, আম্মা, এরা ধাড়ি ধাড়ি দুইবোন থাকতে আপনি কাজ করবেন না। সবকাজ এদের দেবেন। এরা পড়ালেখা শিখে কি করবে, জজ-ব্যারিস্টার হবে? বাড়ির কাজ শিখান আম্মা, কাজে দেবে।
তারপরের কয়েকটা দিন নানি আমাদের যে দৌড়ের উপরে রাখে, সেটার চেয়ে বড় বিপদ আমি আর কিছু দেখি না। আমি মিতুকে বললাম, ‘বড় মামি কি আগে আগে এসে পড়েছে? সেটা হলে ভালোই, সাদিয়ার গোমড়ামুখ আর দেখতে ভালো লাগছে না রে, ওর টাকাটা দিতে পারলেই বাঁচি।’
তারচেয়ে বড় বিপদরে নিতুপু, ছোটআম্মা এসেছে।
আমাদের বাবার ছোট বউ এ বাড়িতে তেমন একটা আসে না, নানি খুব রাগ করে। হঠাৎ সে কেন এসেছে, সেটার কারণ খুঁজে পেলাম না। আব্বার কোনো সমস্যা হয়েছে? মিতুর কাছে জানতে চাইলাম।
আব্বার বিপদ হলেই আমাদের কি, না হলেই বা কি? বিপদ আমাদের। ছোটআম্মা তোর বিয়ের জন্য পাত্র দেখে ফেলেছে। লোকটার বয়স ত্রিশ হবে, বউ মরে গেছে, বাচ্চা আছে দুইটা, একনাগাড়ে কথা বলতে যেয়ে মিতু হাঁফাচ্ছে।
আমি কি বলব, বুঝে পাচ্ছি না। আমার পুরা বিষয়টা বুঝে ওঠার মতো অবস্থা এখনও তৈরি হয়নি। মিতু বলেই চলেছে, পাত্রের ছবি সাথে এনেছে, পাত্রের মাথায় বিশাল টাক। আপা আমার কাঁদতে ইচ্ছা করছে, ছোটআম্মা বলেছে, বিয়ের পর তুই অন্তুকে নিয়ে যাবি আর আমাকে সে নিয়ে যাবে।
আমাদের ছোটআম্মার আবার একটা ছেলে হয়েছে মাস ছয়েক হবে। সেই অবধি সে মিতুকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। বাচ্চা দেখার লোক দরকার। আমি অনেক কষ্টে মিতুকে আঁকড়ে ধরে রাখি, এরজন্য নানি-মামাদের অনেক বকাবকি শুনতে হয় আমাকে। মিতু কাঁদতে বসে, আপু আমি ওই বাড়িতে যাব না। আমি দেখিস ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মরে যাব, তবু তোকে আর অন্তুকে ছাড়া আমি থাকবো না।
আমার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হয়, তবু আমি মাথা ঠাণ্ডা রাখতে চেষ্টা করি। মাথায় পানি ঢালা দরকার, গামছাটা কাঁধে ঝুলিয়ে ক্লান্ত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকি। পা দুটো ভারি হয়ে আসে, কলপাড়ে গেলেই দেখা যাবে ছোটআম্মা উঠানের মধ্যে মোড়ায় বসে চা খাচ্ছে। তাকে এই বাড়িতে আমি কোনোদিন ঘরে বসতে দেখিনি। নানি তাকে উঠান থেকেই বিদায় করে। এই মহিলা তারপরেও চারপাঁচ মাস গেলেই উঠে আসে, কেবলমাত্র আমাদের তিন ভাইবোনকে সরাসরি বকাঝকা করতে পারে বলে।
উঠানে পা রাখতেই নানি বলল, ‘ওই যে নিতুমণি এসে গেছে, এদিকে আয় তো বোন।’ আমার নিজের কানকে বিশ্বাস হয় না। মাথায় গরম উঠে গেলেই কেবল মানুষ এসব শুনতে পায়। আমি তাদের দিকে না গিয়ে উলটা দিকে কলপাড়ে গিয়ে মাথায় পানি ঢালতে বসি। ছোটআম্মা পানির মগটা আমার হাত থেকে নিয়ে মাথায় পানি ঢালতে থাকে। মাঝে মাঝে মাথায় হাত বুলাতে থাকে। অনেকদিন এভাবে কেউ মাথায় হাত বুলায় না, আমার চোখ ফেটে পানি পড়তে থাকে।
গামছা দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ছোটআম্মা বলে, চুলের কি অবস্থা করেছিস মা, ঠিকমতো তেল-শ্যাম্পু দিস না বুঝি! আজ বাদ দিয়ে কাল বিয়ে, চুলের এরকম অবস্থা হলে লোকে বলবে কি?
আমি মাটির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলি, ‘আম্মা আমি বিয়ে করবো না।’ হঠাৎ করে গালের উপরে ভীষণ জোরে একটা চড় খেয়ে মাথা ঘুরতে থাকে। আমি কোনোরকমে মোড়ার উপর বসি। নানি এবার চুলের গোছা ধরে টান দিয়ে বলে, ‘আমার বাড়ি থেকে এই শিক্ষা পেয়েছিস, মুখে মুখে কথা! বিয়ে করবি না, আমার ছেলেরা কি সারাজীবন রাবনের গুষ্ঠি পালবে? হয় বিয়ে করবি, না হয় ভাইবোনকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবি আর সৎমায়ের কুৎকা খাবি।’
ছোটআম্মা বলে, এই চড় আমি দিলেই বড় বড় কথা হতো, সৎমা বলে কথা। আমি কি তোদের খারাপ চাই? তোর বয়স আঠারো পার হয়েছে, এখন বিয়ে করবি না তো কি করবি? তোর বয়সে আমি বিয়ে করেছি না, সংসার করছি না? ন্যাকা করিস, তোদের বসে বসে খাওয়াবে কে? আমাদের আরো দুইটা বাচ্চা আছে, তাদের ভবিষ্যৎ নাই? তোদের দিয়ে যাব সারাজীবন?
ছোটআম্মা যাবার সময় বলে গেছে, আগামী মাসের দশ তারিখে পাত্র দেখতে আসবে, বিয়ে দিয়েই সে ক্ষ্যান্ত হবে।
রাতে আমাদের আর খাবার জন্য ডাকা হয় না। অন্তু পেটে ক্ষুধা নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। আমি আর মিতু আকাশের দিয়ে তাকিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকি। মিতু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। আমি না বোঝার ভান করে অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে থাকি। অনেক্ষণ পার হয়ে যায় এভাবেই। আমার চোখ লেগে এসেছিল বুঝি। মিতুর ধাক্কায় উঠে বসি। ‘আপু নে’ বলে ও আমার হাতে চকচকে চারটা একশো টাকার নোট ধরিয়ে দেয়। আমি অবাক হয়ে বলি, এত টাকা! কোথায় পেলি?
মিতু রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে, ছোটআম্মার ব্যাগ থেকে নিয়ে নিয়েছি। এই টাকা দিয়ে তুই কাল ঢাকায় চলে যা। কাল সকালে তোর প্রথম কাজ জামি ভাইকে ফোন করে বলবি তুই তার কাছে চলে যেতে চাস।
জামি ভাই আমাদের দূরের ফুফাতো ভাই। চাকরি নিয়ে ঢাকায় চলে গেছে। যাবার আগে বলে গেছে, আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাবে। আমার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলেই এবাড়িতে আমাকে আর থাকতে হবে না। আমি হ্যাঁ বা না কিছুই বলিনি। জামি ভাইকে যে আমার পছন্দ না সেরকম না, বরং খুব পছন্দ। কিন্তু মিতু আর অন্তুকে রেখে আমার যাওয়া হবে না বলেই, আমি কোনো উত্তর দেইনি। সে যাবার আগে হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দিয়ে বলেছিল, যে কোনো প্রয়োজনে তাকে যেন ফোন দি।
অনেক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে অন্তু সকালের নাস্তা পেয়েছে। ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া শক্ত রুটিটা মুড়িয়ে চায়ের কাপে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাচ্ছে অন্তু। মাঝে মাঝে পা দোলাচ্ছে আবার রুটিতে কামড় বসাচ্ছে। একনাগাড়ে অন্তুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম, ভীষণ কান্না পাচ্ছে। ওড়না দিয়ে চোখ মুছে কালো চশমাটা পরে নিলাম। রাত থেকে কাঁদতে কাঁদতে চোখদুটো অনেক ফুলে উঠেছে, এভাবে বাইরে যাওয়া অসম্ভব।
আমি গলির মাথার ফোন ফ্যাক্সের দোকানে বসে আছি। হাতে জামি ভাইয়ের দেয়া চিরকুট। দোকানের ছেলেগুলো অনেক চেষ্টা করে ফোনের লাইন পেয়ে দুইবার কল দিয়েছে। ওপার থেকে কেউ ধরেনি। আমি আরেকবার চেষ্টা করবো বলে বসে আছি। ওদিক থেকেই এবার কল আসলো। চিরকুটের সাথে নম্বর মিলিয়ে একটা ছেলে আমার হাতে ফোনটা দিয়ে বলল, কল রিসিভ করলে আমরা কিন্তু মিনিটে দুই টাকা রাখি। আমি মাথা নেড়ে কল ধরলাম।
জামি ভাই, এটুকু বলতেই আমার গলা কেঁপে উঠলো। আমি ছেলেগুলোর দিকে তাকালাম আবার লজ্জা ঝেড়ে বললাম, আমি আজ তোমার ওদিকে চলে আসতে চাচ্ছি।
জামি কি বুঝলো জানি না, বলল, সেটা তুমি যেকোনো সময় আসতে পার। কিন্তু হঠাৎ এসব কেন? আমাকে খুলে বলো।
ছেলেগুলো একজন আরেকজনকে কনুইয়ের গুতা দিয়ে হাসি চেপে রেখেছে। অন্য সময় হলে আমি লজ্জায় হয়তো কথাই বলতে পারতাম না। আজ আমার তেমন কিছু মনে হচ্ছে না, বরং তাড়াহুড়ো করে সব ঘটনা বলে কত তাড়াতাড়ি ভারমুক্ত হতে পারা যায়, সেটাই ভাবছি।
আমার ভালো কাপড় বলতে একটাই জর্জেটের গোলাপি রঙের সালোয়ার-কামিজ। সেটাই পরেছি আর আরেক জোড়া লুকিয়ে হাতব্যাগে নিয়েছি। আমার টিকেট কাটা হয়ে গেছে। জামির বন্ধু কেটে দিয়েছে টিকেট। আমার চারশো টাকা বেঁচে গেল ভেবে কিছুটা ভালো লাগছে।
বিকেল চারটের বাস। তার আগে আমার হাতে ঘণ্টা দুয়েক সময় আছে। অন্তুকে দুপুরে খাইয়ে দিয়ে অনেক্ষণ কোলে নিয়ে বসে থাকলাম। ওকে ঘুম পাড়িয়ে মিতুকে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরলাম।
আপু, আমাকে আর অন্তুকে নিয়ে চিন্তা করিস না। আমি কোনোরকমে একমাস কাটিয়ে দেব ঠিকই। জামি ভাই তো বলেছেই আগামী মাসে আমাদেরও নিয়ে যাবে। তুই সাবধানে যা।
বাস ছাড়লো ঠিক চারটা দশে। জানালার পাশে বসে আমার মনে হচ্ছে, আমি হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছি। নিজেকে এত স্বাধীন মানুষ মনে হচ্ছে। বাসটা বনবাদাড় পাড় হয়ে দ্রুত এগিয়ে চলছে সামনে। হাত ঘড়িটাই ঠিক পাঁচটা বেজে বিশ মিনিট। আমি মনে মনে ভাবছি, আজকের দিনটা একদম আলাদা। গতকালও এই সময় আমি সাদিয়ার জন্য রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম।
কথাটা মনে পড়তেই আমার অন্তুর কথা মনে পড়ে গেল। এইতো ছয়টা বাজলেই ওর খাবার সময়। হঠাৎ মনে পড়লো চারশো টাকাটা এখনও আমার ব্যাগে। অন্তুর ক্ষুধার্ত শুকনো মুখটার কথা মনে হতেই গলার কাছে আবার সেই দলা পাকানো কষ্টটা অনুভব করলাম। বাসটা তখনও শাই শাই করে বাতাস কেটে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি পাগলের মতো চিৎকার করে বলছি, দয়া করে বাসটা থামান, দয়া করে বাসটা থামান।