মারিয়া সালাম

মারিয়া সালাম

মারিয়া সালামের গল্প ‘বিজয় মিছিল’

প্রকাশিত : জুলাই ৩০, ২০২৪

ঝুপড়ির দরজায় বসে দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছে কনু। অনেকদিন পরে দুপুরের খাওয়াটা বেশ ভালো হয়েছে। আয়েশে চোখ বুজে আসছে বারবার। কিন্তু ভ্যাপসা গরমটা খুব অস্বস্তিকর লাগছে। টেট্রোনের শার্টটা ঘামে ভিজে শরীরের সাথে খামচে বসে আছে। পকেট গরম থাকতে থাকতেই ভালো একটা সুতির শার্ট আর একটা পাকিস্তানি স্ট্যান্ড ফ্যান কিনে ফেলতে হবে, দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে ভাবতে থাকে কনু।

তবে হুট করেই এতসব কেনাকাটা করাটা ঠিক হবে না। আরও কয়েকটা দিন যাক। পাশে রাখা স্মার্টফোনটার দিকে কিছুটা বিরক্ত হয়ে তাকালো। ডেটা কানেকশন থাকলে একটু গান শোনা যেত। বালের আন্দোলন, নিজে মনেই বলে উঠল কনু। পরক্ষণেই চেহারায় হতাশার একটা ছাপ ফুটে উঠল তার। ধুর, এত সহজেই সব মিটমাট হয়ে গেল! আন্দোলনটা আর একদিন বা দুইদিন চললেই একটা নতুন ফোন কেনার ব্যবস্থা হয়ে যেত।

কী রে হালা, ভরদুপুরে ঝিমাস ক্যান? দিনে-দুপুরেই পুরিয়ায় টান দিসিস নাকি? এলাকার বড় নেতা কাশেমের পরিচিত কণ্ঠটা কানে আসতেই ভাবনায় ছেদ পড়ল কনুর।

আইসে হালার একশো টাকার পারটি, বিড়বিড় করল কনু। হালার পুত মাস গ্যালে চানদা তুলে দুইলাক। চোখে কালা চশমা আর দুইচাকা নিয়া ফুটানি মারায় আর আমগোরে দেয় একশো। এরচে আমার সিজনাল পারটিই ভালা। রাস্তায় খাড়াইলেই দুই হাজার। ভাঙাভাঙির জইন্য পাঁচ, আগুন দিলেই দশ আর পুলিশ পিটাইতে পারলেই বিশ। লাবের উপ্রে লাব হইলো গিয়া লুটপাটের মাল, মনে হাজারো চিন্তার ঘুরপাক লুকিয়ে রাস্তার ওপরে একদলা থুতু ফেলল কনু।

কী যে কন বড়ভাই! ভাত খাইতে পারি না, আপনে আছেন পুরিয়া নিয়া। চাইরদিন তো কামেই যাইতে পারি না ভাই।

তোর পুরিয়ার ব্যবস্থা হইবোনে। চল আইজ কডা টাকা বাড়ায়া দিমুনে।

কই নিবেন ভাই, আন্দোলন তো শ্যাষ।

বেশি কথা কইস না ব্যাডা। হিবির-হুবির, স্টুডেন, বিম্পি সব সাইজে নিসি। চল বিজয় মিছিলে যাইতে হইব।

অ, তাইলে আপনাগো বিজয় হইসে শ্যাষ পর্যন্ত। চাইর দিন ধইরা আপনারে ফোনে না পায়া ভাবসি ভাই মনে হয় দ্যাশ থাইকাই বিদায় নিসেন, কথাগুলো বলতে পেরে শরীরের ম্যাজমেজে ভাবটা নিমিষেই চলে গেল কনুর। খোঁচাটা ঠিক জায়গামতোই খেল কাশেম। ধমকে উঠে বলল, অনেক প্যাচাল হইসে হারামজাদা, ল জলদি যাইগা।

শুকনা গলাতে শোলোগান বাইর হইব? এককাপ চা যে লাগে ন্যাতা, মিনমিনে গলায় আবদার ধরল কনু। অবিশ্বাস্য নরম গলায় কাশেম বলল, ল আইজ তোরে কফি খাওয়ামুনে।

দুই ঘন্টার কারফিউ বিরতি শুরু হতেই চায়ের দোকানে জনা বিশেক লোক এসে জড়ো হয়েছে। সবার মুখেই একই আলাপ, ছাত্র-আন্দোলন। মুরুব্বিমতো একজন বলল, আরে, ছাত্ররা এইসব ভাঙচুর করবে না, এসব বিম্পি-বামাতিদের কাজ।

আরেকজন চেহারায় বিজ্ঞ একটা ভাব এনে বলল, ধুর মিয়া ভাই। চুলডা হুদাই পাকায়া ফ্যালসেন, আবভাব কিছুই বুইঝা উঠলেন না, এসব জঙ্গিগো কাম।

তৃতীয়জন বলল, আরে মিয়া, আপনি সরকার বিরোধী আন্দোলন করেন। ইটস য়োর সিটিজেন রাইটস। বাট, এন্টাই-এস্টেট এনার্কি আমরা মেনে নিব না। দেশের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে।

অন্যজন বলল, সরকার ঘোষণা দিসে, ক্যামেরা দেইখা দেইখা জঙ্গি বাইর করব। উপ্রে দিয়া সব শান্ত দ্যাখায়া, রাইতেই সব গায়েব কইরা ফ্যালবোনে।

বেঞ্চের একপাশে চুপচাপ বসে গত দুইদিনের লুটপাটের হিসাব মিলাচ্ছিল কনু। কথাটা কানে যেতেই বিষম খেল। সামান্য চিন্তিত হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ পরেই চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলল। আমগো আবার কিসের ভয়, গায়েব হইলেই কি আর বাইচ্চা থাইকাই কি। মুন চাইলেই কি শান্তিমুতো এককাপ কফি খাওনের অবস্থা থাকে? ভাত খাওয়োনের টাকা নিয়া টানাটানি চলে। আমগোর আবার গায়েব হওয়োনের ভয়, নিজেকে বুঝ দিল সে।

শান্ত হয়ে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, হুনলাম মানুষ নাকি জীবন চুক্তিতে আন্দোলনে গেসিল, পুলিশ মারতে পারলেই পাচলাক? যতই টাকা দিক, ঈমান বইলা কি কিছু থাকবো না, মানুষ মারাডা কি ঠিক কাম? কথাটা কেউ তেমন গুরুত্ব দিল না, কেউ উত্তরও দিল না।

মানুষকে মানুষ মুনে কর না আবার হালারা রাসট্রিয় উন্নয়ন মারাও, নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে মিছিলের মাঝে ঢুকে গেল কনু। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে শ্লোগান তুলল, কাশেম ভাই ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই...