মারিয়া সালামের গদ্য ‘আল্লাহ দে ফকির’

প্রকাশিত : মার্চ ০৪, ২০২৫

ঢং ঢং ঢং... ঠিক আটটা ঘণ্টার পরেই ভয়ে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসতাম। কিছুক্ষণ পরেই কানে আসত ভরাট কণ্ঠের আওয়াজ আল্লাহ দে, আল্লাহ দে... আর তার সাথে মিলিয়ে লাঠির ঠুকঠুক শব্দ।

কণ্ঠে অপার্থিব জোর। ভয়ে আমার সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠত। লোকটিকে আমরা বলতাম, আল্লাহ দে ফকির। আমার মাকে দেখতাম, প্রতিদিন রান্নার জন্য বরাদ্দ চালের সাথে কয়েকমুঠো চাল বেশি বসিয়ে দিতেন।

প্রায় দিনই সন্ধ্যায় কাজ না পাওয়া ক্ষুধার্ত দিনমজুরদের দেখতাম ভাতের জন্য দরজায় কড়া নাড়তে। তাদের ফিরানোর নিয়ম ছিল না। এই দু’মুঠো বেশি চাল রান্না হতো তাদের জন্য। এই ভাতই কোনো কোনো দিন মা কাগজের বাক্স করে দরজার বাইরে রেখে আসতেন এই আল্লাহ দে ফকিরের জন্য। প্রতিবেশীদের বাড়িতে যে বিশাল ডুমুরগাছ ছিল, ঠিক তার নিচে, রাস্তা ঘেঁষে। কোনো কোনো দিন সেটা সে নিয়ে যেত, আবার কখনও নিত না।

আমরা কেউ জানতাম না, আল্লাহ দে ফকির কোথা থেকে আসত আর কোথায় চলে যেত। মিলানের কবিতার মতো: No one can tell me, Nobody knows, Where the wind comes from, Where the wind goes.

তাকে দেখার আগপর্যন্ত আল্লাহ দে ফকিরকে এই বাতাসের মতো মনে হতো আমার। সেই বয়সে রাতে বাড়ির চার দেয়াল পার হয়ে রাস্তায় গিয়ে তাকে দেখার সুযোগ ছিল না। তাকে দেখার আগপর্যন্ত আমার কাছে সে ছিল বাতাসের মতোই অশরীরী। ‘আল্লাহ দে’ হাঁক মনে হতো ঝড়ো বাতাসের গর্জন।

সেই আল্লাহ দে ফকিরকে দেখার জন্য একরাতে লুকিয়ে বাড়ির বাইরে পালিয়ে গিয়েছিলাম। ডুমুর গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম লোকটির জন্য। ঘড়িতে ঠিক আটটা ঘণ্টা বেজে ওঠার কিছু পরেই রাস্তার মাঝ-বরাবর হঠাৎ তাকে দেখলাম, যেন হুট করেই রাস্তায় নেমে এসেছে।

শীর্ণকায় শরীর, চটের পোশাক আর মাথায় জটা। লাঠি ঠুকেঠুকে সামনে এগিয়ে আসছে সে, সেই ভরাট কণ্ঠের আল্লাহ দে ডাক। কাছাকাছি আসতেই ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোতে একবার তাকিয়েছিলাম তার মুখের দিকে। অতি সাধারণ নাক, চোয়াল, ঠোঁট। কিন্তু দু`চোখের কোটর একেবারে ভেতরে ঢোকা, সেখানে কোন চোখ ছিল না। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে যখন বাড়ি ফিরেছি, তখন শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।

পরে মায়ের কাছে শুনেছিলাম, ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা খেয়ে লোকটা চোখ হারিয়েছে। তার দুই চোখ উপড়ে তুলে ফেলা হয়েছিল। তারপর হঠাৎ করেই একসময় খেয়াল করলাম, আল্লাহ দে ফকির আর আসে না। অনেকদিন সে আমার কাছে রহস্যের চরিত্র হয়ে থাকল। তারপর একদিন অন্যসব কিছুর মতো, অন্য সবার মতো আল্লাহ দে ফকিরের স্মৃতি ম্লান হয়ে আসলো।

অনেক বছর পরে যখন দর্শন পড়া শুরু করলাম, তখন আল্লাহ দে ফকির হয়ে উঠল আমার চিন্তার খোরাক। যে লোকটি মানুষের সম্পদ লুটে খেয়েছে, মানুষের অর্থ ছিনিয়ে নিয়ে নিজের জীবন নির্বাহ করেছে, হয়তো মানুষ হত্যাও করেছে, সে কেন মানুষের কাছে চাওয়া বন্ধ করে আল্লাহর কাছে চেয়ে খেতো? মাঝেমধ্যে মনে হয়, হয়তো তীব্র ঘৃণা বা মানবজাতির উপরে অভিমান থেকে অন্ধ হয়ে যাওয়া ডাকাতটি পণ করেছে মানুষের কাছে ভিক্ষা চেয়ে ছোট হবে না।

ভিক্ষা করা ছাড়া লোকটির কোনো গতি ছিল না, কিন্তু যারা তাকে অন্ধ করেছে তাদের কাছে চেয়ে খাওয়ার মতো দুর্বলতা সে দেখাতে চায়নি হয়তো। অনেকদিন মনে প্রশ্ন উঠেছে, লোকটির আল্লাহর ওপরে অভিমান ছিল না? কোনো অনুযোগ ছিল না? নাকি আল্লাহ সব পাপের বিচার ইহজনমেই করেন, সেই বিশ্বাস প্রবল হয়ে ওঠার ফলে লোকটি আল্লাহর কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করেছিল?

প্রশ্ন যতই থাক, উত্তর আমার অজানা। সেই শৈশব থেকে চোখ হারা আল্লাহ দে ফকিরকে মাথার ভেতরে নিয়ে ঘুরছি। শুনেছি অপরাধবোধ থাকলে এরকম হতে পারে। একবার এক হত্যা মামলার আসামির ব্যাপারে শুনেছিলাম, খুন করার পর সে ঘুমাতে পারত না, যে ছেলেটাকে হত্যা করা হয়েছিল, তার চেহারা চোখের সামনে ভেসে বেড়াত, ঠিক হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া যেমন প্রুডেনসিও আগুইলারকে দেখত।

সেই আসামিও এলাকা ছেড়ে দিয়েছিল, তারপর তার বিষয়ে তেমন কিছু জানি না। আমার তো সেরকম কোনো অপরাধবোধ হবার কথা নয়। আমি তো আল্লাহ দে ফকিরের চোখ উপড়ে তুলিনি। তাহলে মাথার মধ্যে তাকে নিয়ে কেন ঘুরছি, সেই হিসাব এখনও মেলে না।

গতকাল ভোলাতে চুরির অভিযোগ এনে যুবকের চোখ উপড়ে নেয়ার খবর পড়ার পর থেকেই মাথার মধ্যের ভারি পাথরের মতো বসে আছে, চোখে ব্যান্ডেজ করা যুবকটির অবয়ব। যুবকটি চোর কী চোর নয়, সেই প্রশ্নে যাব না। তবে যারা তার চোখ উপড়ে নিল, তারাও কি এই অন্ধ যুবককে আজীবন মাথার মধ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে? চোখ তুলে ফেললেই কি লোকটার সব অপরাধ মাফ হয়ে যাবে? নাকি চুরি বন্ধ হয়ে যাবে?

চুরির সাজা হিসেবে তার আগুল কেটে নেয়া হয়েছে। কিসের অপরাধে চোখ উপড়ে নেয়া হলো? এসব প্রশ্ন আপাতত অনেকদিন মাথায় ঘুরবে। অনেক ভোগাবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সংবাদকর্মী