মজনু শাহ

মজনু শাহ

মজনু শাহ’র ৭ কবিতা

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০১, ২০২৩

উপক্রমণিকা


A Poem is never finished, only abandoned
—Paul Valery

 

আজ আমার সকল সৃষ্টিছাড়া পঙক্তির গায়ে বিকেলের ম্লান স্বর্ণচ্ছায়া এসে পড়ুক,
কিম্বা তার পাশে জ্বলে উঠুক শুকনো পাতার স্তূপ। ব্যাধ ফিরে এসে দেখবে, ছাই
উড়ছে শুধু।

কতটুকু সত্য কাছাকাছি আসে আনন্দের? তীর্থ-বিতাড়িতদের বলি, ভাঙা বেহালার
মধ্যে আমার সমস্ত পাপ ঠেসে ভরাতে চেয়েছি।

এখন ফিরে আসুক সেইসব পাখিরাও, মৌরিজঙ্গল ছেড়ে, একদিন যারা উড়েছিল
সাগরের পথে।

ভয়াবহ স্তব্ধ কোনো রাতে, জেনেছ, প্রতিটি চুম্বনের পর, এই কুহকী অস্তিত্বের ভার
কিছুটা কমে আসে। ঝুটিওয়ালা মোরগ আর বীণা, এই ছিল আমাদের অন্তিম
সম্পদ।

কেন তবে হারিয়ে যাও জেব্রাদের উন্মাদ-দৌড় শুরু হলে! একটু দাঁড়াও যদি,
দেখতে পাবে, মৃত পাতা মৃত ফুল ছড়ানো পথের কিনারে, ভোরবেলা দীর্ঘ কোনো
গাছের গা বেয়ে কীভাবে একটি নিঃসঙ্গ শিশির মিশে যায় মৃত্তিকায়, ধীরে।

দেখ আরও, আমাদের জলপাইগাছে মাঝে মাঝে কিছু অচেনা পাখি এসে বসে,
যাদের সহস্র বছর আগে বা পরের দার্শনিক বলে ভ্রম হয়।

 

আমার ভাষা

আমার ভাষা তৈরি হয় সেই নির্জনতায়, জেব্রা যেখানে তার শাবকদের নিয়ে খেলা
করে। বহু খুঁজে, পেয়েছি পেজমার্কার, একটি উজ্জ্বল বিয়োগচিহ্ন আর ডালিম
ফুলের ছায়া। বন্ধ দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে, লিখতে শুরু করি। একদিকে
অসানোগ্রাফির ক্লাশ, অন্যদিকে তোমার সঙ্গে সাঁতার কাটার ইচ্ছে। তাসের ঘরে
এলেই প্রশ্ন করো, আমি কি তুলোরাশির জাতক? ঘর অন্ধকার করে শুধাই, তুমি
কি কাননবালা? প্রশ্নেরা আজ হাসির কারাগার যেন। তোমার শরীর থেকে তখন
ঘাসের গন্ধ আসে। জানালা খুলে দেই অতঃপর শান্ত হাতে। পাখিবাজার থেকে
ফেরে লাঞ্ছিত লোকজন, নক্ষত্রের আলো আসে আমাদের তাসের ঘরে।

 

দাম্পত্য

যখন তুমি মেয়েমানুষ থেকে দূরে আছ, পড়তে পার চিহ্নবিজ্ঞান, চাঁদের নিচে
ডিগবাজি খেতে পার কিছুক্ষণ বা বানাতে পার চাবুক। আসলে তোমার জন্যে
কোথাও অপেক্ষা করে আছে কাঠবেড়ালি, তার বগলে এ বছরের রাশিফলের বই,
আর অন্য হাতে সেক্স-পিস্তল।

যখন তুমি পুরুষমানুষ থেকে দূরে আছ, খাও যত ইচ্ছে পপকর্ণ, নিজের ভয়ংকর
গোপন কথাগুলো নিজেকেই আরেকবার শোনাও ফিসফিস করে। একখানা জ্যান্ত
কবিতার বই সঙ্গে রেখ, তোমার দিকে এগিয়ে আসা বিচ্ছুগুলো পিটিয়ে মারার জন্য
ওটা লাগবে। খবরদার, ভুলেও বেড়াল কোলে নিও না, যা দিনকাল পড়েছে, স্তনে
আঁচড় দেবার ঘটনা গত পরশুও ঘটেছে ভূতের গলিতে। এ সময় ইউক্লিডের
উপপাদ্যগুলো মনে আছে কিনা, সেটা আঙুল দিয়ে লিখে দেখতে পার বালিতে।

 

ভুতুড়ে মাঠে

আবার এসেছি সেই ভুতুড়ে মাঠে। কিছুক্ষণ বসব।
আমের মুকুল ঝরেছে অনেক। গাধার পিঠে যিনি এখন মাঠ
পেরোলেন, উনি যিশুর সাঙ্গাত নন। তার পিছে খুব নিস্পৃহ ভঙ্গিতে
হেঁটে গেল এক অচেনা বৌদ্ধ শ্রমণ। আমি তার ভিক্ষাপাত্র
হতে পারতাম। বা তাকে অনুসরণ করা কোনো পাখি।
কারো গানহারা এক পাখি হতে পারতাম যদি সন্ধেবেলা!
দশ পাল্লা ঘুম জেগে উঠছে আমার ভিতরে।

 

ব্রহ্ম

 

ব্রহ্ম বায়ুর উদ্দেশে একটি তৃণ রেখে বললেন, একে গ্রহণ করো।
যথা, বায়ুর সাধ্য কী একে উড়িয়ে নেয়, এ যে যক্ষ! সংসারে,
কবি, এইরূপ একটি তৃণ। সে শুধু জনে জনে শুধায়, ওহে, দেখো,
বীণাবাদক ক্রমে কী রকম বীণা হয়ে উঠছে। আর গোলাপ,
হেলে পড়ছে নগ্নতার দিকে। বাক্যই তার মৈত্রেয়ী ও চক্ষু।
শব্দের আত্মাকে উপাসনা করে এক ফোঁটা অমৃত যদি মেলে!
তাকে হতে হয় দ্বিতীয় সেই পাখি, যে প্রথম পাখির
ফল খাওয়া দেখছে। তার সর্বাঙ্গে অন্ধ রাজার ভঙ্গি।

 

অপর

সমস্ত পাতা হারিয়ে ফেলা কাঠগোলাপ গাছ, কেমন আছ তুমি?
ও আমার অকেজো গ্যাসবেলুন, কেমন আছ? এমন ধুলো-ওড়া স্বপ্ন
এমন কোনো নির্ঝর যেখানে একা বসেছিল ভাষামাধবী, ততদূর এলাম।
আমার বাড়ি নাই আর, আছে শুধু শব্দের হৃদয়! এক অনিশ্চিতের জগত
অসীম ভ্রমে হেঁটে দেখা। কোনো দারুস্পর্শ মৃত্যু আমাকে সৃষ্টি করে চলে,
ভাঙা জানালায় আছড়ে পড়া চাঁদ আজ আমার অপর।

 

পথ

 

বোঝা যায় কি যায় না এমন একটা পথ ঢেকে আছে বাঁশপাতায়।
এত মৃত বাঁশপাতা! ওদিকের জঙ্গলে, বনমোরগের আস্তানা। গুম খুন
হয়ে যাওয়া যুবকের দেহ এখানে খুঁজে চলেছে তার ছোট ভাই।
কোথাও বিপুল হ্রেষা শোনা গেল। আরেকটু অনুসরণ করি তাকে।
বাঁশপাতা ঢাকা পথ সহসা ফুরায়। এখানে আরও গভীর প্রচ্ছায়া।