মনোয়ার রুবেল
মনোয়ার রুবেলের গদ্য ‘স্বকৃত নোমানের সাহিত্য-ভ্রমণ’
প্রকাশিত : মার্চ ১৮, ২০২২
ভ্রমণকাহিনি উলম্ব হতে পারে, আনুভূমিক হতে পারে। এ দুইটার কোনোটা ছাড়াও ভ্রমণ হতে পারে। সে নিশ্চয়ই এক অদ্ভুত ভ্রমণ হয়ে থাকে, কাহিনিও অদ্ভুত হয়। একদেশ হতে আরেক দেশে ভ্রমণ আমার কাছে আনুভূমিক ভ্রমণ। যেমন, হুমায়ূনের যশোহা বৃক্ষের দেশে, সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে কিংবা ইবনে বতুতার সফরনামা। পৃথিবী থেকে খাড়া ওপরে ইশ্বরের দিকে যাত্রাকে উলম্ব ভ্রমণ বলা যায়।
ইসলাম ধর্মমতে, হযরত মুহাম্মদ (স.) প্রথম উলম্ব ভ্রমন করেন। তিনি আরশে আজিম পর্যন্ত পৌঁছে যান বোরাকে চড়ে৷ খোদা সপ্তাকাশে থাকেন৷ এখন মানুষ ঈশ্বরের বাড়ির রাস্তা ধরে অনেক এগিয়েছে, মহাকাশে গিয়েছে, চাঁদে গিয়েছে। পৃথিবী থেকে চাঁদের ভ্রমণ উলম্বকারে হয়। মাইকেল কলিন্স লিখেছেন এক উলম্ব ভ্রমন কাহিনি ‘ক্যারিয়িং ফায়ার: এন এস্ট্রোনাট জার্নি’৷
স্বকৃত নোমানের যে ভ্রমণ, তা একজন পাঠক থেকে লেখক হয়ে ওঠার জার্নি৷ তার জার্নি এখনো শেষ হয়নি, ভ্রমণের মাঝপথেই দাঁড়িয়ে তিনি আমাদের ভ্রমণকাহিনি শোনাচ্ছেন তার বই ‘উপন্যাসের পথে’তে। একুশের বইমেলায় পাঠক-সমাবেশ স্টলে বইটি যখন হাতে নিই তখন আমার হাতের টাকা অন্য বই কেনার অপেক্ষায় রক্ষিত ছিল। ফ্ল্যাপে স্বকৃত বলছিলেন, ‘উপন্যাস লেখার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ প্রস্তুতির। প্রথমে হতে হবে নিজের মুখোমুখি। দেখতে হবে নিজের মধ্যে এক ঋষি বাস করে কিনা, জগতের সমস্ত কিছুকে উপক্ষা করে যে নিজের সাধনায় রত, মোহময়ী অন্সরীও যার ধ্যান ভাঙাতে পারে না। যদি সেই ঋষির সন্ধান পাওয়া যায়...।’
স্বকৃত নোমানের এ বই সেই ঋষির সন্ধানে ভবঘুরে এক সাধকের, এক পরিব্রাজকের দুই দশক ভ্রমণের। স্বকৃত একজন গল্প লেখক, একজন উপন্যাস লেখক, প্রবন্ধ লেখক। তিনি যে একজন উপন্যাস লেখক, তার যে বালেগপ্রাপ্তি, তা একদিনে বা একবছরে ঘটেনি। তিনি এই জগতে শিশু ছিলেন, কিশোর ছিলেন, চলতে হোঁচট খেয়েছেন, পা মচকেছেন, বহু ক্ষয়জয় পরেই বালেগপ্রাপ্তি ঘটেছে।
এ পথ ভ্রমণে সবচেয়ে বড় ঝাঁকি ছিল সেলিম আল দীনের পত্নী মেহেরুন্নেসা কর্তৃক লেখা চুরির অভিযোগ। স্বভাবতই যে কোনো লেখকের জন্য এমন তীরবিন্দুর অগ্রভাগে লক্ষ্যজন হওয়া বিব্রতকর। স্বকৃত লিখেছেন, ‘যে বাঙালি বলে নজরুলের লেখা চুরি করে নোবেল পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, সেখানে স্বকৃত নোমান কোন ছার!’
বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার অভিযোগ স্বকৃতর লেখক স্বীকৃতির পথে ধাক্কা ছিল। কিন্তু তিনি অভিযোগ উতরে গিয়েছেন বহু আগেই। তিনি পরপর বই লিখেছেন, গল্প বলেছেন। তবে এ অভিযোগ এখনো তার মনোবেদনার কারণ হয়। এ তীর হয়তো সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়াবে। তিনি লিখেছেন, ‘আমি জানি, আমি যতদূর যাব এ অভিযোগ ততদূর যাবে। ছায়ার মতো।’
স্বকৃত নোমান ‘উপন্যাসের পথে’ বইটি উৎসর্গ করেছেন বেগমজাদী মেহেরুন্নেসাকে। নোমান রাজনটী নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন। তার লেখালেখিতে এই বই একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। বইটি কিভাবে লেখা হলো সেই গল্প `উপন্যাসের পথে` ভ্রমণ কাহিনিতে বলা হয়েছে। শুধু রাজনটীই নয়, প্রায় সব বই লেখার ইতিবৃত্ত উপন্যাসের পথেতে লেখা হয়েছে।
রাজনটীর সৃষ্টি কুমিল্লার একটি মসজিদ ঘিরে। এ মসজিদে কেউ নামাজ পড়ে না। কারণ যিনি এই মসজিদের অর্থ দিয়েছেন তিনি একজন নটী। এদেশের মসজিদে ঘুষখোর, মদখোর, জুয়াখোর, ইয়াবা ব্যবসায়ীর টাকা কিছু না কিছু বিনিয়োগ আছে। ঘুষখোরের টাকায় ঈমাম সাহেবের বেতন হয়। তারা পুরুষ, তাই তাতে মৌলভীদের বা আল্লাহর বান্দাদের আপত্তি নাই। শুধু নটীতে তাদের ঈমানি জজবা জেগে ওঠে। নটীর আল্লাহপ্রেম আল্লাহর বান্দাদের কাছে মূল্যহীন হয়।
স্বকৃত নোমান লিখেছেন, তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনে এই মসজিদের সংবাদ পড়ে তখুনি রওনা হন কুমিল্লায়, তারপর ভারতে ত্রিপুরায়। উদয়পুর রাজবাড়িতে নটীর আত্মা খুঁজে বেড়িয়েছেন। তিনি পথে পথে ঘুরেছেন এই গল্প নিয়ে। তাকে এই নটীর গল্প লিখতেই হবে। তিনি লিখলেন, রাজনটী।
উপন্যাসের পথে বইতে উপন্যাসের পথে যাত্রা, এক প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বি, একটি ভুল ও উপন্যাসের নামকরণ, এক বাঈজীর আখ্যান, একটি মানবিক গল্প বলার চেষ্টা, গরানপুরের পটভূমিকায় সমগ্র বাংলাদেশ, ইতিহাসভিত্তিক একটি উপন্যাস, সমুদ্রভাসা মানুষের কাহিনি, একটি সংবাদ থেকে একটি উপন্যাস, উজানবাঁশির উজানকথা শিরোনামে লেখকের বিগত উপন্যাসসমূহের ‘শানে নুযুল’ ছিল। ছিল উপন্যাস লেখার পেছনের গল্প। এসব গল্প সাধারণত লেখকরা গুছিয়ে বলে না৷ স্বকৃত নোমান বলেছেন। উপন্যাসের পথে ভ্রমণের গল্পগুলো অনিসন্ধিৎসু মনের জন্য সুখপাঠ্য হবে, বলাই বাহুল্য।
যারা স্বকৃত নোমানের উপন্যাসের সাথে পরিচিত তারা জানেন, তিনি সোঁদা মাটির গল্প বলেন। তার গল্পে কুপির তেল পোড়া গন্ধ পাওয়া যায়, খড়ের গাঁদায় বৃষ্টিভেজা ভাঁপ পাওয়া যায়, নলকূপে হাতল আচড়ে পড়ার শব্দ পাওয়া যায়, মৌলভীর গলায় ফজরের আজানের সুর পাওয়া যায়। সমসাময়িক যারা গল্প বলছেন তাদের মধ্যে স্বকৃতর গল্পেই অধিকতর বাঙলার ও বাঙালিময়। তাই তিনি যখন গল্প বলেন, কোথায় সেই গল্পের প্লট পান তাও শুনতে আনন্দদায়ক হওয়ার কথা। হয়েছেও তাই।
টিভিতে দেখলাম বলা হচ্ছিল, স্বকৃত নোমানের এই বই নতুন লেখকদের জন্য। এটাতে আমার আপত্তি আছে। একজন মানুষ লেখক হয়ে ওঠার গল্প শুধু নতুনদেরই কেন জানতে হবে! এটাতে বই ক্লাসফাইড হয়ে যায়। এটা গাইডবই নয় যে, নতুনরা পড়বে ও উপন্যাস লেখা শিখে যাবে। হ্যা, বইয়ের শুরুর অর্ধেক লেখালেখির আদব কায়দা নিয়ে স্বকৃতর ব্যক্তিগত প্রত্যক্ষণ রয়েছে। সেগুলো মূল্যমান বিচারে উত্তম প্রবন্ধ।
একজন লেখক হাজার হাজার শব্দ লিখে সম্পাদনায় তার অর্ধেক ফেলে দেন। পাতার পর পাতা লিখলেই উপন্যাস হয় না। উপন্যাসকে স্থাপত্যে আলাদা শৈলী দিতে হয়, অবয়ব দিতে হয়। এটা নতুনদের জন্য পাঠ্য হতে পারে ঠিকই, কিন্তু বিপণন কৌশল হিসেবেই যদি এটাকে নতুনদের জন্য গাইড বই হিসেবে উপস্থাপন করা হয় তবে বলতে হয়, প্রকাশক এই বইয়ের গাম্ভীর্যের প্রতি সদয় হতে পারতেন।
এজন্যই হয়তো স্বকৃত নোমানেরে এই বইতে সম্বোধনে দ্বিধা চোখে পড়েছে৷ ফ্ল্যাপে পাঠককে মধ্যম পুরুষে সম্মানসূচক ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছেন, আবার মূল বইয়ে লেখায় ‘তুমি’ করে বলছেন৷ পুরো বইটি ফ্ল্যাপের আত্মীয়তা ধরে রাখলেই বই ভারী হতো। লেখক হয়তো ধরেই নিয়েছেন, বইটি অপেক্ষাকৃত তরুণরা কিনবেন। তিনি নিশ্চয়ই জানেন, লেখক যে লেখাই লেখেন তিনি সমকালের কথা ভবিষ্যতের জন্য কলমে তুলে রাখার জন্য লেখেন। লেখক সচেতন না থাকলেও প্রতিটি লেখাতেই এই ঘটনা ঘটে। কারণ, বই সর্বকালের, সর্বপাঠকের।
উপন্যাসের পথে যদি কেউ রিভিউ লেখে তবে এটাকে গল্পের মতো ব্যবচ্ছেদ সম্ভব নয়, কারণ এটা গল্পের বই-ই নয়। আবার তিনি যে পাঠকের সাথে বৈঠকি চালে কথা বলছেন, তা গল্পও বটে। তিনি পুরো বইয়ে অনুজ লেখকের সাথে কথপোকথনের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। তিনি কথা বলছেন একজন অদৃশ্য পাঠকের সাথে, যে পাঠক উপন্যাস ও সাহিত্য সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু। যে কথোপকথনে প্রশ্ন নেই, শুধু উত্তরমালা আছে। স্বকৃত নোমান উত্তর দিচ্ছেন। এই বইয়ের স্বকৃতর সাফল্য তিনি আরও অনেকগুলো বই পড়তে পাঠককে উসকে দিচ্ছেন। তিনি একটি বিস্তৃত তালিকা দিয়েছেন। লেখক হওয়ার পথে একশো চারটি বইয়ের কৃতজ্ঞতার কথা স্মরণ করেছেন।
এই তালিকায় যেমন টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস আছে, তেমনি সতীনাথ ভাদুড়ির ঢোঁড়াই চরিত আছে। ওরহান ফামুক, মিশেল ফুঁকো, কাফকা, উইকিয়াম ফকনার, মার্কেস, রবীন্দ্রনাথ, হাসান আজিজুল হক সবাই আছেন। লেখক হতে হলে সাধনার মূলমন্ত্র হচ্ছে, অধ্যয়ন। ‘উপন্যাসের পথে’ সেই খিদে জাগাতে চেয়েছে। অন্তত একটি তালিকা পাঠক পাবে যে বইগুলো বিশ্বসাহিত্যের স্বাদ দেবে। পাঠক মেলা থেকে কোন বইগুলো কেনা উচিত তারও একটি তালিকা পেল। মেলায় বেশিরভাগ ক্রেতাই দিশাহীন রিকশাঅলার মতো দিগ্বিদিক ঘোরে। এখন মেলায় বিস্তর বই বের হয়। কাগজ কালির দাম কমেছে, বই প্রকাশ সাশ্রয়ী হয়ে গিয়েছে। হাজার বিশেক টাকা হলে বই বের করা যায়।
এখন বই মানে, ট্যানট্যানানি প্রেমের গল্প, পরকীয়ার গল্প, মোবাইলের হাই হ্যালো, এইই তো। সবাই লেখক হতে চায়। ফেসবুকের নিজের বইয়ের প্রচ্ছদ দিয়ে ফটো দিতে চায়। তারা একটা বই লিখে অর্গাজম হলে আর বই মুখো হচ্ছেন না। লিখতে পারছেন না। প্রথম বইয়ের পর তাদের মস্তিষ্কে লেখার মতো আর কিছুই থাকছে না। তারা ঈশ্বরের পানে তাকিয়ে থাকেন আরেকটি গল্পের প্লটের জন্য। এ নিদারুণ প্রতিভা শূন্যতার কারণ, তারা পড়ছেন না। তাদের পড়তে হবে। স্বকৃতর উপন্যাসের পথে পড়ার সাথে সাথে আরো অনেকগুলো বই পড়ার খিদে তৈরি হতে পারে। লেখক হিসেবে পাঠক তৈরি করার ক্ষমতা ঈশ্বর প্রদত্ত সর্বোত্তম উপহার। স্বকৃতর সেই ক্ষমতা আছে।