‘মানুষগুরু’ বিভ্রাট এবং ফরিদা পারভীনের গান
শশী হকপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৯, ২০১৮
ফরিদা পারভিন গাইলেন:
নিরাকারে জ্যোতির্ময় যে
আকার সাকার হইলো সে।
দিব্য জ্ঞানী হয় সেই জানতে পায়
কলির যুগে হলেন মানুষ অবতার।
একই কলিতে একবার `হইল` আর পরক্ষণে `হলেন` শব্দদ্বয়ের ব্যাবহার শ্রুতিকটু এবং অলালনীয় তো বটেই। বাক্যে `হলেন` ব্যাবহারে এটাই বোঝায় যে, সাঁই নিরঞ্জন কলির যুগে আবির্ভূত হলেন মানুষাবতার রূপে, যা দিব্য জ্ঞানী হলে জানা যায়। তা এই অবতারতত্ত্ব কিন্তু শাস্ত্রে আছে এবং যা জানতে দিব্যজ্ঞান লাগে না। তাহলে লালন ঠিক কী বলেছে, আসুন শুদ্ধটা জানার চেষ্টা করি।
নিরাকারে জ্যোতির্ময় যে
আকার সাকার রূপ ধরে সে।
দিব্যজ্ঞানী হয় সেহি জানতে পায়
কলির যুগে হলো মানুষ অবতার।
অর্থাৎ, মানুষে মিশিয়া দিব্যজ্ঞানে সেই বেদান্তর (যা শাস্ত্রে নাই, অবৈদিক ) জানতে হয়, জানা যায়, যা বলে যে, কলির যুগে শুধু মানুষই অবতার, আর কিছু না। এই ভাবমতে আদম তন নিরঞ্জন হয়, নিরঞ্জন আদম তন হয় না। দুই এপ্রোচে ব্যাপক ফারাক। ফরিদা পারভীনদের পক্ষে লালনের এই অবৈদিক ভাবরস উপলব্ধি করা এখনো যে দূরহ, সেটাই বারবার প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
গানটার ভনিতা কলিতে এসে ফরিদা পুনরায় একই বিপর্যয় ঘটালেন, এবং সেটা আরো ভয়াবহ। তিনি গাইলেন,
বহু তর্কে দিন বয়ে যায়
বিশ্বাসে ধন নিকটে পায়।
সিরাজ সাঁই ডেকে বলে লালনকে
কুতর্কের দোকান সে করে না আর।
তার মানে দাঁড়ায়, বিশ্বাসী যে জন, সে ধন পেয়ে কুতর্কের দোকানদারি ক্ষান্ত দ্যায়, এমনটাই তো বুঝতে হয়। শব্দ প্রয়োগে একেবারে অলালনীয় এক ম্যারম্যারা এপ্রোচ, ‘কুতর্কের দোকান সে করে না আর’। তাহলে আসলটা কী? সেটা বলার আগে জানা দরকার যে, সিরাজ সাঁইয়ের বচনে যেসব লালন ভনিতা হয়, তার প্রায় সবটাই, গুরুর বকাঝকার এক জ্ঞান-ঝিলিক। সেখানে থাকে শিষ্য লালনের প্রতি গুরুর কড়া নির্দেশ, তীব্র শ্লেষ, তিরষ্কার, হতাশা, আর ধিক্কার-বাণী, আর এটাই লালন রীতি, স্টাইল। আর সেই রীতি এই গানের আসল ভনিতাতেও বর্তমান, যখন সিরাজ সাঁইকে বলতে শুনি (অধিকাংশ সাধকরা এইমতেই গায়),
সিরাজ সাঁই ডেকে বলে লালনকে
কুতর্কের দোকান তুই খুলিশ নে আর।
আফসোস, ফরিদা পারভীনের মতো শিল্পী এই ভঙ্গির আসল রসটাই ধরতে পারলেন না। তৈরি করলেন ভুল চরণ, নিজের বা নিজেদের মতো করে। এই আচরণ কখনো লালন-প্রেমের পরিচায়ক নয়, বরং তা এক দাম্ভিক সেচ্ছাচারিতার বিভ্রমতা।
লেখক: কবি