`মঙ্গলকর` উপাদান মৌরি
পাবলো শাহিপ্রকাশিত : জানুয়ারি ৩০, ২০১৯
মসলার জগতে মৌরি একটি প্রসিদ্ধ নাম। এটা আমাদের দেশের একটি বহুল পরিচিত সুগন্ধযুক্ত মসলা, দৈনন্দিন রান্নার অনেকখানি জুড়ে আছে। পাঁচ ফোঁড়নের এক ফোঁড়ন মৌরি। বহুগুণে গুণান্বিত এই মসলা। এতে প্রচুর পরিমানে ঔষধি গুণ বিদ্যমান রয়েছে। মৌরি গাছকে প্রকৃতির ঔষধি গাছও বলা হয়ে থাকে। ক্ষেত ভরে যখন মৌরি ফুল ফোটে তখন সে দৃশ্য দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠে। তার ঘ্রাণ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে চারদিক। সেই জন্যই বোধ করি পল্লীকবি জসীম উদদীন `আমার বাড়ি` কবিতায় তার বাড়ি চেনাতে মৌরি ফুলের ঘ্রাণের কথা লিখেছিলেন, কবিতার শেষ অংশে—
আমার বাড়ি যাইও ভোমর
এই বরাবর পথ,
মৌরী ফুলের গন্ধ শুঁকে
থামিও তব রথ।
মৌরির ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে ঔষধ এবং খাবারে এর প্রচুর ব্যবহার ছিল। রোমান যোদ্ধাদের ধারণা ছিল, মৌরি তাদের শরীরের ওজন কমাতো, যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা শারীরিক ভাবে হালকা অনুভব করত। সেই সময়ে গ্রীস এবং রোমে মৌরি এতটাই মূল্যবান ছিল যে, অনেক সময় এটাকে কর হিসাবে প্রদান করা হতো। মিশর এবং চীনে একে ওষুধি গাছ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রাচীন কালে কিছু দেশে মৌরির কন্দকে পবিত্র বলে মনে করা হতো। এটাকে খারাপ শক্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাড়ির দরজা এবং গাড়ির সামনে ঝুলিয়ে রাখত বলে শোনা যায়।
মৌরির আদি নিবাস ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং ইউরোপের কিছু অঞ্চলজুড়ে। বিশেষ করে সাগর উপকূলে এবং নদীর পাড়ের কাছাকাছি শুষ্ক মৃত্তিকাতে মৌরি প্রচুর পরিমাণে জন্মাতো। এই কারণে প্রাচীন কালে নীল নদের পাড়েও প্রচুর পরিমাণে জন্মাতো। বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলে ব্যপকভাবে জন্মায়, বিশেষ করে ভারতবর্ষের পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মেঘালয় এবং আসাম রাজ্যগুলিতে সব চেয়ে বেশি মৌরি উৎপাদিত হয়। বাংলা নামের মৌরির আরো অনেক নাম রয়েছে অঞ্চলভেদে। আমাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায়ও ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হয় যেমন গুয়ামুরি, মহুরি ইত্যাদি। এর ইংরেজি নাম Fennel. Scientific Name: Foeniculum Vulgare, Family Name: Umbellifer.এরা গাজর পরিবারের সদস্য।
এই গাছের পাতা, বীজ, কন্দ, শিকড় কোনো কিছুই ফেলনা নয়। বর্তমানে মৌরির কন্দ ইউরোপে সর্বাধিক জনপ্রিয়। বীজ সাধারণত সারা বিশ্বজুড়ে মশলা হিসেবে পাওয়া যায়। মৌরি ও তার কন্দ আকর্ষণীয় সুঘ্রাণ এবং স্বাদের জন্য আধুনিক সময়ের রান্নাঘরে তার জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আমাদের দেশে এর ফল বা বীজ মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের মাছ-মাংসের তরকারি, আচার, পিঠা, নানা ধরনের মিষ্টি খাবারে মৌরি ব্যবহৃত হয়, পান মসলা হিসেবে ও খুব জনপ্রিয়। আমাদের দেশে শুধুমাত্র মৌরির ব্যবহার থাকলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই গাছের কন্দ বা বালব এক প্রকার সবজি হিসেবে পরিচিত। কড়া মিষ্টি ঘ্রাণের কন্দ বা বালব স্যুপ, ফ্রাইড, গ্রিল ও নানা ধরনের কারিতে রান্না করে এবং সালাদে খাবার প্রচলন রয়েছে, মৌরি পাতা সালাদ ও কারিতে এবং মৌরি বীজ নানা ধরনের মিষ্টি খাবারে ব্যবহারিত হয়। এর শেকড় কবিরাজি এবং আয়ুর্বেদিক ঔষধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
মৌরি গাছ এবং ফুল দেখতে বেশ আকর্ষণীয়। এই গাছ দুই থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে, ফুল দেখতে অনেকটা খোলা ছাতার মতো। সাধারণত ফুলের রঙ হলুদ আর শাদা হয়ে থাকে। পাতাগুলো চিরল, মসৃণ এবং পাখির পালকের মতো দেখতে। মৌরির সুস্বাদু কন্দ এবং চিরল পাতা বাগানের শোভাও বৃদ্ধি করে ভেষজ হিসেবে। এর সুমিষ্ট এবং সুগন্ধিযুক্ত ঘ্রানের জন্য পুরো বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে রান্নার মসলা হিসেবে। বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই মৌরির চাষ করা হয়ে থাকে। এর চাষের জন্য বেলে, বেলে দো-আঁশ মাটি ভালো। জমি একটু উঁচু সুনিষ্কাশিত হলে ভালো চাষের উপযোগী হয়।
খনিজ লবণ সমৃদ্ধ বীজ মৌরি, ঔষধি এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর। এতে সোডিয়াম, আয়রণ, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম, কপার, জিঙ্ক, তামা, ভিটামিন এ, সি, ই এবং ভিটামিন বি প্রচুর পরিমানে আছে। এতে আরো আছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ফ্ল্যাভনয়েড। মৌরি আঁশ সমৃদ্ধ, এটা বিভিন্ন রোগে পথ্য হিসাবে ব্যবহার হয়ে থাকে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- হজমে সাহায্য, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, প্রস্রাবের সমস্যা, হাপানি, কোষ্ঠকাঠিন্য, চোখের অসুখ ইত্যাদি। পেটফাঁপার মহৌষধ মৌরি। এছাড়াও এতে শরীর ঠাণ্ডা করা, চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি, ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি, ইত্যাদির বিশেষ উপাদান রয়েছে। মৌরি বীজের তেল তৈরি করে, পানিতে ভিজিয়ে রেখে এবং এর শিকড়, কন্দ, পাতা ও বীজ অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিশিয়ে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয় নানা ধরনের অসুখের পথ্য হিসাবে। এর ঔষধি গুণের তুলনা নাই। সেই কারণেই বোধ করি আয়ুর্বেদীয় শাস্ত্রে মৌরিকে ‘মঙ্গলকর’ উপাদান হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
লেখক: কবি