মধুসূদন স্মরণে তিনটি সনেট ‘জলশঙ্খ’

চয়ন খায়রুল হাবিব

প্রকাশিত : জুন ২৯, ২০২৪

আজ ২৯ জুন মাইকেল মধুসূদন দত্তের মৃত্যুদিন। ২০২৪ সাল মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মের দুশো বছর পূর্তি। তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তিনিটি সনেট:

১.
জলশঙ্খ ঠিকঠাক কেটে ফুঁ দিলে,
ঢাকা বাজে কক্সবাজার সৈকতের আদলে।

কবিতায় এরকম কাটাকাটির সুদাসল অনাদায়ে,
এখনকার অনেক কবি শঙ্খমের নান্দনিকতা আধাআধি বুঝে,
জীবনানন্দে এরেস্টেড বিনয় মজুমদারকে ঢাল বানায়ে
ধরতে পারেনি, কেন জলশঙ্খে শুভ ও জল তিনবার বলে,
গায়ত্রী স্পিভাক বাধা কোন আজানের অপরূপ গায়ত্রী মন্ত্রবলে?

কেনো বত্তিচেল্লির নগ্ন ভিনাস দাঁড়ায়ে এক বিপুল শামুকের খোলে?
প্রাচীন দানব বালজিবাবের বোল যেমন নাম বদলে `লর্ড অফ দা ফ্লাই`,
এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে একদল কসাই কেন, ‘একেবারে শত শঙ্খ ধরি
ধ্বনিলা, টঙ্কারি রোষে শত ভীম ধনু, স্ত্রীবৃন্দ, কাঁপিল লঙ্কা আতঙ্কে?’

ফ্যানায় ফ্যানায় জলশঙ্খ অবশ্য পারে পার হতে সে আতঙ্ক।
যদি তা বাজাও পরিচ্ছন্ন মনে, বিজনে, ভাঙা লিরিক, ভাঙা বয়ানে।
নির্জনবিচ্ছিন্ন বিমূর্ততা নয়, সঙ্গি সেথা সূত্রমূল সমুদ্রের গর্জন!

২.
কাঁঠালের কোয়াতে পেলাম মাইকেল মধুসূদনের রস।
গতকাল ছিল বিশ্ব কাঁঠাল দিবস। জলশঙ্খের মাংস
ঝরাতে হয় সুরের কল্যাণে, গতকালের অক্ষর
বৃত্ত বাঁধে আগামীকালের বৃত্তভাঙা লিরিকের উঠানে,
ভাঙা বয়ানে: ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু,হায়,
তাই ভাবি মনে? জীবন-প্রবাহ বহি কালসিন্ধু পানে যায়,
ফিরাব কেমনে?’ ইদের ছুটি ফেরতা ডাক্তার শাওনির বরাতে
পেলাম যশোরের রসখাজা, বিকেলে সামাদ ভাবি দিলো
ঢাবি ক্যাম্পাস বাসার বাগানে গাছপাকা হাজারি-কাঁঠাল।
শাওনি, রিমা ভাবি একে অন্যকে চেনে না, কিন্তু বাধা
টাইম মেশিনের মন্থনে, কাঁঠালি চাঁপায় যেমন
কাঁঠালের মাতাল সুবাস, অথচ একে অন্যকে জানে না!
তাহলে কি মনোরঞ্জিনী হলুদিয়া শুধুমাত্র গ্রীষ্মকালীন ভ্রান্তিবিলাস?
অথচ রং, রস পেরিয়ে হেনরিয়েটার আকুলতা বারো মাস টানে!

৩.
আজকে জন্মালে পদ রচনা ভুলে কালো পদবির পিছু পিছু
কবিতা পরিষদের মন্ত্রণায় মধুসূদন আর মহাকবি হতো না।

ট্রয়-বিনাশী একিলিসের গোড়ালিতে বেঁধে প্যারিসের তীর,
বাংলা সনেট গ্রাস করে অক্ষরবৃত্তের সন্ত্রাস দ্রষ্টার আক্ষেপে
মাইকেল লেখেন, ‘বড়ই নিষ্ঠুর আমি ভাবি তারে মনে, লো ভাষা,
পীড়িতে তোমা গড়িল যে আগে মিত্রাক্ষররূপ বেড়ি!
কত ব্যথা লাগে পর’ যবে এ নিগড় কোমল চরণে—
স্মরিলে হৃদয় মোর জ্বলি উঠে রাগে
ছিল না কি ভাবধন, কহ, লো ললনে,’

চাঁদের আলোর নিচে কবর ঝাঁকড়ে জাগে কবর কুহকিনী
রক্তহীম আতঙ্কে আমরা বুঝি তালপুকুরের কবি এখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত।
মহাকাব্যকে ধাওয়া করছে, তা ঠিক চিৎকারও নয়, চিৎকারের কঙ্কাল।

ভিন গ্রহের রক্তচোষাদের থেকে পালানোর পথ না পেয়ে,
আততায়ীয় গা বেয়ে আমরা ঢুকে যাই আততায়ী শরীরে।