
মহাকালে রেখাপাত
পর্ব ৪৩
স্বকৃত নোমানপ্রকাশিত : মার্চ ১৮, ২০২১
গদ্যেরও প্রাণ আছে। সপ্রাণ গদ্য পাঠকের সাথে কথা কয়। এই গদ্য স্বতঃস্ফূর্ত, তাতে বানিয়ে তোলার ব্যাপার নেই। সে আসে চেতনার গভীর থেকে। মরমের গভীর থেকে নির্গত গদ্য পাঠকের ওপর প্রভাব ফেলে। এই গদ্য তরুণী প্রেয়সীর মতো। সদা সে প্রাণোচ্ছ্বল, সদা উজানী স্রোতের মতো দামাল। বয়ে চলে তীর-বাঁধ ভেঙে। সে চিরকালের বাধনহারা। সবসময় ব্যাকরণ মানে না। কখনো কখনো ভেঙে দেয় ব্যাকরণ।
এই গদ্যের ভেতরে কোনো সংশয় নেই, কোনো দ্বিধা নেই, কোনো জড়তা নেই। গদ্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে গদ্যকার শতভাগ নিশংসয় না হলে তার পক্ষে এই গদ্য লেখা অসম্ভব। এই গদ্যের সাথে, পাশাপাশি, পাঠকও হাঁটে, ছোটে। যেমন পাশাপাশি হাত ধরে ছোটে প্রেমিকযুগল। সপ্রাণ গদ্যে আছে আশ্চর্য মাদকতা। পাঠককে সে করে তোলে নেশাতুর। সপ্রাণ গদ্যে সুর আছে। সেই গদ্য সুরের লহরীতে পাঠকচিত্তকে করে তোলে আকুল। যেমন মার্কেজ, মানিক, বিভূতি, তারা, দেবেশ, ইলিয়াস প্রমুখের গদ্য।
কোনো কোনো গদ্য প্রাণবান, সুরবান, কিন্তু স্বভাবে সে গম্ভীর। প্রবল ব্যক্তিত্ববান। পাঠক তার সাথে পাশাপাশি ছুটতে পারে না। তার ভাঁজ খুলতে হয়। ভাঁজ খুলে খুলে তাকে দেখতে হয়, আবিষ্কার করতে হয়। সে অতলান্ত সমুদ্রের ঝিনুকের মতো, যে ভেতরে লুকিয়ে রাখে মুক্তোদানা। কিংবা সে মাটির গভীর গহীনের হীরক। মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে তাকে তুলে আনতে হয়। সেই খোঁড়ার মধ্যে পাঠকের কষ্ট থাকে না, ক্লান্তি থাকে না; থাকে আবিষ্কারের উত্তেজনা, প্রাপ্তির আনন্দ। যেমন কমলকুমারের গদ্য।
আরেক ধরনের গদ্য আছে, যা বয়সের ভারে নব্জ্যু ব্যক্তির মতো। সে ‘হ্যাঞ্চ ব্যাক অব নটরডেমে’র সেই কুঁজোর মতো। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হাঁটে, লাঠিভর দিয়ে হাঁটে। সে নিভু নিভু প্রদীপের মতো। তার প্রাণ উচ্ছ্বল নয়, তার সুর মনোহর নয়। আরেক ধরনের গদ্য আছে, যাতে প্রাণ আছে, কিন্তু সুর নেই। যেমন সংবাদপত্রের গদ্য। সে সকালের পান্তাভাত কিংবা কলা-পাউরুটির মতো। খেতে হয় বলেই খাওয়া। তাতে জিজ্ঞাসা নেই, উত্তর নেই, দর্শন নেই, গভীর কোনো উপলব্ধি নেই।
আবার আরেক ধরনের গদ্য আছে যাতে প্রাণ নেই, সুর নেই, প্রবল ব্যক্তিত্বও নেই। সে পাহাড়-অরণ্যের কণ্টকাকীর্ণ পথের মতো। হাঁটতে গেলে পায়ে ব্যথা লাগে। তা শিল্পের গদ্য নয়, প্রয়োজনের গদ্য। এই গদ্য পরীক্ষার খাতায় লিখিত হয়। অফিসের ফাইল, নোট, দলিল, পর্চা, বাজারের ফর্দে লিখিত হয়। তাতে সাহিত্য হয় না, শিল্প হয় না।
যে গদ্যকার গদ্যকে একইসঙ্গে প্রাণবান, সুরবান আর ব্যক্তিত্ববান করে তুলতে পারেন তিনিই বড় গদ্যকার। তাকেই আমরা বলি গদ্যশিল্পী, কথাশিল্পী। তাকেই আমরা জানাই নমষ্কার। চলবে
১৭ মার্চ ২০২১