মারিয়া সালামের গদ্য ‘এক টুকরো জীবন’

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৫, ২০২৫

ছুটির দিন দুপুর অবধি ঘুমাই, এই ১টা পর্যন্ত। যেদিন অনেক বেশি দেরি করে উঠি, সেদিন ঘুম ভাঙার পরেই একটা কেমন অবসাদ হয়। আরেকটা দিন চলে গেল, অথচ আমি কিছুই করতে পারলাম না, এসব চিন্তাভাবনা চলে মাথায়। আজও ঘুম ভেঙে অভ্যাসমতো মোবাইল তুলে নিলাম হাতে। টুকটাক কাজ সেরে ফেসবুকে এলাম। ফিডে প্রথমেই আসলো হেলাল হাফিজের কবিতার একটা লাইন। কেউ একজন শেয়ার করেছে।
এক জীবনে কতটা আর নষ্ট হবে, এক মানবী কতটা আর কষ্ট দেবে...

এরপর, আরও বেশি শূন্যতায় ডুবে গেলাম। অনুভূতিটা ঠিক ভাষায় বোঝাতে পারব না। ঘাবড়ে যাওয়ার মতো অনেকটা, গলা শুকিয়ে আসলা।এই লাইনগুলো কোনো একসময় কেউ লিখেছিল। কাকে কাকে উদ্দেশ্য করে লেখা ছিল তার ওয়ালে, আমি জানতাম না। আমাকে বলা হয়েছিল, আমার জন্য। তাতে বিশ্বাস করেই আমি প্রতারিত হয়েছিলাম। হ্যাঁ, অনুভূতিটা হয়তো প্রতারিত হবার পরে যে আক্ষেপ হয়, সেরকম হতে পারে বা তারচেয়ে অন্যকিছু। তবে তারচেয়ে বেশি কখনোই নয়।

অনেকবছর আগেও একবার এরকম অসহ্য অনুভূতির বেড়াজালে আটকে পড়েছিলাম দিন সাতেকের জন্য। তখন নোকিয়ার একটা ছোট্ট হ্যান্ডসেট ব্যবহার করতাম। প্রথম নীল আলোঅলা স্ক্রিন। তাতে রিংটোন সেট করা ছিল, ওরে নীল দরিয়া...

কলগুলো আসতো ঠিক দুপুরের দিকেই বা কখনও মাঝরাতে। নিস্তব্ধতা ভেঙে যখন করুণ সুরে বেজে উঠত ওরে নীল দরিয়া... আমি আতংকিত হয়ে উঠতাম। প্রতিটি কথোপকথনের শেষ হতো, আমার শতসহস্র খামতির বর্ণনা শুনে। প্রথমে শুরু হতো, আমার বাবা গরিব, অথচ আমরা কোনো দিনও কারো মুখাপেক্ষী কখনোই ছিলাম না। কেবল আড়ম্বর ছিল না আমাদের। আমরা বাবা পয়সা জমিয়ে অট্টালিকা গড়ার চেয়ে, আমাদের খাদ্য আর শিক্ষার জন্য অত্যাধুনিক জিনিসপত্র কেনার ওপরে বেশি জোর দিতেন।

আমরা কখনোই ছেড়া কাপড় পরিনি। যথেষ্ট পরিপাটি আর কেতাদুরস্ত পোশাক পড়তাম। আমারা যে গরিব, আমাদের টিনসেডের বাড়িটাই কেবল সেটার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে যেত। আর আমার নানাবাড়ির অর্ধেক লোক সেটা প্রচার করে আনন্দ পেত। কারণ তাদের বিশাল অট্টালিকার ভার কাঁধে নিয়ে তারা আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না। আমরা যখন একেকটা বাক্য বলা শুরু করতাম, তাদের অট্টালিকা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তো। তারাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করত, আমার বাবা ফকির।

তাতে যখন বিন্দুমাত্র দমানো যেত না আমাকে, তখন বলা হতো আমি লোভি। অথচ আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, জীবনে এখন পর্যন্ত কোনো বাপের বেটা বলতে পারবে না যে আমি কারো কাছে কিছু নিয়েছি বা উপহার হিসেবে কিছু পেলে আমার সামর্থ্যের মধ্যে আমিও তার পরিবর্তে উপহার দিয়েছি। এরপর, একে একে উঠে আসতো আমার বানরের মতো চেহারা, আমার অনস্মার্টনেস আর অপরিপক্কতার গল্প। এসব কিছুতেই আমি বিচলিত হতাম না।

কিন্তু যখন লোভি বলতো তখন মানুষের মিথ্যাচার ও নিষ্ঠুরতা দেখে বাকহারা হয়ে যেতাম। এরকম মানুষকে ভালোবাসতে পেরেছি, সেটা ভাবলেই মনে হতো এটা নিজের সাথে নিজের প্রতারণা করা হচ্ছে।

এরপর, অনেকদিন নীল দরিয়া গানটা শুনতে চাইতাম না, আমার ট্রমা ছিল। সেই ট্রমা কাটিয়ে মূর্খগুলোকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম একসময়। যারা ফকির বলতো তারা প্রত্যেকে একটা সময় আমার সামনে হাত পেতেছে। কোনো প্রতিশোধ নিতে নয়, মানুষকে ভালোবেসেই আমার যথাসাধ্য আমি দিয়েছি। এরপরও এরা বলেছে, ফকিরের বাচ্চার কত ফুটানি! সেসব আমাকে ছুঁতে পারেনি আবার তাদের সাহায্য করাও আমি কখনোই বন্ধ করিনি।

সেসব দিনগুলো পার করে এসে বহুবছর পরে আবার নিজের সাথে নিজেই প্রতারণা করলাম। তার অনেক কারণের মধ্যে একটা কারণ এই কবিতার লাইন দেখে মানুষের প্রতি তীব্রভাবে সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছিলাম। অন্যের কষ্ট লাঘব করতে গিয়ে নিজেই আবার কষ্টের পাঁকে পড়ে গিয়েছিলাম। এতকিছুর পরেও এদের ক্ষমা করে দেই, নিজের জন্য বয়ে নিয়ে বেড়াই সীমাহীন আতংক আর বিরক্তি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সংবাদকর্মী