ভাষার মৃত্যু এবং আমাদের ভবিষ্যৎ
মোরশেদ হাসানপ্রকাশিত : নভেম্বর ১৩, ২০১৮
ইংরেজি ভাষা অত্যাচারী ভাষা। ঔপনিবেশিক ভাষা। শাসককুলের ভাষা। ইতিহাসে `মাৎস্যান্যায়` বলে একটি শব্দ আছে। এই শব্দটি পাওয়া গেছে পালবংশের তাম্রশাসনে। তাম্রশাসন মানে তামার পাত বা তামার ফলকে উৎকীর্ণ রাজার আজ্ঞা। কী বুঝলেন? রাজার আদেশ তামার পাতে লিখে রাখাটাই হচ্ছে তাম্রশাসন। তামার পাতে লেখা হচ্ছে তান্রলিপি। কাগজে লিখো নাম কাগজ ক্ষয়ে যাবে, তামার পাতে লিখো রাজার আদেশ সে নিদর্শন রয়ে যাবে। এভাবেই অতীত খুঁড়ে ঐতিহাসিক তামার পাত বের করে তাম্রলিপির পাঠ উদ্ধার করা হয়েছে। পালরাজা গোপাল, ধর্মপাল ও মহীপালদের সময় তাম্রলিপিতে পাওয়া গেছে `মাৎস্যন্যায়`।
প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে গুপ্ত আমল পর্যন্ত একটি সময়কাল। গুপ্তরাজাদের মধ্যে চন্দ্রগুপ্ত ও সমুদ্রগুপ্তের নাম সবার মনে থাকে। গুপ্ত আমলের পরেই গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক আসেন মোটামুটি ৬৫০ সালের দিকে। শশাঙ্ক ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। শশাঙ্কের পর ৬০০ থেকে ৭০০ সাল পর্যন্ত একটি সময় যার পরে পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল নতুন রাজত্ব নিয়ে আসেন। শশাঙ্কের পর একশো বছর সময়টি ছিল অরাজকতার সময়। শক্তিমান দুর্বলের ওপর অত্যাচার চালায়, বহিঃশত্রুরা আক্রমণ করে। এ গোলযোগপূর্ণ সময়টিকে বলা হয় মাৎস্যন্যায়। মাৎস্যন্যায় মানে মাছের ন্যায় বা মতো। মাছের মতো আচরণ যেখানে বড়ো মাছ ছোটো মাছকে খেয়ে ফেলে। সমাজেও চলছিল জোর যার মুল্লুক তার। এ অবস্থাকে পরবর্তীতে পাল রাজারা তাদের তাম্রলিপিতে লিখেছেন `মাৎস্যন্যায়` হিসেবে।
একইরূপে আমাদের আধুনিক সময়ে ভাষার ক্ষেত্রে চলছে `মাৎস্যন্যায়`। শক্তিশালী ভাষাগুলো যেমন, ইংরেজি, ফ্রেন্স, স্পেনিশ, জর্মন ভাষা অন্য ভাষাগুলোকে বেঁচে থাকার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। সবাই ইংরেজি ভাষা শেখার জন্য পাগল নিজের ভাষা ভুলে। একসময় পৃথিবীতে ভাষা ছিল চৌদ্দ হাজার। সেখান থেকে আট হাজার ভাষা লুপ্ত হয়ে গেছে, সোজা কথায় মারা গেছে। যেমন লুপ্ত হয়ে ডোডো প্রাণী। শুধু আগামী একশো বছরে লুপ্ত হয়ে যাবে আরও তিন হাজার ভাষা। চিন্তা করা যায় একটা ভাষা, দুইটা ভাষা, তিনটা ভাষা নয়— তিন হাজার ভাষা মরে যাবে। এ যে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ার বিষয়। আগে মরবে যেসব ভাষার লিপি নেই, মানে লেখার বর্ণমালা নেই। অনেক আদিবাসীদের ভাষাই কিন্তু মৌখিক। নিজস্ব লেখার লিপি নেই। একসময় এক একটি ভাষার শেষ কথক ব্যক্তিটি যখন মারা যায় তখন সেই ব্যক্তির সাথে সাথে সেই ভাষাটিরও মৃত্যু ঘটে।
সবাই মিলে ইংরেজিতে কথা বললে ইংরেজি ভাষাতেও একদিন সবার ভাত-চাকরি মিলবে না। আর নিজের মায়ের ভাষা তো শেষ আগেই। এজন্যই প্রতিটি ভাষা রক্ষা করতে হয়। জীববৈচিত্র্য রক্ষার মতোই বিভিন্ন ভাষার বৈচিত্র্যও রক্ষা করতে হয়। অন্য ভাষা মরলে আমার কী— এ কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের বক্তব্য হতে পারে না। নিজ ভাষা রক্ষার স্বার্থে আগ্রাসী ভাষার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়।