মহামারি এবং পরিবেশের প্রতি সুবিচার

আল দারদিরি

প্রকাশিত : এপ্রিল ৩০, ২০২০

পৃথিবীকে গ্রাস করে নেয়া ভাইরাসটি আমাদের জীবনের উপর ফেলেছে নানা প্রভাব। বিজ্ঞানের ভাষ্যমতে, যে ভাইরাস পশুপাখি থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়, তাকে বলা হয় জুনোটিক ডিজিজ zoonotic disease। আমাদের নিজেদের তৈরি জিনিসই আমাদের বিপদে ফেলেছে। যদি এ ভাইরাসটি ল্যাবে আবিষ্কৃত নাও হয়, তবুও এর মানে এই নয় যে, এর সাথে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণায় দেখা যায়, প্রাকৃতিক আবাসস্থল এবং বাস্তুসংস্থানের প্রতি মানুষের অন্যয্য আচরণ এ জাতীয় মহামারি ডেকে আনছে।

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “তিনিই তোমাদের বানিয়েছেন পৃথিবীর প্রতিনিধি এবং যা কিছু তোমাদের দিয়েছেন, তাতে তোমাদের পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তোমাদের কাউকে অন্যের ওপর অধিক মর্যাদা দান করেছেন। নিঃসন্দেহে তোমার প্রতিপালক শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে অতি তৎপর এবং তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও করুণাময়।” (সূরা আন`আম ১৬৫)

১৯৮০ সাল থেকে প্রতি দশকে রোগের উৎপত্তির হার তিন গুণ হয়েছে, যার দুই তৃতীয়াংশই এসেছে পশুপাখি থেকে। সম্পদের অধিক ব্যবহারের সাথে সাথেই ঘটে রোগের উত্থান। আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে সংক্রমক ব্যাধিগুলো স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে চলেছে। প্রাকৃতিক পরিবর্তন জনসংখ্যার মাঝে অস্থিতিশীলতা আনে, হাতি ও সিংহের মতো বৃহদাকার স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সংখ্যা কমায় এবং বাদুড় ও ইঁদুরের মতো ছোট প্রাণীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে পৃথিবীতে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ইঁদুর। অপরদিকে এক পঞ্চমাংশই হচ্ছে বাদুড়। যখন প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটে এবং বৃহদাকার প্রাণীরা কমে যায়, তখন এ জাতীয় ছোট প্রাণীদের উত্থান ঘটে।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ প্রদত্ত রিজিক থেকে তোমরা খাও এবং পান করো। আর পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।" (সূরা বাকারা ৬০) সূরা বাকারার এ আয়াতটি পৃথিবীতে আমাদের করণীয় ও বর্জনীয় কাজের প্রতি এক বিশেষ ফরমান। এখনো আমরা আমাদের ভূমি, মহাসাগর ও বন্যপ্রাণী ধ্বংস করছি। আপনার জ্ঞাতার্থে বলছি, পৃথিবীতে ২০% বন্যপ্রাণী আজ অস্তিত্বহীনতার সম্মুখীন। নিঃসন্দেহে এ মহামারি মহান আল্লাহর আদেশেই আঘাত হেনেছে। আমাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি দৃষ্টিপাত করার একটি সুযোগ তিনি আমাদেরকে দিয়েছেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে আমরা যা করছি না, এ মহামারি তারই প্রতিফলন।

আমাদের নবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, "কোনো মুসলমান যদি একটি বৃক্ষ রোপণ করে অথবা বীজ বোপন করে এবং তা থেকে যদি কোনো মানুষ, পাখি বা কোনো প্রাণী কিছু আহার করে, তবে তা তার জন্যে সাদাকা হিসেবে গণ্য হবে।" (বুখারী, মুসলিম)

আমাদের জীবনযাপনের জন্যে আমরা যে ধ্বংসাত্মক কাজগুলো করেছি, নিঃসন্দেহে তা আমাদের ধর্মীয় শিক্ষার বিপরীত। আমরা আমাদের পরিবেশের সাথে কেমন আচরণ করবো, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তা আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। তেমনই একটি শিক্ষা হচ্ছে, "তোমরা গাছ উপড়ে ফেলো না বা পুড়িয়ে দিও না এবং ফলদ বৃক্ষ কেটে ফেলো না।" (আল মুয়াত্তা)

যখন আমরা এই কাজগুলো করি, তখন আমরা আমাদের প্রকৃতিকে পরিবর্তন করে ফেলি এবং বন্যপ্রাণীকে আমাদের প্রয়োজনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্যে জোর করি। এই কাজে কিছু সফলতা এবং কিছু ব্যর্থতা আসবে এবং স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রজাতির সংখ্যা বেড়ে যাবে। যেহেতু আমরা বনাঞ্চল উজাড় করে বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস করে দিচ্ছি, পশুসম্পদ নিজেদের বানিয়ে নিচ্ছি, বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নিচ্ছি, সেহেতু আমরা নিজেদেরকে ব্যাপকভাবে এসব ভাইরাস এর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। কেননা আমাদের আত্মসাৎকৃত এসব স্থান থেকে ভাইরাসকে কিন্তু তাড়াতে পারিনি। ইউনিভার্সিটি অভ টেক্সাস হেলথ সায়েন্স সেন্টারের বায়রোলজি (ভাইরাসবিদ্যা) বিভাগের অধ্যাপক ইয়ান জিয়াং বলেছেন, "আমরা বন্যপ্রাণীদের খুব কাছাকাছি চলে যাচ্ছি। এ কারণে আমরা এসব নানাবিধ ভাইরাসের সংস্পর্শে আসছি।"

হাজার বছর আগে দুই তৃতীয়াংশ গ্রহের অবস্থান ছিল উষ্ণমণ্ডলীয় ঘনবর্ষণ বনাঞ্চলে (রেইনফরেস্ট)। কিন্তু প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ায় বর্তমানে তা অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। বন উজাড় করার ফলে (সাময়িকভাবে) এমন কিছু ক্ষুদ্র প্রভাব পড়ে, যা আমরা দেখতে পাই না। আমরা এর ফলাফল ঠিক তখনই টের পাই, যখন খুব দেরি হয়ে যায়। বন নিধন করার পরিবর্তে আমাদের উচিত বনাঞ্চলকে পুনরায় সঞ্জীবিত করে তোলা। পশুপাখির আবাসস্থল ধ্বংস করে দিয়ে আমরা বিভিন্ন ভাইরাসকে আমাদের ওপর আঘাত হানার পথ তৈরি করে দিই। কাঁচা বাজার Wet market, অবৈধ বন্যপ্রাণী-বাণিজ্য এবং বিভিন্ন ফার্ম-ফ্যাক্টরি দ্বারা আমরা আজ বন্যপ্রাণীদের এ অবস্থায় ফেলেছি। আমরা যদি তাদেরকে তাদের মতো করে ছেড়ে দিতাম বা এ ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহকে অনুসরণ করতাম, তাহলে আজকে এ অবস্থা হতো না।

আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি যে, জীবজন্তুরও অধিকার আছে। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত। মহানবি (সা.) গর্ভবতী পশুর বাচ্চাকে বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন। (সুনানে নাসাঈ ৪৬২৩) পশুপাখির ক্ষতি করা একটি পাপ। আমর বিন শাবিদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহকে (সা.) কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি কোনো চড়ুইকে অযথা হত্যা করলো, কিয়ামতের দিন তা আল্লাহর নিকট উঁচু স্বরে ফরিয়াদ করে বলবে, ইয়া আল্লাহ, অমুক ব্যক্তি আমাকে অযথা হত্যা করেছিল। সে কোনো লাভের জন্যে আমাকে হত্যা করেনি।" (সুনানে নাসাঈ ৪৪৪৬)

আমাদের নিজেদেরকে নিয়ে ভাবতে হবে এবং বুঝতে হবে প্রকৃতি আমাদেরকে কীভাবে উপকৃত করে থাকে। বন নিধন এবং লক্ষ লক্ষ বন্যপ্রাণীকে সংকটময় অবস্থায় ঠেলে দেয়াই কি আমাদের ধ্বংসের কারণ নয়? আমরা প্রকৃতির অংশ। আমরা এমন এক বাস্তুসংস্থানের ecosystem অংশ, যেখানে আমাদের স্বাস্থ্য বন্যপ্রাণী, পশুসম্পদ এবং পরিবেশের সাথে জড়িত। সুতরাং কুরআন-সুন্নাহ অনুসারে আমাদের বেঁচে থাকার সঠিক পথ অনুসন্ধান করা উচিত।

অনুবাদক: দ্বীন মুহাম্মাদ শেখ

উৎস: https://muslimmatters.org