মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৪০

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৯, ২০২০

গতকাল দেওয়ানবাগী পীর মাহবুবে খোদার মৃত্যুর পর পত্রিকাগুলো নিউজ করেছে। ফেসবুকে আসা নিউজ-লিংকের কমেন্টগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলাম। হাজার হাজার কমেন্টকারীর কমেন্টগুলো পড়ে মনে হচ্ছিল, স্রষ্টার সর্বময় ক্ষমতা তাদের হাতে। দেওয়ানবাগী যে নিশ্চিতভাবেই নরকবাসী হবেন, সেই সার্টিফিকেট তারাই দিয়ে দিচ্ছে। কবরে তারাই মনকির-নকিরের ভূমিকা পালন করবে। গজবের ফেরেশতা হিসেবে তারাই মুগুর নিয়ে হাজির হবে। হাশরের মাঠে তারাই পাপ-পুণ্যের বিচার করবে। এবং দেওয়ানবাগী স্বর্গে যাবেন, না নরকে যাবেন, তা তারাই নির্ধারণ করবে।

জানি না ইসলাম এই শিক্ষা দেয়া কিনা, এই গালাগালি নিন্দা-মন্দ শিক্ষা দেয় কিনা। হয়তো দেয়। নইলে এরা এত গালাগালি এত নিন্দা-মন্দ কোথা থেকে শিখল? দেওয়ানবাগীকে গালাগালির বন্যার স্রোত দেখে কেবলই মনে হচ্ছিল, ‘ঢাল মে কুচ কালা হ্যায়।’ নইলে কট্টরপন্থিরা তাকে কেন এভাবে গালাগাল করছে? কিন্তু ‘কালাটা’ কী, ঠিক খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

আজ সকালে কবি ডাল্টন সৌভাত হীরার একটি পোস্ট চোখে পড়ল। দেওয়ানবাগী যে একজন মুক্তিযোদ্ধা সেই প্রমাণ হাজির করেছেন তিনি। মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতিক তার ‘মিশ্রকথন’ বইয়ে লিখেছেন, দ্বিতীয় বা তৃতীয় নম্বর সেক্টরের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এমন পাঁচজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ যদি না করি, তাহলে নিজের বিবেকের কাছে অপরাধী থাকব। প্রথমে হলেন জনাব নুরুদ্দীন মাহমুদ কামাল, দ্বিতীয় হলেন এম এ মাহী, তৃতীয় হলেন জনাব আলকাস মিয়া, চতুর্থ হলেন জনাব আশিক আহমেদ এবং পঞ্চম হলেন জনাব মৌলানা মাহবুবে খোদা।

সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতিক আরও লিখেছেন, দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট যখন পুনর্গঠিত হয় তখন ব্যাটালিয়নের রিলিজিয়াস টিচার বা ধর্মীয় শিক্ষক বা ইমাম সাহবের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তখনকার তরুণ মাওলানা মাহবুব এ খোদা। স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর তিন নম্বর সেক্টর রূপান্তরিত হয়েছিল ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। জনাব মাহবুবে খোদা ১৬ ইস্ট বেঙ্গল থেকে চাকরি ছেড়ে অন্যান্য কাজে নিবিষ্ট হন। বর্তমানে তিনি ঢাকা মহানগরের আরামবাগে অবিস্থিত ‘বাবে রহমত’ নামক স্থানের সত্ত্বাধিকারী এবং সম্মানীতি ‘দেওয়ানবাগী পীর’ হিসেবে সুপরিচিত।

বাংলাদেশের ইসলাম ধর্মবিদরা বহু ভাগে বিভক্ত। একভাগে রয়েছে আটরশি, কুতুববাগী, মাইজভাণ্ডারি, দেওয়ানবাগীসহ এরকম আরো বিস্তর সুফিমতের অনুসারীরা। আরেকভাগে রয়েছে ওয়াহাবি, সালাফি, জামায়াত, হেফাজত, চরমোনাইয়ের অনুসারীরা। প্রথমোক্ত শাখার অনুসারীরা মাজারপন্থি সুফি, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, জঙ্গিবাদ বিরোধী, অনেকাংশে অসাম্প্রদায়িক এবং শান্তিপ্রিয়। দ্বিতীয়োক্ত শাখায় রয়েছে ওয়াহাবি, সালাফিরা। তারা অসাম্প্রদায়িক কিনা, জঙ্গিবাদ বিরোধী কিনা, শান্তিপ্রিয় কিনা, তা এরই মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ জেনেছে। তারা প্রতিনিয়ত মাজারপন্থি সুফিদের ‘ভণ্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। বেদাতি, কাফের, মোনাফেক বলতেও দ্বিধা করে না।

দেওয়ানবাগী ছিলেন মাজারপন্থি তথা তরিকতপন্থি একজন পীর। জীবৎকালে তাকে ওয়াহাবি-সালাফিরা ‘ভণ্ড’ বলে আখ্যায়িত করত, মৃত্যুর পরও করছে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার জল সেচা সম্ভব, কিন্তু বাংলার মুসলমানদের মধ্যে কে ভণ্ড, কে সাধু, তা নির্ণয় করা অসম্ভব। সুতরাং দেওয়ানবাগীর ধর্মমত নিয়ে, তার পন্থা নিয়ে, তার সুফিমত নিয়ে, তিনি মানুষকে কুসংস্কার শিক্ষা দিতেন কিনা, তার অনুসারীরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন কিনা, ধর্মমতে তিনি ভণ্ড, না সাধু... এসব নিয়ে বিস্তর বিতর্ক করা যাবে। আপাতত এসব নিয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই। কিন্তু তিনি যে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। তিনি যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলতেন, তাতে সন্দেহ নেই। তিনি যে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, তাতে সন্দেহ নেই।

জীবৎকালে দেওয়ানবাগী নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতেন। কখনো কখনো নামের আগে মুক্তিযোদ্ধা লিখতেনও। তখন আমাদের সংশয় ছিল আসলেই তিনি মুক্তিযোদ্ধা কিনা! সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতিকের বই প্রমাণ দিচ্ছে তিনি একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। যদি তাই হয়, তবে দেওয়ানবাগীকে কেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে না? কেন গার্ড অব অনার দেওয়া হবে না? রাষ্ট্রের কাছে এই প্রশ্নটি থাকল। নাকি দেওয়া হচ্ছে? ঠিক জানি না। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রয়াত মাহবুবে খোদা দেওয়ানবাগীর প্রতি অতল শ্রদ্ধা। চলবে