মহুয়ার ঘ্রাণ: একটি কুটুমপাখির খোঁজে
তাসলিহা মওলা দিশাপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৬, ২০২২
একটি কুটুমপাখির ডানায় ভর করে এগিয়ে গেছে স্বকৃত নোমানের উপন্যাস ‘মহুয়ার ঘ্রাণ’। প্রেক্ষাপট ২০২০ সালের প্রাণঘাতী করোনা মহামারি শুরুর সময়, যখন আতঙ্কে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। উপন্যাসের মূল চরিত্র অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী শিশির। সফলতার চুড়ায় দাঁড়িয়ে আছে সে। জীবনকে সে অর্থ বিত্তের পাল্লায় মাপে। সেই জীবনে ভালবাসা নেই, আছে মোহ। প্রেম নেই, আছে যৌনতা। পেশায় সে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। জীবন তার কাছে বাইনারি সংখ্যার হিসাবে বাঁধা। ০, ১ এর ছক থেকে সে বেরুতে পারে না। সেই নিয়মেই সে পরিণত বয়সে এসে পৌঁছায়। চল্লিশে। মানবজীবনের মাইলফলক হিসেবে ধরা হয় এই চল্লিশ বছর বয়সটাকে। এ সময়ে মানুষ পরিণত হয়, স্থির হয়।
এই চল্লিশে এসে শিশির আকুল হয়ে উঠল শৈশব-কৈশোরের ফেলে আসা একটি কুটুমপাখির জন্য। দূর প্রবাসে কোথায় পাবে সে কুটুমপাখি? তাকে তো ফিরতে হবে বাংলাদেশে। সে দেশে চলেও আসে। কিন্তু পায় কি কুটুমপাখির দেখা? পায় না। একসময় কুটুমপাখির খোঁজে শিশির চলে যায় খাগড়াছড়ির সাজেক। সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় হয় তুষারের সাথে। তুষার নৃতত্ত্ববিদ। তুষার ও শিশিরের কথোপকথন এখানে উপভোগ্য একটা বিষয়।
ইতোমধ্যে করোনা মহামারির কারণে লকডাউন শুরু হলে তারা আটকে পড়ে সাজেকে। পরবর্তীকালে ঘটনাচক্রে তারা এসে পৌঁছায় পার্বত্য চট্টগ্রামের এক দুর্গম গ্রামে। গোটা উপন্যাসজুড়ে লক্ষ্য করা যায় শিশিরের আকন্ঠ তৃষ্ণা সেই কুটুমপাখির জন্য।কুটুম পাখি এখানে রূপক। আমরা সবাই কোনো না কোনো পাখির খোঁজ করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। লালন শাহ ছিলেন পাখির খোঁজে, পাখির খোঁজ করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল। কুটুম পাখি এখানে শিশিরের সেই সুপ্ত সত্তা। সেই যে আকৈশোর নিজ গ্রামের অবারিত পরিবেশে বেড়ে উঠেছিল সে, সোঁদা মাটির গন্ধ গায়ে মেখে কাটিয়েছিল এক সহজ উড়ানের দিন, সেই জীবন তার অবচেতনে রয়ে গেছে। উন্নত দেশের চাকচিক্যময় জীবন, অবাধ যৌনতা, আপন বলয়ে যাপিত প্রতিটি দিন ইত্যাদি তাকে যতই অভ্যস্ত করে ফেলুক না কেন, সেই কুটুমপাখিই তার মূল সত্তা।
‘মহুয়ার ঘ্রাণ’ অনতিদীর্ঘ এক উপন্যাস। উপন্যাসের উপজীব্য হলো এদেশের অবারিত প্রকৃতি। অপার সৌন্দর্যের পার্বত্য চট্টগ্রামকে লেখক এঁকেছেন বর্ণের তুলিতে। প্রতিটা বর্ণনা এত সুন্দর, এত জীবন্ত যে মনে হবে পাঠক বুঝিবা পাহাড়েই আছেন। বলেছেন সহজিয়া মানুষগুলোর কথা, তাদের জীবনাচরন ও জীবন বোধের কথা। লেখকের বর্ণনায় উঠে এসেছে বিজু, বৈসাবি প্রভৃতি পাহাড়ি উৎসবের কথাও।
এই উপন্যাসে স্বকৃত নোমান প্রকৃতি, আধ্যাত্মিকতা, পরাবাস্তবতা ও যাদুবাস্তবতা নিয়ে কাজ করেছেন বেশ দক্ষতার সঙ্গে। স্বার্থক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বাংলাদেশের সম্পুর্ণ ভিন্ন একটা দিক। উপন্যাসে উঠে এসেছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও। শিশিরের পরম আরাধ্য কুটুম পাখি এখানে শান্তি ও সৌহার্দ্যেরও প্রতীক, যাকে নগর সভ্যতার যান্ত্রিকতায় খুঁজে পাওয়া যায় না। সে থাকে প্রকৃতির সহজিয়া পরিবেশে।
স্বকৃত নোমানের ‘মহুয়ার ঘ্রাণ’ একটি সফল উপন্যাস। তাঁর প্রথম দিককার উপন্যাস ‘রাজনটী’ থেকে একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিকের একটি উপন্যাস এটি। ‘রাজনটী’ ও ‘মহুয়ার ঘ্রাণ’ উপন্যাস দুটি একেবারে দুই মেরুর দুই সৃষ্টি। আর এ দুইয়ের মাঝের সেতুটি হল ‘উজানবাঁশি’। সৃষ্টি একমুখী হলে এক ঘেঁয়েমি চলে আসে। তাতে বৈচিত্র্য প্রয়োজন। সেই বৈচিত্র্যই আমরা দেখতে পাচ্ছি স্বকৃত নোমানের এই উপন্যাসটিতে, যা ঔপন্যাসিক হিসেবে লেখকের পরিপূর্ণতার পরিচয় বহন করছে।
‘মহুয়ার ঘ্রাণ’ প্রকাশ করেছে বিদ্যা প্রকাশ। নগর সভ্যতার যান্ত্রিকতাকে কিছুক্ষণের জন্য ভুলে থাকতে পারবেন এ উপন্যাসটি পাঠকালে। পাঠ শেষে মন আচ্ছন্ন হবে মহুয়ার নেশায়। ঘোর কাটতে লেগে যাবে কয়েকটি দিন। এমন একটি উপন্যাস পাঠকদের উপহার দেবার জন্য স্বকৃত নোমানকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
লেখক: স্থপতি