অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম
ভুল সংসার
জাতবেদা মিশ্রপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৯, ২০১৭
মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা আর একবুক তেষ্টা নিয়ে চোখ খুলল রুবি। কখন যে জ্ঞান চলে গেছিল, বোঝেনি । সেই সন্ধে থেকে চলছে মারধোর। বদরুদের ঘরের পাশের গাছটায় সে বাঁধা। টের পেল, শরীর বশে নেই । ঝুঁকে আসছে মাথাটা বুকের কাছে। ঠোঁটের পাশ কপাল চটচটে। জিভ দিয়ে চেটে দেখলো নোনতা। অজ্ঞান দেখে বোধয় হাতের বাঁধনটা খোলা। তবে গাছের সঙ্গে কোমর পেঁচিয়ে দড়িটা এখনো বাঁধা থাকলেও বাঁধন একটু আলগা। খুব কষ্টে চোখটা খুলে আশেপাশে কাউকে দেখতে পেল না সে। নিজের অজান্তেই মাথার চুলে হাত গেল। টের পেল, চুলগুলো খাবলা খাবলা। বুকটা হু হু করে উঠল। তার অমন মেঘবরণ চুলের কী হাল! ওর সৌন্দর্যের ওপর ওদের এত রাগ কেন? সে যদি দোষী হয় তবে বদরুও দোষী। যদিও ওকেও বেঁধেছিল কিন্তু দুটো চড়-থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দিল। আর যত রাগ এই তার ওপর। কান্নায় গলা বুজে আসে রুবির। শরীরের থেকেও মনের কষ্ট বেড়ে ওঠে। মারের ব্যথা আর বুঝতে পারে না। ঘরে ছেলেটার জন্য মনটা কেঁদে ওঠে। আর পেটেরটার জন্যেও। যেভাবে হোক এখান থেকে পালাতে হবে, নাহলে পেটেরটাকে ওরা মেরে ফেলবে। কোনোমতে দুহাতে ভর দিয়ে উঠে বসে রুবি। চারদিকে আবার ভালো করে দ্যাখে। ঘুটঘুটে অন্ধকার! তবে একটু দূর থেকে অনেকের কথার আওয়াজ ভেসে আসে। তারমানে আশপাশে আছে সব। ওকে অজ্ঞান দেখে দম নিতে গেছে। আবার এসে মারবে। রুবি বোঝে, এইভাবে পড়ে থাকলে ও মরবে। ছেলেটার কাছে আর কোনোদিন পৌঁছতে পারবে না। কোমরের দড়িটা একটু টানাটানি করতেই খুলে যায় আর ঝপ্ করে মাটিতে গড়িয়ে পরে রুবি। ওভাবেই শুয়ে শুয়ে বুক ঘষে এগোতে থাকে। একটু এগিয়ে এবার হামা টানতে শুরু করে। কিন্তু এভাবে যাবে কতদূর? ওরা টের পেলেই একটু পরেই ধরে ফেলবে তাকে। তার বাবার বাড়ি পৌঁছতে হলে আগে বাস রাস্তায় পৌঁছতে হবে। এরপর বাস ধরে ছেলের কাছে। একে অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার, তারমধ্যে ভালো শীত পড়েছে এবার। এই শরীরে হাঁটবে কী করে? কিন্তু ছেলে নূর আর পেটেরটার কথা চিন্তা করে গায়ে যেন বল ফিরে পায়। দাঁড়িয়ে উঠে দৌড়নোর চেষ্টা করে আর ব্যথায় শরীর কুঁকড়ে আসে। দৌড়নোর চিন্তা ছেড়ে মাঠের ধারের বাড়িগুলোর গা ঘেঁষে জোরে হাঁটার চেষ্টা করে। কিন্তু চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কপাল থেকে চটচটে রক্ত চোখে ওপর পড়ে চোখ ঝাপসা করে দিচ্ছে। ছেঁড়া শাড়িটা দিয়ে চোখ দুটো মোছার চেষ্টা করে বারবার। এবার হালকা চালে দৌড়তে থাকে। দৌড়ে বেশ খানিকটা চলে আসার পরেই হঠাৎ দূর থেকে একটা চেঁচামেচি কানে আসে। ও বুঝতে পারে, ওর পালিয়ে যাওয়া ধরা পরে গেছে। ভয়ে আতংকে রুবি দিশেহারা হয়ে পড়ে। অন্ধকারে বোঝার চেষ্টা করে, কোথায় আছে। হঠাৎ সামনেই দিদিমনির ঘর দেখতে পায়। এনাকে এখানে সবাই খুব মানে আর সবাই দিদিমনি বলেই ডাকে। একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে একাই থাকে এই বস্তিতে। আর আশেপাশের সব বাচ্চাদের পড়ায়। রুবিকে চেনে। ছেলে নূরকে নিয়ে এখানে এলে, আসা-যাওয়ার পথে অনেকবার দিদিমনি ডেকে কথা বলেছে ওর সাথে।
কিছু না ভেবেই দিদিমনির দরজায় টোকা দেয় রুবি। ওকে চমকে দিয়ে দরজা খুলে যায় আর রুবি দ্যাখে, বটি হাতে দিদিমনি দাঁড়িয়ে। আতংকে পিছিয়ে যেতেই দিদিমনি ওকে জাপটে ঘরে ঢুকিয়ে আনে। দেখে বিছানায় দিদিমনির মেয়েটা গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। দিদিমনি দরজা বন্ধ করেই ইশারায় মুখে আঙুল দিয়ে ওকে চুপ থাকার ইশারা করে আর হাত ধরে বিছানার একধারে বসায়। তারপর ছেঁড়া ন্যাকড়া দিয়ে কপালের রক্ত মোছাতে থাকে। এরমধ্যেই বাইরে অনেক লোকের দৌড়াদৌড়ির আওয়াজ কানে আশে আর অনেকের কথা। ও দিদিমনিকে জাপটে ধরে বলে, আমাকে বাঁচাও। ওরা মেরে ফেলবে আমায়।
দিদিমনি এবার ফিসফিস করে বলে, চুপচাপ থাকো। কোনো চিন্তা নেই।
এরই মধ্যে ওরা শোনে দরজায় কারা দুম দুম ধাক্কা দিচ্ছে আর দিদিমনি বলে ডাকছে। ওর হাত ধরে টেনে দরজার পাশের দেয়ালের কোণে ওকে দাঁড় করিয়ে দেয় দিদিমনি আর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বলে দরজা খুলে ঘর আড়াল করে দাঁড়ায়। বলে, আস্তে কথা বলো তোমরা, বাচ্চা ঘুমোচ্ছে।
সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করে, আপনার ঘরে কেউ ঢুকেছে?
দিদিমনির জবাব, তোমরা জানো আমি বাচ্চা নিয়ে থাকি আর মাঝরাতে এইসব বলতে এসেছো? হয়েছেটা কী? কাকে খুঁজছো?
দিদিমনির এ কথায় সবাই একটু থমকে যায়। লাঠি হাতে লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকে। তারপর একজন বলে, একটা মেয়ে চুরি করে পাইলেচে। আপনি চেনবেন না। আপনার ঘর রাস্তার ধারে বলে জিজ্ঞেস কল্লুম। আপনি কাউকে যেতে দেখেছেন? বা আওয়াজ পেইচেন কোনো?
দিদিমনি বলল, আওয়াজ তো সন্ধে থেকেই পাচ্ছিলাম। তা হয়েছে কী? আর এই শীতের রাতে কে কোথায় যাচ্ছে তা দেখার জন্য আমি জেগে বসে থাকবো? তোমাদের কী বুদ্ধি এসব?
লোকগুলো বলে, সে অনেক কথা, পরে শুনবেন। ঠিকাচে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ুন। আমরা চলে যাচ্ছি।
দিদিমনি তবু দাঁড়িয়ে থাকে লোকগুলো চলে যাওয়া অব্দি দরজা ধরে। তারপর আস্তে করে দরজা বন্ধ করেই রুবিকে টেনে বিছানায় শুইয়ে দেয় আর ফিসফিস করে বলে, শুয়ে নাও একটু, খুব ধকল গেছে। ভোর রাতে আমি ডেকে দেব। তখন চলে যেও। ততক্ষণে ঠাণ্ডা হবে আশপাশ খানিকটা।
দিদিমনির মেয়ের পাশে শুয়ে পড়ে রুবি। ছেলে নূরের জন্যে হঠাৎ কেঁদে ওঠে সে। কে জানে আর দেখা হবে কীনা। আর দুমাস পরে পাঁচে পড়বে। আজকাল রুবির মায়ের কাছে ভালই থাকে ছেলেটা।
ভাল নাম রুবিনা, তবে সে নামে কেউ ডাকেই না আর। নূরের জন্মের সাত মাসের মাথায় বরটা মরে গেল হঠাৎ সাপের কামড়ে। শ্বশুরবাড়িতে আর ঠাঁই হয়নি রুবির। সেই সাত মাসের ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়ি ফিরে এলো। তারা দুই বোন আর মা-বাবা, ভাই নেই। বাবা দরজির কাজ করেন। বেশ চলে যাচ্ছিল রুবির। বর মরে যাওয়ার পর ছেলেকে নিয়েই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতো। কারো দিকে কোনো দিকে তাকায়নি। হঠাৎ দুবছর আগে ছোটো বোনের বিয়ে ঠিক হলো বদরুর সাথে। ছোটোবোন বেবি একটু বুদ্ধিকম আর হাবলা গোছের। কিছুই নিজে থেকে তেমন পারে না। তাই দেনমোহর না নিয়েই বিয়ে দিয়েছিল বাবা বদরুর সাথে। বদরুও দরজির কাজ করে। বিয়ের পর বাবা-মা প্রায়ই রুবিকে বোন বেবির সংসার গোছানোর জন্য পাঠাত। রুবিও মাঝে মাঝে ছেলেকে মায়ের কাছে রেখে চলে আসতো। ঘরদোর গোছানো, সবার জন্য রান্না,
বোনকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে দেয়া এসব করতে করতে কবে যে বোনের সংসারটাকে নিজের বলে ভাবতে শুরু করে দিয়েছিল, আজ আর মনে পড়ে না। তার সঙ্গে বদরুকেও ভালবেসেছিল। কতই বা বয়েস রুবির, সবে বাইশে পড়েছে। আর ছেলের বয়েস পাঁচ। আগের সংসার তো ভাল করে গোছানোর আগেই শেষ হয়ে গেল।
এ পাড়ায় বেশ কিছু লোক এবং ছেলেপুলেও যে খুব ছোঁকছোঁক করে রুবির আশপাশে, সেটা রুবি বোঝে। কিন্তু সে বদরুতে মগ্ন আর বদরুও রুবিতে মগ্ন থাকায় ওদিকে তাকানোর আর ফুরসত হয়নি। বেবি অত কিছু বোঝে না। আসলে বেবি নিজের খাওয়া আর ঘুম ছাড়া আর কিছুতেই তেমন মাথা ঘামায় না। বা ঘামানোর মতো মাথাই নেই তার। সব ঠিকই চলছিল। সবাই সব কিছু বুঝতো জানতো কিন্তু যেই রুবির পেটেরটার কথা জানাজানি হলো, অমনি সবাই বদলে গেল। বদরু অব্দি দায় নিন না। শরীরের যন্ত্রণার থেকে রুবির মনের যন্ত্রণা এখন বেশি। আর ছেলের কাছে পৌঁছনোর মরিয়া আকাঙ্ক্ষা। যেসব লোকগুলো ছোঁকছোঁক করতো কিন্তু পাত্তা পায়নি, আজ তারাই একজোট হয়ে বিধান দিচ্ছিলো। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে রুবি, নিজেও জানে না।
হঠাৎ দিদিমনির ডাকে ঘুম ভাঙে। দেখে দিদিমনি ঠেলছে আর বলছে, ওঠো প্রায় ভোর হবে হবে, চারদিক শান্ত। তোমাকে না পেয়ে সবাই ফিরে গেছে। এবার বেরিয়ে পর। অন্ধকার থাকতে থাকতে বেরোও। হুড়মুড় করে উঠে বসে রুবি। দিদিমনি তার নিজের একটা পুরনো ছেঁড়া চাদর দিয়ে বলল, আমার তো আর কিছু নেই। এটাই গায়ে জড়িয়ে নাও। এরপর হাতে পাঁচটা টাকা দিয়ে বলল, আর নেই, থাকলে দিতাম। বাস ভাড়াটা দিলাম। যাও বেরিয়ে পর। রুবি দিদিমনিকে একবার জড়িয়ে ধরে এরপর দৌড়ে বেরিয়ে যায় অন্ধকার আর কুয়াশামাখা রাস্তার দিকে। শেষবারের মতো পিছনে তাকিয়ে দ্যাখে, দিদিমনি একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দৌড়তে শুরু করে রুবি। যে করেই হোক, ছেলেটার কাছে পৌঁছতে হবে।