ভাষা
সাইদুল হকপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৮
মানুষে-মানুষে যোগাযোগের প্রধানতম বাহন হচ্ছে ভাষা। অর্থাৎ যার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভাবের আদান-প্রদান করি। এটা হলো ভাষার সহজতম সংজ্ঞা। ভাষার সংজ্ঞা যাই হোক না কেন, মানুষের প্রয়োজনে মানুষ ভাষা শেখে। ভাষা এমনই একটি শিক্ষা, যা কোনও মানুষকে জোর করে শেখানো যায় না। জন্মের পর থেকে একটি শিশু তার পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করে। চারপাশের মানুষদের যা করতে দ্যাখে, যে ভাষায় কথা বলতে শোনে, শিশুটি তা শেখে। নিজের প্রয়োজন মেটাতে প্রথমে সে ছোট ছোট শব্দ শেখে। এভাবেই সে ভাষা শেখা শুরু করে। এ শেখা মৃত্যুর আগপর্যন্ত চলতে থাকে। কারণ জগতের সব ভাষাই এত বিশাল যে, একজীবনে কোনও ভাষার খুঁটিনাটি সব শেখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এছাড়া একজনকে তার মাতৃভাষার পাশাপাশি একাধিক ভাষা শিখতে হয়।
বার্নার্ড রাসেল বলেছেন, “শেষপর্যন্ত দুটো জিনিস শিখলেই হয়। একটা হচ্ছে ভাষা, আরেকটা গণিত। বাকি যা, তা মানুষ নিজের থেকেই শিখে নেয়।” আমরা জানি, গণিতও এক প্রকার ভাষা। বিজ্ঞানের ভাষা। সুতরাং শিক্ষাজীবনে আমরা শুধু ভাষাই শিখি। মানুষের জীবনে প্রথম শিক্ষা হলো ভাষা, যা মাতৃভাষা নামে পরিচিত। এরপর মানুষ নিজের প্রয়োজনে অনেক কিছু শেখে। যা-ই শেখে, সবকিছুই ওই মাতৃভাষা দিয়ে। সৃষ্টিকর্তা মানুষের মাঝে শ্রেণিকরণের জন্য বিভিন্ন নিয়ামক দিয়েছেন। যেমন, ভৌগোলিক অবস্থান, ভাষা, জাত, বর্ণ, উচ্চতা ইত্যাদি। এসবের মধ্যে ভাষা অন্যতম একটা নিয়ামক। একটি জাতির সংস্কৃতি অনেকাংশই নির্ভর করে এই ভাষার ওপর। গোটা বিশ্বের দুশো পনেরো মিলিয়ন বাংলা ভাষাভাষীর মধ্যে দেড়শো মিলিয়নই বাংলাদেশি। এটা মূলত দক্ষিণ এশীয় বঙ্গ অঞ্চলের স্থানীয় ভাষা।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশি হিসেবে আমরা মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে গর্ববোধ করি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলা ও লেখাপড়া করার অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করে শহিদ হন বাংলাদেশের দামাল ছেলে সালাম, রফিক, জব্বারসহ অনেকে। সে আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও সাধারণ মানুষ জীবন উৎসর্গ করে। মাতৃভাষার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা আর বলিদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বর্তমানে প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষ মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। যার বেশিরভাগই ফেসবুক ব্যবহারকারী। যদিও স্থানীয় পর্যায়ে আমাদের কনটেন্ট বলতে গেলে তেমন নেই। ব্যান্ডউইথের পুরোটাই খরচ হয় ভিনদেশি কনটেন্টে। এরপরও পৃথিবীর সর্বত্রই এখন বাংলার জয়গান। ইন্টারনেটে বাংলা ভাষার ব্যবহারও দিন দিন বাড়ছে। তথ্য সংগ্রহ কিংবা ছড়িয়ে দিতে বাংলার জয়-জয়কার।
সময় এখন ফেসবুক, টুইটার, হাইফাইভ, ইউটিউব ও ব্লগস্টারসহ আরও অনেক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের। এসব মাধ্যমে মনের ভাবগুলো বন্ধুদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বেশ কয়েক বছর আগেও লাইক, কমেন্ট ও স্ট্যাটাসে বাংলার ব্যবহার ছিল না। আর এখন এগুলোতে বাংলা হরহামেশাই ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু এই ইন্টারনেটের যুগে একটা শিশু জন্মের পরই ইন্টারনেট দ্যাখে। টেকনোলজির সাথে ইনভল্ব হয়ে যায়। টেকনোলজি ও ইন্টারনেট দিয়ে শিশুরা এখন প্রথম শিক্ষা শুরু করে। কারণ একটা শিশু কথা বলার আগে মোবাইলে গেমস খেলতে পারে। কার্টুন দেখে মজা পায়। শিশুরা পড়ে শেখে না। তারা দেখে শেখে। তাদের কাছে যা ভালো লাগে, তা-ই তারা বারবার করতে চায় বা দেখতে চায়। যেমন কার্টুন ও মোবাইল গেমস। এমন কোনও শিশু নেই যে কার্টুন ও মোবাইল গেমস পছন্দ করে না।
আমাদের দেশে ফেসবুক ও ব্লগ বেশ জনপ্রিয় হলেও ইউটিউবের শিশুদের জন্য বাংলায় তেমন কোনও ভাল কার্টুন নেই। মোবাইলে বাংলায় ভালো কোনও গেমসও নেই। আমার দুই ছেলে যখনই সময় পাই তখনই ইউটিউবে কার্টুন দেখে আর মোবাইলে গেমস খেলে। যেহেতু বাংলায় ভালো কোনও কার্টুন নেই, তাই বাধ্য হয়ে ভাষা না বুঝলেও শিশুরা বিদেশি কার্টুন দ্যাখে। দেখতে হয়। এরসঙ্গে ওই ভাষার প্রতি তার আগ্রহ তৈরি হয়। এমনকি শিশুটি ওই ভাষায় মাতৃভাষার চেয়েও দক্ষ হয়ে ওঠে। এর বাস্তব উদাহরণ হলো, ইন্ডিয়ান কার্টুন ডরিমন দেখে অনেক শিশু হিন্দি ভাষায় কথা বলতে পারে। শুধু ভাষা নয়, ভাষার সাথে অন্য দেশের সংস্কৃতিও সে নিজের মাঝে ধারণ করতে থাকে। আমি মাঝে মাঝে নিষেধ করি। আবার চিন্তা করি, বিগ ডাটা আর ওপেন সোর্সের দুনিয়ায় তাদের নিষেধ করে কি ঠেকাতে পারব? এজন্য তাদেরকে কীভাবে দোষ দিই? কারণ আমরা তো তাদের প্রয়োজন মতো কন্টেন্ট দিতে পারছি না।
ইংরেজির কথা বাদই দিলাম, ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষা, যেমন- হিন্দি, জাপানিস, চাইনিজ ভাষায় যেসব কার্টুন আছে, যা ইউটিউবে সার্চের পুরোটাই দখল করে আছে। যখনি শিশু ইউটিউবে কিছু দেখতে থাকে তখনি ওইসব কার্টুন প্রথমে আসে এবং তা-ই তারা দ্যাখে। আমরা যদি শিশুদের প্রয়োজন মতো কন্টেন্ট দিতে না পারি তাহলে যে ভাষার জন্যে আমাদের এত অর্জন ও গর্ব, তা কি আমরা ধরে রাখতে পারব? আমাদের শিশুরা কি আগামীতে ভাষাশহিদদের অবদান মনে রাখবে?
আমার কাছে মনে হচ্ছে, শিশুর মাঝে ভাষার প্রতি আগ্রহ জাগাতে হলে তার প্রয়োজন মতো তার হাতে পর্যাপ্ত কন্টেন্ট দিতে হবে। এর কোনও বিকল্প নেই। কারণ একটা শিশুর প্রথম শিক্ষা হলো মাতৃভাষা। আর এই মাতৃভাষা শেখার জন্য তাহকে শিক্ষক দিতে হয় না, বইখাতা লাগে না। তাকে স্কুলেও দিতে হয় না। মাতৃভাষা শিশুটি নিজে নিজেই শেখে। সে শিখে তার পরিবেশ ও পরিবেশের বিভিন্ন উপকরণ থেকে। আমরা কিন্তু তাদেরকে জোর করে কোনও কিছু করাতে পারি না। বা করালেও সেখানে ভালোবাসা থাকে না। আমরা যা করতে পারি তা হলো, পরিবেশের উপকরণগুলোকে তার পছন্দমতো সাজিয়ে দিতে পারি। কোনও কিছুর প্রতি শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা জোর করে আসে না। তা আসে তখনই যখন সে কোনও কিছু থেকে তার প্রয়োজন মেটাতে পারে। ভাষা বা সংস্কৃতি প্রতি শিশুদের শ্রদ্ধা নিজের থেকে আসতে হবে। আসাতে হবে। এজন্য দরকার শিশুর পরিবেশে পর্যাপ্ত পরিমানে বিভিন্ন উপকরণ, যার মাঝে রয়েছে বাংলায় বেশি বেশি কার্টুন আর গেমস। যেহেতু শিশুরা কার্টুন আর গেমস বেশি পছন্দ করে, তাই আমরা যদি বাংলা ভাষায় বেশি বেশি কার্টুন বানাতে পারি, বাংলা ভাষায় বেশি বেশি গেমস বানাতে পারি, তাহলে একটা শিশু নিজের থেকেই ভাষার প্রতি আগ্রহ দেখাবে। আর তার ছোট মনে আমাদের সংস্কৃতিকেও লালন করবে।
বিজ্ঞানের ছাত্র বলে ইতিহাস তেমন পড়ি নাই বা পড়তে ও ভালো লাগে না তবে ইতিহাসের সারমর্ম পড়ি। যেমন অ্যাবাকাস (Abacus) নামক একটি প্রাচীন গণনা যন্ত্রকেই কম্পিউটারের ইতিহাসে প্রথম যন্ত্র হিসেবে ধরা হয়। এটি আবিষ্কৃত হয় খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০ সালে ব্যাবিলনে। এর পর অনেক বিবর্তনের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে মাইক্রোপ্রসেসর উদ্ভাবনের ফলে মাইক্রোকম্পিউটারের দ্রুত বিকাশ ঘটতে থাকে। ১৯৮১ সালে বাজারে আসে আই.বি.এম কোম্পানির পার্সোনাল কম্পিউটার বা পিসি। এর পর একের পর এক উদ্ভাবিত হতে থাকে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন মাইক্রোপ্রসেসর এবং তৈরি হতে থাকে শক্তিশালী পিসি। আর আজ মানুষের মত বুদ্ধিসম্পুর্ন কম্পিউটারের দ্রুত বিকাশ ঘটছে… । তদ্রূপ ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ শহীদ হন। তাই এ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ইতিহাস এতটুকুই যথেস্ট বলে মনে করি। তারপর বর্তমান অবস্থান এরপর ইতিহাস অনুযায়ী এই অর্জন ধরে রাখতে সামনে আমাদের কি করতে হবে?
আমি মনে করি ইতিহাস পড়ার মুল উদ্দেশ্য হল পুর্ব অবস্থা অনুযায়ী কোন কিছু সামনে দিনে কি হবে। ভাষা বলেন, সংস্কৃতি বলেন সবই এখন ভারচুয়াল জগত দখল করে ফেলেছে আর ভবিষ্যতে এই ভারচুয়াল জগতই ভাষা ও সংস্কৃতি কে কন্ট্রোল করবে, সিরিয়াল করবে কে উপরে থাকবে কে নিচে থাকবে। তাই এখন যদি আমরা ভারচুয়াল জগতে বেশি বেশি কন্টেন্ট না দিতে পারি তাহলে আমাদের শিশুরা বাংলা কন্টেন্ট পাবে না আর না পেয়ে বিদেশী কন্টেন্ট নিয়ে পরে থাকবে।