ভয়াবহ সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ
স্বকৃত নোমানপ্রকাশিত : আগস্ট ২৪, ২০১৯
বাংলাদেশ এক ভয়াবহ সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। এই সংকটের নাম রোহিঙ্গা সংকট। এই সংকট সৃষ্টির পেছনে শুধু সরকার ও দেশের অসংখ্য জনগণ নয়, অসংখ্য লেখক-বুদ্ধিজীবীও দায়ী। রোহিঙ্গারা যখন উজানি স্রোতের মতো আসছিল, সরকার তো তখন সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। জনগণের একেকজন তো তখন মানবতার তালুক ইজারা নিয়ে বসে গিয়েছিল। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার পেছনে সরকারের কী পলিসি ছিল জানি না, তবে জনগণের পলিসিটা কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন সকলের জানা। এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ রোহিঙ্গাদেরকে ‘মানুষ’ হিসেবে নয়, ‘মুসলমান’ হিসেবে আশ্রয় দেয়ার জন্য সরব হয়ে উঠেছিল। রোহিঙ্গারা যে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা, সেকথা ভুলে গিয়েছিল। আজ ভারত সরকার যদি ভারতের সেভেন সিস্টারের হিন্দু, অসমীয়, ত্রিপুরী ও মণিপুরীসহ অপরাপর ধর্মসম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন শুরু করে, নিপীড়ন থেকে বাঁচতে তারা যদি বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে চায়, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এর বিরোধিতা করবে। সরকার যদি আশ্রয় দিতে চায়, তবে সরকারকে ভারতের দালাল আখ্যা দিয়ে ক্ষমতা থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে ছাড়বে।
আর দেশের লেখক-বুদ্ধিজীবী সমাজ? রোহিঙ্গা স্রোতের সময় লেখক-বুদ্ধিজীবদের অনেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের আশ্রয়দানের পক্ষে সরব হয়ে উঠেছিলেন। কেউ কেউ স্বতন্ত্র জাতিসত্তার অধিকারী রোহিঙ্গাদেরকে ‘বাঙালি’ সাব্যস্ত করতে উঠেপড়ে লেগে গিয়েছিলেন। বাপ রে! মানবতা আর কাহাকে বলে! নিজের দেশে সংখ্যাগুরুদের হাতে সংখ্যালঘুরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো চলছে বৈষম্য, জঙ্গিবাদী অপতৎপরতা আর ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকের আগ্রাসনে যুবসমাজের বিশাল অংশ ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস-বন্যা আর নদীভাঙনে বিস্তর মানুষ বাস্তুভিটহারা হচ্ছে, এসব নিয়ে তাদের কোনো উচ্চবাচ্য নেই, যত উচ্চবাচ্য ছিল রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের ব্যাপারে। এখন বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গারা যাবে না। কেন যাবে? কর্মহীন বসে বসে খাওয়ার চেয়ে সুখ জগতে আর কী আছে? সরকার নয়, জনগণ নয়, বাস্তবতা জ্ঞানহীন এইসব বুদ্ধিজীবীর আগে ক্ষমা চাওয়া উচিত। সরকার ও জনগণের ভুলে একটা দেশের যতটা না ক্ষতি হয়, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বুদ্ধিজীবীর ভুলে।
২০১৭ সালের ২৫ আগাস্টের পর থেকে সোয়া সাত লাখ রোহিঙ্গার আগমনে উখিয়া-টেকনাফে স্থানীয় বাঙালি জনগোষ্ঠীর তুলনায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন দ্বিগুণ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্রোতের মতো আসা রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয়দের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে। কৃষিকাজ ও মাছ ধরা একপ্রকার বন্ধ। রোহিঙ্গাদের অনেকের অপরাধ প্রবণতায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে স্থানীয়রা। কক্সবাজারের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ বলেছে, তারা রোহিঙ্গাদের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। এই ক্ষতি ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। গত দুই বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রায় এক লাখ দশ হাজার শিশু জন্মেছে। আগামী এক বছরে জন্ম নেবে আরো প্রায় ৬০ হাজার। রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমারে ফেরত যাবে না, এটা তো এখন পরিষ্কার। মিয়ানমারও সব রোহিঙ্গাকে নেবে না। নিলেও এই এক লাখ দশ হাজার শিশুকে নেবে না। কেন নেবে? কারণ তাদের জন্ম তো মিয়ানমারে নয়, বাংলাদেশে।
যতই দিন যাবে এই গণপ্রজননের ফলে রোহিঙ্গার সংখ্যা ততই বাড়বে। জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সাহায্য সংস্থাগুলোর কোনো উদ্যোগ নেই। উদ্যোগ নিলে তাদের ক্ষতি। কারণ যত রোহিঙ্গা তত টাকা। সাহায্য এখানে একটা বিরাট ব্যবসা। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলো এখন এনজিওদের দখলে। এনজিওরা গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে সেখানে। এ এমন এক গুপ্তধন, যার কোনো সমাপ্তি নেই। এসব এনজিওর কাছে ‘মানবতা’ একটি ব্যবসার নাম। রোহিঙ্গারা যতদিন এখানে থাকবে, ততদিন তাদের ব্যবসা চাঙা, রোহিঙ্গারা চলে গেলে তাদের ব্যবসায় ধস। জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকারেও কোনো উদ্যোগ নেই। উদ্যোগ নিলেও রোহিঙ্গারা তা মানবে কেন? তাদের ধর্মমতে তো জন্মনিয়ন্ত্রণ হারাম। ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সালাফিরা তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে। ক্যাম্পে বিস্তর মসজিদ-মাদ্রাসা খুলে বসেছে। জন্মনিয়ন্ত্রণবিরোধী তাদের অব্যাহত প্রচারণার ফলে রোহিঙ্গাদের কেউ জন্মনিয়ন্ত্রণ গ্রহণে আগ্রাহী হচ্ছে না। ওই রাবারের কনডম ব্যবহার করে, ওই পিল খেয়ে কেন তারা ধর্ম নষ্ট করবে? কেন তারা নরকের আগুনে জ্বলবে?
তাহলে কক্সবাজারের ভবিষ্যৎ? খুব খারাপ। রোহিঙ্গা জনসংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়বে। ধীরে ধীরে বাকি পাহাড়গুলো ধ্বংস হবে, গাছ বিরিক্ষি ফুল পাখি লতা গুল্ম উজাড় হবে, স্থানীয় অধিবাসীরা হয়ে পড়বে আরো কোণঠাসা, তারা বাধ্য হবে বাসস্থান ত্যাগ করে অন্যত্র সরে যেতে। কক্সবাজারে প্রতিষ্ঠিত হবে রোহিঙ্গা আধিপত্য। রাষ্ট্রের ভেতরে আরেক রাষ্ট্র। এনজিওরা আরো বিস্তার করবে তাদের জাল। বাংলাদেশ সরকার কি সামাল দিতে পারবে? মনে হয় না। এখন পারছে না, ভবিষ্যতে কী করে পারবে?
টুকে রাখা কথামালা
২৩.০৮.২০১৯