ভারতের নির্বাচন: মগজধোলাই ও ধর্মান্ধতার জয়

ড. পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশিত : মে ২৬, ২০১৯

অবশেষে দেখা গেল, শাসক শ্রেণি ও তাদের মিডিয়ার অষ্টপ্রহর গোয়েবলস অপপ্রচার আর মিথ্যাচার সাধারণ মানুষের মগজধোলাইয়ে পুরোপুরি ভাবে সফল। দেশ এখন আবার সরকারি ভাবে ধর্মান্ধদের দখলে। সাধারণ মানুষ অর্থাৎ ৯৯ ভাগ হিন্দু ধর্মান্ধতা, লাগামছাড়া কর্পোরেট পুঁজিবাদ, হিংসা ও ঘৃণার রাজনীতি, ফ্যাসিজমের পক্ষে রায় দিয়েছে।

পুলওয়ামা সন্ত্রাসে ভারতীয় সেনাদের মৃত্যু, যুদ্ধজিগির, উগ্র দেশপ্রেমের টনিকে খাদ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি, দারিদ্র্য, রাস্তাঘাটে বাচ্চাদের পড়ে থাকা— এসব real life issue থেকে মানুষের মনকে ঘুরিয়ে দেয়া হলো। বেকারত্ব, চাষিদের আত্মহত্যা, রাস্তাঘাট- গ্রামেগঞ্জে মেয়েদের ধর্ষণ, মুসলমানদের ওপর, দলিতদের ওপর বর্বর অত্যাচার, ভয়ঙ্কর পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্যসঙ্কট, জিনিসপত্র ও পরিবহণের আকাশচুম্বী খরচ, ব্যাংকের সুদ দ্রুত কমিয়ে দেয়া, দেশজ শিল্প ও কৃষির বিপর্যয়, অর্থনীতির সম্পূর্ণ বেদখল হওয়া, ইত্যাদি অতি জরুরি বিষয় নিয়ে নির্বাচন নামক এই প্রহসনে কোনো আলোচনাই হলো না।

মানুষের দৃষ্টি নোটবন্দি, জিএসটি, আধার কার্ড এসব থেকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেয়া হলো। তথ্য, যুক্তি, বিশ্লেষণ এসব অপপ্রচার আর মিথ্যাচারের তোড়ে ভেসে গেল খড়কুটোর মতো। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো সেরকম কোনো বিপক্ষ শক্তিও আর থাকল না। কর্পোরেট মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া অতি সফলভাবে নরেন্দ্র মোদিকে একমাত্র নেতা এবং বিজেপিকে একমাত্র দল হিসেবে প্রজেক্ট করতে সক্ষম হলো। ঠিক আমেরিকার মতোই একপেশে প্রচার হলো। বিরোধী দলগুলোর সেরকম কোনো সর্বজনগ্রাহ্য নেতা বা নেত্রীও দেখা গেল না, বা প্রকৃতভাবে একজোট হয়ে লড়াই করার কোনো আকাঙ্ক্ষাও দেখা গেল না। রাহুল গান্ধী ও তার পরিবারকে মানুষ অল্টারনেটিভ নেতৃত্ব বলে স্বীকার করতে, মেনে নিতে পারলো না। রাহুল গান্ধী নিজে নির্বাচনে পরাজিত হলেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা ভাঁড়িয়ে, ক্রিমিনাল রেকর্ড চাপা দিয়ে, এবং প্রকাশ্যে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী উক্তি করেও বিজেপি নেতা ও নেত্রীরা রমরম করে নির্বাচনে জয়লাভ করলেন।

হিন্দি প্রচার, হিন্দু সংখ্যাগুরুত্বের, এবং পুরুষতান্ত্রিকতার জয় হলো। এই জয় আরো বেশি প্রকট হয়েছে অহিন্দিভাষী দক্ষিণী রাজ্যগুলোতে বিজেপির এই ঝড় সম্পূর্ণ রোধের মধ্যে দিয়ে। কেরালা, তামিলনাডু এবং অন্ধ্রতে এই তুমুল বিজেপি ঝড়েও কোনো দাগ কাটেনি। কেরালায় বিজেপি একটাও কেন্দ্রে জেতেনি। ওড়িশাতেও নবীন পটনায়েকের দূর্গ অক্ষত আছে। পশ্চিমবাংলায় সিপিএম ও কমিউনিস্ট পার্টি উড়ে চলে গেছে। তাদের অপশাসন, গুণ্ডাবাজি ও প্রাচীনপন্থী, পুঁজিবিরোধী অপশাসনের ফলে তৃণমূল এসেছিল। এখন তৃণমূলের চরম অশিক্ষা, অপশাসন ও দুর্নীতির ফলে বিজেপির ক্ষমতায় আসা শুধু সময়ের অপেক্ষা। বাংলায় বিজেপি রাজ্য সরকার! দুবার কি তিনবার কথাটা নিজের মনে মনে উচ্চারণ করে দেখুন, কেমন লাগে!

ধন্যবাদ কংগ্রেস পার্টি ও গান্ধী পরিবারকে, আপনাদের‌ দীর্ঘদিনের অপশাসন, অক্ষমতা, মিথ্যে প্রতিশ্রুতিকে। আপনাদের পারিবারিক রাজতন্ত্রকে। ধন্যবাদ কমিউনিস্ট পার্টি, আপনাদের সীমাহীন ঔদ্ধত্য আর গুণ্ডাবাজির রাজনীতিকে। পশ্চিমবঙ্গকে উচ্চমেধা থেকে নিম্নমেধা করে তোলার অসীম ক্ষমতাকে। আর পশ্চিমবঙ্গ নামক একসময়ের উদারপন্থী, প্রগতিশীল রাজ্যে খাল কেটে কুমির আসার রাস্তা তৈরি করে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ তৃণমূল‌ কংগ্রেসকে।

আমার প্রিয় দুই দেশ ভারত— আমার জন্মস্থান, যেখানে আমি জন্মেছি, বড় হয়েছি, বাংলা ভাষা, গান, মানুষকে ভালোবাসতে শিখেছি, আর আমেরিকা— কর্মস্থান, যেখানে আমার বাকি জীবন কাটছে, বাকী জীবনটা আমি এই দুটো দেশেই ফ্যাসিস্ট শাসকদের অধীনে কাটাবো। এই দুই দেশে থাকা আমার পরিবার পরিজন, সন্তান, হাজার বন্ধুবান্ধব সবাই এই প্রগৈতিহাসিক‌ মানসিকতার রেসিস্ট, সেক্সিস্ট শাসকদের ঠিক করে দেয়া নিয়মকানুন মেনে চলতে বাধ্য হবে।

প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদে সেঁকে চামড়া।

আমি নিশ্চিত, এখন আবার হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাঙ্কো, কু ক্লাক্স ক্ল্যানের দিন সমাসন্ন। নিষ্ঠুর, অন্ধকার শক্তিরা‌ আমাদের গ্রাস করতে আসছে। আবারও সারা পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ, রক্তক্ষয়, হিংসার আবহ তৈরি হবে। এর সাথে যোগ হবে বিপজ্জনক হারে জলবায়ুর পরিবর্তন, মানুষের মৃত্যু, ভয়ানক দারিদ্র্য, রোগ ও দুর্ভিক্ষ। ভারতে ও বাংলায় মুসলমান, দলিত ও মেয়েদের ওপর নির্মম অত্যাচার নেমে আসবে ঘরে ও বাইরে।