ভালোবাসা এখানে নেই, আছে নৃশংসতা আর রক্ত

সিরাতাল মুস্তাকিম

প্রকাশিত : মার্চ ০২, ২০২০

বিশ্বজুড়ে সকলের প্রিয় মুখরোচক খাবার হচ্ছে চকোলেট। কিন্তু এর পিছনে রয়েছে শুধুই অন্ধকার। এতটাই যে, সেখানে নিশ্বাস নেয়াও বারণ। ১.৮ মিলিয়ন আফ্রিকান শিশু যারা তাদের শৈশব র‍্যাপিং পেপারে মুড়ে ঢেলে দিচ্ছে আমার আপনার সন্তানের মুখে। আইভরি কোস্ট আর ঘানা। পশ্চিম আফ্রিকার এই দুটো দেশে পৃথিবীর মোট কোকোর ৭০% চাষ করা হয়। কালো মানুষ, কালো মাটি, কালো চকোলেট।

প্রতিদিন হাজার হাজার বাচ্চা পাচার হয়ে যায় মালি, বুরকিনা ফাসো— এইসব প্রতিবেশী দেশ থেকে ঘানা, আইভরির কোকো ফার্মগুলোতে। স্কুল, কাজ আর ডলারের লোভ দেখিয়ে বা রাস্তা থেকে তুলে আনা হয় বাচ্চাদের। সকাল ছটা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত অমানুষিক পরিশ্রম করানো হয়। খাদ্য বলতে সস্তার ভুট্টা সেদ্ধ আর কলা। রাত্রে জানোয়ারের মতো জানলা-দরজাহীন কাঠের আস্তাবলে ফেলে রাখা হয়।

কখনো বেঁধে রাখা হয় হাতে-পায়ে শিকল দিয়ে। এদের মধ্যে যারা পালানোর চেষ্টা করে তাদের ভাগ্যে থাকে বেধরক মার। মার খেয়ে বা ধর্ষণে মরে গেলে নদীতে বা কুকুরের মুখে ছুঁড়ে দেয়া হয় শরীর। ভয় লাগছে? ঘেন্না লাগছে? আপনার শিশুটির মুখে লেগে থাকা চকোলেটের খয়েরি দাগের দিকে তাকাচ্ছেন? তাহলে আর পড়বেন না। কারণ ইন্টারন্যাশনাল লেবার ল এখানে অকেজো। মায়া ও ভালোবাসা নেই এখানে। আছে নৃশংসতা, আছে রক্ত। যা শুকিয়ে কালো হয়ে আছে আপনার ফ্রিজে রাখা চকোলেটে।

বিশ্ববিখ্যাত চকোলেট কোম্পানিগুলো যেমন নেসলে, হার্সেস, মার্স এখান থেকে কোকো কেনে। প্রতিযোগিতার বাজারে কোকোর দাম কম রাখার জন্যই শিশু শ্রমিক দরকার। কারণ ৫-১২ বছর বয়সীরা মজুরি পায় না। তার ওপরে তারা কোকো ফিল্ডের দুর্গম জায়গায় যেতে পারে, যেখানে একটু বড়রা ঢুকতে পারবে না। হ্যাঁ, পোকা, সাপ আর বিছের কামড়ে বেশ কিছু বাচ্চা মারা যায়, কিন্তু তাতে মালিকদের কিছু যায় আসে না।

দারিদ্র্য থাকবে, বাচ্চার যোগানও থাকবে। বড় কোম্পানিগুলো চুপ করে থাকে সস্তায় কোকো পাওয়ার জন্য। কোকো ফার্মের শিশু শ্রমিকদের ৪০% মেয়ে। তাদের বয়ঃসন্ধি আসে, যৌবন আসে এই কোকো বাগানেই। এদের অধিকাংশই সারা জীবনে তাদের পরিবারের সাথে দেখা করতে পারে না। কারণ এখানে আসা সোজা, বেরোনো কঠিন নয়, অসম্ভব। মালিক, ঠিকাদার, সুপারভাইজার, পুলিশ এমনকি মজুরদের যৌনতৃপ্তি মেটায় মেয়েরা।

এখানকার মেয়েরা ১১ বছরে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে যৌনরোগ। পচে, গলে যায় মেয়েদের শৈশব। কাজের নমুনা? মেছেটে হল এমন একটি ছুরি যা চালালে একটা শিশুকে কিমা বানিয়ে দেয়া যায় কয়েক মিনিটে। বাচ্চাদেরকে মেছেটে ধরিয়ে দেয়া হয় কোকো বিন পেড়ে সেটাকে বস্তায় পুড়ে ঝাড়াই বাছাই করার জন্য। এতে কারোর আঙুল কাটা যায়, কারোর গায়ে সৃষ্টি হয় গভীর ক্ষত। দশ বছরের বাচ্চাকে পিঠে একশো কেজির বস্তা নিয়ে পথ চলতে হয়। একটু বিশ্রাম নিতে গেলেই পিঠে এসে পড়ে চাবুকের ঘা।

আধুনিক সভ্যতার এই যুগেই প্রকাশ্যে চলছে এই ক্রীতদাস প্রথা। আর এই অন্ধকার জগৎ থেকেই বেরোচ্ছে আমার আপনার প্রিয় সুস্বাদু ডার্ক চকোলেট।

ঋণ: দ্য ডার্ক সাইড অফ চকোলেট (২০১০)