মন বোঝোনি, মানুষ বুঝবে কি করে?
জুবায়ের আহমাদপ্রকাশিত : আগস্ট ২৮, ২০২২
১২০৩ বাংলা সন। ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির নদিয়া বিজয়ের মাধ্যমে বাংলায় শুরু হয় মুসলিম শাসনের যুগ। মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ইরান থেকে কবি, দার্শনিক ও সুফি দরবেশের আনাগোনায় মুখরিত হতে থাকে বাংলা। সেই সময় ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি পায় নতুন এক প্রাণ। এমনিতেও তখন সংস্কৃতি চর্চার দারুণ সময় কাটছিল, তার ওপর যখন ফার্সি ভাষার সহচার্য পেল, শিল্প ও সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ হলো। যেন পরম মমতায় জড়িয়ে রাখা পরিহিত কোনো পাঞ্জাবি। মুগ্ধতার আবহে মানুষের ঝোঁক বাড়তেই থাকল এই ভাষাটার প্রতি। যদি বলা যায়, ফার্সি ভাষাটা প্রেমের, সম্পর্কের, সংপৃক্ততার, সংযুক্তির— মনে করি ভুল হবে না। যদি যুক্তি দেখানো হয়, ফার্সি বোঝোনি তো মন বোঝোনি, আর মনটাই যেহেতু বোঝোনি, মানুষ বুঝবে কি করে? তবে কি বাড়াবাড়ি রকমের ভুল হবে?
১২০৪ থেকে ১৮৩৭ পর্যন্ত ফার্সি ছিল বাংলার রাষ্ট্রভাষা। এর মাঝে যেসব শাষকরা এসেছেন সকলেই ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিকাশে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করেন। কবি আলাউলও খুব ভালো ফার্সি জানতেন। পলাশি যুদ্ধে পরাজয়ের পর মুসলিম শাসনামল শেষ হয়। শুরু হয় কোম্পানির শাসন। ক্ষমতার পালাবদলে সমস্ত শাষক যেই কাজটি সর্বপ্রথম করে সেই কাজটি বৃটিশরাও বাদ রাখল না। বরং আরো নিখুঁতভাবে করল। সুচতুরভাবে ঘোষণা করল, ফার্সি ভাষা ধর্মীয় ও সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভাষা। প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক সব জায়গা থেকে ফার্সি বিলুপ্ত হলো। ইংরেজি হয়ে গেল প্রশাসনিক ভাষা। অফিস আদালতের ভাষা। শাসকরা ক্ষমতায় আসে, চলেও যায়। ক্ষমতা পাওয়ার পর শাসক হয়ে ওঠে শোষক। খুব কমনলি সকলেই মানুষের ভাষায় আঘাত করে, মুখে আঘাত করে। মুখ থেকে কথা বন্ধ হয়ে যায়। ভাষা থুবড়ে পড়ে থাকে।
দীর্ঘ ছয়শো বছর ফার্সি ভাষা রাজভাষায় অধিষ্ঠিত ছিল বলে ভারতবর্ষের সাহিত্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গিয়েছিল। দাপ্তরিক ভাষা হওয়ায় হিন্দু-মুসলিম সকলের মাঝেই ভাষিক বন্ধন তৈরি হয়েছিল। এই ভাষিক বন্ধনটা ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছিল। এবং হয়েছিলও তাই। সেই সুলতানি আমল থেকে মোঘল আমল পর্যন্ত মুসলিম শাসনামলে কারো মনস্তত্ত্বে ধর্মীয় বিভেদ খুব একটা ছিল না। ফার্সি ভাষাকে এজন্য বন্ধু ভাষাও বলা হয়। তবে সাধারণ মানুষের মাঝে একাদশ শতকের প্রথমার্ধে পারস্য থেকে আসা মানুষ এবং পাঞ্জাবের স্থানীয় লোকদের মাঝে ভাবের আদান-প্রদানের জন্য ডায়ালেক্ট হিসেবে ফার্সি-আরবি-হিন্দি ও আরো বিভিন্ন গোত্রীয়, আঞ্চলিক শব্দ মিশ্রণে একটি সাবলীল ভাষার জন্ম হয়েছিল। ভাষাটার নাম হচ্ছে, উর্দু। সম্রাট আকবরের সৈন্যরা নিজেদের যোগাযোগের জন্য উর্দু ভাষাকেই বেছে নিয়েছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে এই ভাষার নাম ছিল, রেখ্তি। পরবর্তীতে উর্দু নামকরণ করা হয়। উর্দু শব্দের অর্থ রাজকীয় শিবির।
মুসলিম শাসনামলে ফার্সি ভাষা হিন্দু-মুসলিমদের মিলনের মাধ্যম হিসেবেই গণ্য করা হয়েছিল। যেই ভাষাকে বলা হতো হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রাথমিক ভিত্তি। সেই ভাষাকে দুর্বল করে হিন্দু-মুসলিমের মাঝে ঐতিহাসিক ঐক্য বিনষ্ট করার চেষ্টায় বিভেদের যেই বীজ তারা বপন করেছিল, ভারতবর্ষে রাজনৈতিকভাবে ফায়দা হাসিলের জন্য যেসব কৌশল তারা গ্রহণ করেছিল তার মধ্যে ভাষাগত বিভেদ সৃষ্টি ছিল তাদের অন্যতম কৌশল। এই কৌশলে তারা খুব সহজে সফল ও হয়। ফার্সিকে বিলুপ্ত করার পর উর্দু হয়ে উঠেছিল জনপ্রিয়। গুরুত্বের দিক থেকে মনে করা হচ্ছিল উর্দুই হয়তো দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা পাবে। কিন্তু বৃটিশ ইস বৃটিশ! ইংরেজিকে দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণা দিলো। তবে পাশাপাশি উর্দু ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা করে মুসলমানদের মন রক্ষা করল। হিন্দুরা কিছুটা ক্ষোভের মধ্যেই ছিল এমন সিদ্ধান্তে। বৃটিশদের এই ভাষানীতির কূটকৌশলে অবচেতনমনে হিন্দুরা হিন্দি ভাষা এবং মুসলিমরা উর্দু ভাষাকে নিজস্ব ভাষা হিসেবে গণ্য করা শুরু করল। ঐক্য ও বন্ধনের ভাষা ফার্সিকে মুছে দিয়ে যেই ফাটল ধরিয়েছিল বৃটিশরা। ভাষাগত বিভক্তি সৃষ্টি করে যেই বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিল। সবার অগোচরে সেই বৃক্ষ ফলবতী হতে থাকল।
রাজনৈতিকভাবেও সৃষ্টি হলো দুটি দল, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ। কংগ্রেস হিন্দি ভাষার প্রমোট করতো, হিন্দিকে রাষ্ট্র ভাষা করবার চেষ্টা করতো আর মুসলিম লীগ উর্দুকে। ভাষাভিত্তিক বিভক্তির পর রাজনৈতিকভাবেও বিভাজন তৈরি করে ধর্মীয় দাঙ্গার দিকে টেনে নিয়ে গেল দুটি জাতিকে। এর পেছনে বৃটিশদের অদৃশ্য হাত ছিল ক্রিয়াশীল। এসব বিভাজনই ভারতবর্ষকে খণ্ড খণ্ড করে দেয় ১৯৪৭ সালে। দুটি রাষ্ট্রর জন্ম হয়। ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু জন্মলগ্নেই আমাদের দুই পা দুইখানে ফেলে রাখা হয়। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান, মাঝখানে বিস্তর ব্যবধান। ব্যাবধানটা মাটির হলেও খুব বেশিদিন সময় নেয়নি সেটা মানুষের মাঝে তৈরি হতে।
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল ভারতবর্ষে, আর মুসলমানরা সংখ্যালঘু। তাই নিজেদের নিরাপত্তা ও বিভিন্ন কারণে ধর্মের ভিত্তিতে দুটি দেশের জন্ম হলো ঠিকই কিন্তু বৃটিশদের শেখানো পথ আর কেউ ভুলল না। পাকিস্তান সৃষ্টির পরেই সেই ভাষাগত বিভেদ চরমে ওঠে। উর্দু ভাষাকে ধর্মের চাদরে মুড়িয়ে পাকিস্তানেও শুরু হলো মনোমালিন্য, এরপর বিভাজন! চাপিয়ে দেওয়ার বৃটিশ কৌশল বাঙালির ওপর প্রয়োগ করতে চেয়েও সফল হয়নি তৎকালীন শাষকরা। এই প্রেক্ষিতে ৫২এর আন্দোলন শুরু হয়। সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারদের প্রাণের বিনিয়োগে সেই কূটকৌশল ব্যর্থ হয়ে যায়। বাংলা ভাষার জন্য দেওয়া প্রাণ থেকেই একটা বাংলাদেশ জন্মলাভ করে পৃথিবীর বুকে। কিন্তু রয়ে যায় সেই পুরনো বিলাপ।
পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার জন্য প্রাণ দিতে পারার মতো জাতি এখনো বিরল। সব ক্ষমতাবানরাই নিজের ভাষাকে সবখানে সমুন্নত করে রেখেছেন। শাষকরা নিজের ভাষা চাপিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাংলার মানুষ যেই ভাষাকে প্রাণে লালন করেছিল, জীবন বিলিয়ে দিয়েছিল যেই ভাষার জন্য। সেই ভাষাটা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু আদর পায়নি, যত্ন পায়নি। আমি যখন কাউকে জিজ্ঞেস করি, আজ বাংলা কত তারিখ, সে এমনভাবে হাসে, মনে হয় এটা আবার কেউ মনে রাখে নাকি! আজকের সময়ে বাংলা ভাষাটার প্রতি অবহেলা বাড়ছেই শুধু। অনেকে তো বাংলার যাচ্ছেতাই ব্যবহারও করছে। প্রতি বছর বিজয় দিবস পালিত হয় ১৬ তারিখে, ডিসেম্বরে। সবাই তো মুখস্তই করে রেখেছে এবং শেখানোও হয়েছে এভাবেই যে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। কিন্তু কেউ তো যত্ন করে মনে রাখেনি ২৯ অঘ্রাণ, ১৩৭৮ রোজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার কথা।