মারিয়া সালাম

মারিয়া সালাম

মারিয়া সালামের গদ্য ‘৮ মার্চ, মৃত্যু কিংবা পুনর্জাগরণের দিন‘

প্রকাশিত : মার্চ ০৮, ২০২৫

লেখাটা শুরু করেছিলাম ২৪ নভেম্বর। ঠিকঠাক মতো সময় ধরে বললে ২৩ নভেম্বর রাত ৩নটার সময়, যখন আমার প্রথম জন্ম হয়েছিল। জন্মতিথিতে আত্ম-উপলব্ধি ধরনের লেখা। শুরু করার পর কিছুতেই সেটা সামনে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ, বিক্ষিপ্ত মন আর সময়ের অভাব। লেখাটা চিন্তা-ভাবনার মধ্যেই থমকে ছিল।

গতকাল রাত থেকেই ভাবছি, লেখাটা আজ শেষ করা উচিত। আজ বিশ্ব (শ্রমজীবী) নারী দিবস। সেজন্য নারী হিসেবে জ্ঞানদান করে কিছু লেখা উচিত, ব্যাপারটা সেরকম নয়। আজ আমার জীবনে বিশেষ একটা দিন। ৮ মার্চ মৃত্যু কিংবা পুনর্জাগরণের দিন।

গতবছর ৮ মার্চ, দুপুর ৩টা। সোফায় বসে আছি সমৃদ্ধকে কোলে নিয়ে। অবচেতন মন বলল, কিছু একটা হতে যাচ্ছে! বুকের ভেতরে ব্যথাটা এমন প্রবলভাবে অনুভব করলাম মনে হলো, সম্ভবত আমি মারা যাচ্ছি। বাড়ির কাজে সাহায্যকারীকে ক্ষীণ স্বরে ডাকলাম।

প্রথমবার সে কোনো সাড়া দিল না। দ্বিতীয়বার ডাকে সে যখন আসলো, বাচ্চাকে তার হাতে দিয়েই মুখ থুবড়ে মেঝেতে পড়ে গেলাম। যখন জ্ঞান ফিরল, তমালকে বলতে শুনলাম, আরে কোনো পালস নাই, ব্লাড প্রেসার নীল...

এরপর হাসপাতালে নেয়ার আগপর্যন্ত যতবার উঠে বসতে চেষ্টা করেছি, ততবারই মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছি। প্রতিবার জ্ঞান ফিরেছে বুকে তীব্র ব্যথার অনুভূতি নিয়ে। এই ব্যথাটা ঠিক ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। মনে হয়েছিল, লক্ষ-কোটি তীর বিঁধে আছে বুকে। মনে হচ্ছিল, পাঁজরের হাড়গুলো একটা একটা করে চামড়া ভেদ করে বের হয়ে আসবে। সেই সাথে কেউ একজন যেন দুইহাতে গলা টিপে ধরে রেখেছিল।

সামান্য একটু শ্বাস নেয়ার জন্য ছটফট করছিলাম। ব্যথায় কাতর, অথচ বিছানাতে শরীর এলিয়ে দিতে পারছি না। কারণ শুলেই মনে হচ্ছে, বুকের ওপর কয়েক টন ওজনের পাথর রেখে দেয়া আছে। আর, সেই ভারের বিপরীতে পাঁজরের হাড়গুলো চাপ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মৃত্যু যন্ত্রণা এরকম হয় কিনা, সেটা আমি বলতে পারব না।

অস্ত্রোপচারের টেবিলেও চারজন শক্ত করে ধরে শুইয়ে রেখেছিল কারণ, আমি কোনোমতেই শুতে চাইছিলাম না। জ্ঞান চলে যাওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমি তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছিলাম। মাঝরাতে যখন জ্ঞান ফিরল, আবার চিৎকার শুরু করলাম, বুকের ব্যথা একটুও কমেনি। অগত্যা বিছানার মাথার দিকে সামান্য উঁচু করে আমাকে বসিয়ে রাখা হলো।

একদিকে তীব্র পেটব্যথা, অন্যদিকে বুকে ব্যথা নিয়ে আধশোয়া অবস্থায় কাটিয়ে দিলাম আরও দেড়দিন। রোববার ভোরে সাহস করে বিছানা সমান করে বালিশে মাথা এলিয়ে দিলাম। বুকের ব্যথা আর টের পেলাম না। আবার ভয়ে ভয়ে উঠে বসলাম, আবার শুয়ে পড়লাম। এরপর সাহস করে বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়ালাম।

এত কথা বলছি কারণ, মনে এসব জমে আছে। আর দিনটা আমার জন্য বিশেষ কারণে পুরাতন বোধের মৃত্যু হয়ে নতুন বোধোদয় হবার শুরুটা এখানেই হয়েছিল, সেটা অবশ্য বুঝেছি আরও সপ্তাহখানেক বাদে।

হাসপাতালের একা দিনগুলো সেই অর্থে তেমন ক্লান্ত লাগত না, আমি অনেক ভাবতাম জীবন নিয়ে। তারচেয়ে অনেক বেশি ভেবেছি মৃত্যু নিয়ে। সন্তানদের কথা ভাবতাম, এতদিন তাদের ছেড়ে হাসপাতালের ছোট্ট কেবিনটায় পড়ে আছি, অথচ তাদের জন্য কোনো অস্থিরতা টের পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল, মরে গেলে আজ এসব অস্থিরতার অনেক ঊর্ধ্বে চলে যেতাম। সেটা উপলব্ধি করেই চিন্তায় একটা স্থিতি এসে গিয়েছিল।

আমার মামি মারা যাওয়ার পরেও সন্তানদের নিয়ে এরকম একটা উপলব্ধি হয়েছিল আমার। আমার মামাতো ভাই, যে কিনা বাথরুমেও মায়ের পিছে পিছে চলে যেত, মা হারানোর পর সেই ছোট্ট বাচ্চাটা কান্না করতো না, সারাদিন ভয়ে কাঁপত। আমাদের কোলে উঠে দুইহাতে আঁকড়ে ধরে মড়ার মতো পড়ে থাকত। ওর ভয় কাটতো না, বারবার কেঁপে কেঁপে উঠত। তার সেই কষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব কিনা, আমি জানি না।

তখন থেকেই ঠিক করেছিলাম, সন্তানদের বেশি কাছে গিয়ে মায়া বাড়াব না। যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তাদের মানসিকভাবে তৈরি করতে চেয়েছিলাম, সেটা করেছি। কিছুটা দূরত্ব রেখেই চলেছি বাচ্চাদের সাথে। কারণ, আমি চাইনি আমার অনুপস্থিতিতে তারা ভেঙে পড়ুক। আমি চেয়েছি, তারা শক্ত হয়ে বেড়ে উঠুক। তাই আমার মৃত্যুতে আর যাই হোক, এই ছোট্ট ছোট্ট হৃদয়গুলো একদম ভেঙে পড়বে না। ওরা একটু দূরে দূরেই থাক।

যেহেতু অস্থিরতা ছিল না, স্থির মনে নিজের জীবনের বিষয়ে ভেবেছি সেই দিনগুলোতে। মানুষের থেকে দূরে থেকে মানুষকে নিয়ে ভাববার অবকাশ আর কখনোই সেভাবে পাইনি এর আগে। আমার তলপেটে এপার থেকে ওপার কেটে সেলাই করা হয়েছে। পেটের দুইপাশ দিয়ে বেশ কয়েকটা নল বের হয়ে আছে, যেগুলোকে বলে ড্রেন। সেসব নিয়ে দিব্যি স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাব নিয়ে একা একা আছি।

নিজেকে নিয়ে যতবার ভেবেছি কারমা বিষয়ে আমার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে। Nothing goes unpunished. অন্তত আমার জীবনে সেটা কঠিনভাবে উপলব্ধি করেছি। যা দিয়েছি তার কয়েকগুণ বেশি ফেরত পেয়েছি, ভালো বা মন্দ দুই অর্থেই। একবার আমার এক মামাকে খুব অপমান করে বলেছিলাম, বের হয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। হাসপাতালের দিনগুলোতে একটা জিনিস খুব করে মনে হয়েছে, আসলে সেই অর্থে এখন আমার নিজেরই কোন বাড়ি নাই।

মানুষকে আশ্রয় ছাড়া করতে চাইলে, নিজেরই কোনো আশ্রয় থাকে না। কাউকে কিছু দিয়ে খোঁটা দিলে নিজেরই একদিন অন্যের সামনে ঠিক সেভাবেই অপমানিত হতে হয়। নিজের করা প্রতিটি ভুলের জন্য অনুশোচনা হয়েছে। নিজের দুর্দশার বিষয়ে ভাবতে গিয়ে দেখেছি, এসব হবারই কথা ছিল।

তবে তখনও একটা ভুল ধারণা নিয়ে বসে ছিলাম। ভেবেছিলাম, সাক্ষাৎ যমের দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি, এখন অন্তত অনেককিছুই পাল্টে যাবে। কিন্তু কিছুই পাল্টে যায়নি, সেটা বুঝেছিলাম ওই হাসপাতালের কেবিনে একা একা থেকেই। যারা চিন্তিত ছিল, ভালোবাসতো, তারা সর্বক্ষণ খোঁজ নিচ্ছিল। যারা উপেক্ষা করতো বা বাতিলের খাতায় তুলে দিয়েছিল, তারা একবারের জন্যও একটা খোঁজ নেয়নি। যারা স্বার্থের জন্য মিশতো, তারা তখনও ইনিয়ে-বিনিয়ে কিভাবে সুবিধা নেয়া যাবে, সেই ধান্দাতেই ছিল।

যারা বিরক্ত, তারা বিরক্তই ছিল। যারা জঞ্জাল মনে করতো, তারা তখনও তাই মনে করছিল। যার দুর্ব্যবহার করার কথা, সে সেটাই করছিল। এই যে একটা মানুষ মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে ফিরেছে, তাতে সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কিছু আসে-যায়নি। মানুষটার সম্পর্কে যার মনোভাব যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেছে।

খুব শক্ত একটা বোধ তৈরি হলো আমার মধ্যে। যে চলে গেছে বা মরে গেছে, তার জন্য মায়াকান্না করা যত সহজ, যে রয়ে গেছে তারজন্য নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বা আচরণ পাল্টে ফেলা অনেক বেশি কঠিন বা প্রায় অসম্ভব। জগৎ-সংসারে কিছুই আপনার মতো চলবে না, সবকিছু চলবে নিজের নিয়মে। তাই নিজেকেও সেভাবেই চলতে হবে। আপনাকে ছাড়া যেমন সবকিছু চলবে, আপনাকেও একা চলার শক্তি অর্জন করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ভেঙে পড়া যাবে না। কারণ ভেঙে কার ওপরে পড়বেন?

মানুষের ভার নেবার মতো মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা। জীবনে কোনো না-কোনো পর্যায়ে গিয়ে আপনাকে একা চলার অভ্যাস করতেই হবে। নিজের জন্য নিজে যথেষ্ট না হলে আর কেউই সেটা হতে পারে না।

পৃথিবীতে যেমন নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি, তেমন নেই কোনো বিশুদ্ধ ভালোবাসা। এমনকি একটা পর্যায়ে সন্তানের সাথে সম্পর্কও হয়ে উঠে স্বার্থের। তাই নিজের সম্মান বজায় রাখতে কারো থেকে কিছু পাবার আশা করার চেয়ে ঢের ভালো অন্যের জন্য দেবার সক্ষমতা অর্জন। ভালোবাসার, সম্মানের সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া ছাড়া মানুষের গতি নাই। তাই মৃত্যু যতটা সহজ বিষয়, বেঁচে থাকা ঠিক ততটাই কঠিন ব্যাপার।

আমার মনে হয়েছে, যতদিন প্রকৃতি তার প্রতিশোধ না নেবে মানুষকে বেঁচে থাকতেই হবে। জীবন যত কঠিনই হোক, সৃষ্টিকর্তা যে কাজ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে সেটা সম্পন্ন না করে হয়তো এখান থেকে ছাড় নাই।

আবার একবার সাজার মেয়াদ শেষ হলে, কাজ শেষ হলে, পৃথিবীর কোনো শক্তিই আর কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারবে না, ধরেও রাখতে পারবে না। সময় সব সমস্যার সবচেয়ে বড় সমাধান। সময় শেষ না হলে যেমন মৃত্যু বা বিদায় নাই তেমন বিদায়ের সময় আসলে পৃথিবীর সবশক্তি দিয়েও কাউকে ধরে রাখা যাবে না। সময়ের জন্য অপেক্ষা করাটাই হয়তো সবচেয়ে বড় কাজ।

এই যে বোধ, এটাই সম্ভবত পুনর্জাগরণ। সেই অর্থে, ৮ মার্চ পুরাতন মারিয়া সালামের মৃত্যুর ক্ষণ আবার একই সাথে পুনর্জাগরণের দিন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সংবাদকর্মী