ভারতীয় পানিসন্ত্রাস: নদীশাসন ও সমাধান
আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনানপ্রকাশিত : আগস্ট ২৪, ২০২৪
পানি, নদী কিংবা সাগর এগুলো নিছক নিষ্প্রাণ কোনো জড় পদার্থ নয়। এগুলো মহাপরাক্রমশালী মহান আল্লাহ সুবহানাহুয়া তা`য়ালার সৃষ্টি। এগুলোর আত্মা বা রুহ আছে। নদীর পানিকেই আমরা তার দেহ বলি। এর আত্মা হলো তার ভেতরের বয়ে আনা পলি। নদীও মহান আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করে! তার স্বাভাবিক একটা গতি আছে। সেটা স্বাভাবিক রাখলে পুরো পানিচক্রই স্বাভাবিক থাকে। স্বাভাবিক থাকে জীবন। আর যখনই আমরা একে বাঁধা দিব তখন তা হবে নদীশাসন। নদীও তখন চুপ করে বসে থাকবে না। বরং প্রতিশোধ নেবে। দেখা দেবে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল ধুধু মরুপ্রান্তর, ব্যাপক বন্যা, কমবে কৃষিজমি, উৎপাদন, বাড়বে উজানের ভাঙন, পলিহীনতার ফলে সাগর গিলবে দেশ, ধ্বংস হবে অর্থনীতি। কারণ মাত্র একটি, ফলাফল কিন্তু অসীম।
বাংলাদেশের প্রায় ৫৪টি নদীর প্রায় ৩০টিতেই ভারত বাঁধ বসিয়ে যুগের পর যুগ ধরে করে আসছে এই নদীশাসন। শুষ্ক মৌসুমে পানি ধরে রেখে বাংলাদেশকে মরুকরণের নীল নকশা, বর্ষায় বাঁধগুলো খুলে দিয়ে বাংলার মানুষ ডুবিয়ে মারা। কী ফেরাউনি উপহাস! এক বাক্যে পানিসন্ত্রাস। একই সাথে আল্লাহর দেয়া প্রাকৃতিক নিয়ম এবং আন্তর্জাতিক পানিবণ্টনচুক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পুতুল সরকারের দাসত্বের সুযোগে যুগের পর যুগ এভাবেই জালিমের জুলুমের শিকার হয়ে আসছে বাংলার আপামর কোটি জনগণ। আজকের মতো শুধু একটা উদাহরণ দিচ্ছি। দেখুন।
ফারাক্কা! যা আগামী ২০২৬ এ শেষ হতে যাচ্ছে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা চুক্তি হয়। চুক্তিতে বলা হয়েছে, নদীতে ৭০ হাজার কিউসেক বা তার কম পানি থাকলে দুই দেশ সমান সমান পানি ভাগ করে নেবে। পানির পরিমাণ ৭০ হাজার কিউসেক থেকে ৭৫ হাজার কিউসেক হলে ৪০ হাজার কিউসেক পাবে বাংলাদেশ। অবশিষ্ট প্রবাহিত হবে ভারতে। আবার নদীর পানির প্রবাহ যদি ৭৫ হাজার কিউসেক বা তার বেশি হয় তাহলে ৪০ হাজার কিউসেক পানি পাবে ভারত। অবশিষ্ট পানি প্রবাহিত হবে বাংলাদেশে। তবে কোনো কারণে যদি ফারাক্কা নদীর পানির প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেকের নিচে নেমে যায় তাহলে দুই দেশে কে কী পরিমাণ পানি পাবে, সেটা পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে।...
বিগত প্রায় দুই যুগে উক্ত চুক্তির বাস্তবায়ন তো দুরের কথা, ঘটেছে সম্পূর্ণ বিপরীত। শুধু বাংলাদেশ নয়, এ চুক্তি স্বয়ং ভারতের জন্যেও বয়ে এনেছে সীমাহীন দুর্ভোগ। প্রায় ৪৩ বছর আগে ১৬ মে ভারতে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে লং মার্চে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মৌলানা ভাসানি। এই দিনটি `ফারাক্কা লং মার্চ দিবস` হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। যদিও পাঁচ দশকে ফারাক্কা নিয়ে ভারতের অনড় অবস্থানে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতেও ফারাক্কার বিরুদ্ধে জনমত জোরালো হচ্ছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার তো ফারাক্কা ব্যারাজ ভেঙে ফেলারও প্রস্তাব করেছেন। তার কথায়, “প্রতি বছরই আমরা ফিল্ড ট্রিপে সেখানে যাই। পাঁচ-ছ’বছর আগে যখন মালদার পঞ্চানন্দপুরের ভাঙন খতিয়ে দেখতে যাই, তখন দেখেছিলাম ফারাক্কার বুকে মাঝগঙ্গাতেও কিন্তু বক দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ফারাক্কাকে এই অবস্থাতেই ফেলে রেখেছি যেখানে এত বিপুল পরিমাণ সেডিমেন্টেশন হচ্ছে যে নদীর চ্যানেলটার আর জল ধরে রাখার ক্ষমতা নেই। আর সেটা দুই পারে উপচে পড়ছে।”
ভারতের স্থানীয় একজন গ্রামবাসী সুন্দর উপমা টেনে বলেছিলেন, “সাপের মুখটা জোরে ধরে রাখলে সাপটা যেমন ছটফট করে, নদীটাও এখানে সেভাবে ছটফট করছে। আর সাপের মুখটা ধরে রাখা হচ্ছে এই ফারাক্কা ব্যারাজ।”
মেধা পাটকরেরও কোনও সংশয় নেই, ভারতের জন্যও ফারাক্কা এখন যত না উপযোগী, তার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংস ডেকে আনছে। পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা ঊর্মিলা দাস দেখাচ্ছেন গঙ্গার ভাঙনে কীভাবে তিনি ভিটে হারিয়েছেন। তিনি পরিষ্কার জানাচ্ছেন, “না ভাটিতে, না উজানে— ফারাক্কার প্রভাব কোথাওই সুখকর হয়নি। বলা হয়েছিল ফারাক্কা বন্যা রুখতে পারবে, অথচ দেখা গেছে বন্যা আর খরার চক্র ঘুরেফিরে এসেছে।”
ভারতের বিশেষজ্ঞদের মতে, ফারাক্কার অভিজ্ঞতা আমাদের এটাই শিখিয়েছে যে, বড় নদীর বুকে জল নিয়ে খেলতে নেই। তুমি বরং সেই জলটাকে ক্যাচমেন্টে আটকাতে পারো, বড় নদীতে মেশার আগেই সেই জলটা কাজে লাগিয়ে নিতে পারো।
প্রায় অর্ধশতাব্দীর পুরনো ফারাক্কা ব্যারাজ যে ভারতের আর বিশেষ কোনও কাজে আসছে না, বরং নানা ধরনের পরিবেশগত বিপদ ডেকে আনছে, বিশেষজ্ঞরা অনেকেই তা খোলাখুলি বলছেন। আজ তারাই ফারাক্কা ভেঙে দেয়ার পক্ষে জনমত গঠন করছেন।
তাহলে সমাধান কি?
১. বাঁধের বিপরীতে বাঁধ নির্মাণ পুরোটাই একটি দেশীয় আবেগ। এটি কস্মিনকালেও কোনো সমাধান নয়। বরং বাঁধ পুরোপুরি ভেঙে ফেলাটা অবশ্যই একটি স্থায়ী সমাধান। শুধু ফারাক্কা নয়, এক একটা বাঁধ। অথবা সারা বছর প্রাকৃতিক নিয়মে নদীকে চলতে দেয়ার স্বার্থে প্রতিটি গেইট খুলে রাখা। এটি দুই দেশের কোটি কোটি মানুষের জন্যই কল্যাণের।
২. আন্তর্জাতিক পানিচুক্তির আওতায় ভারতকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার চেষ্টা করা। ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করা। বুঝতে শেখা কেন সে চায় না বা অন্য কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি ভেজা বেড়াল আর আমাদের মতো রাষ্ট্রের বেলায় বাঘ সাজতে চায়। তার সাথে কথা বলার ভাষা বদল করা।
৩. মানসিকতার পরিবর্তন আনা। এটা ভুল ধারণা যে, আমরা চারদিক দিয়ে ভারতবেষ্টিত। বরং ভারতই তার চারদিক দিয়ে শত্রুবেষ্টিত। গভীরভাবে মানচিত্র দেখুন। চায়না, পাকিস্তান, নেপাল, আফগান ইত্যাদি রাষ্ট্রের সাথে বিচক্ষণ কুটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা। এটাই মোক্ষম সময়। বৈশ্বিক এলাইয়েন্স বলয় পরিবর্তন করা। নতুন এলায়েন্স বলয় তৈরি করা।
৪. আমাদের সমস্যা ভারতের সাধারণ মানুষের সাথে নয়, ভারত সরকারের ফেরাউনি নীতির সাথে। ভারতে রয়েছে আমাদের ইতিহাস, আকাবির ও দ্বীনি ভাই ও বোন। তাই ঢালাওভাবে সবাইকে গালি না দেয়া। বরং ভারত সরকারের সাথে ৩০ বছরের সমস্ত চুক্তির নথিপত্র রি-ওপেন করা। জাতীয় স্বার্থবিরোধী সমস্ত চুক্তি বাতিল করা। রেল ট্রাঞ্জিট, মংলা, সব। শুধু পণ্য বয়কট নয়, এবার পুরো ভারতীয় পলিসি বয়কটের আওয়াজ তোলা। কারণ প্রজন্মের কাছে তাদের স্বরুপ এরই ধ্যেই দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাই সময়টা কাজে লাগানো।
৫. আমাদের প্রতিটি নদীকে মেগাড্রজিং প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা। এতে আমাদের নদীর পানি সারা বছর আমরাই ধরে রাখব ইনশাআল্লাহ। যেমন, চায়নার দেয়া তিস্তা প্রস্তাবকে সতর্কতার সাথে ডিল করা। এতে জালেমের গালে বেশাক চপেটাঘাত করা হবে। ড্রেজিং একটি উত্তম সমাধান।
আপাতত এতটুকুই। ইনশাআল্লাহ, পরবর্তীতে আরও বিস্তারিত বলার বা লেখার চেষ্টা করব। তবে সব কথাই একটি মৌলিক দর্শনে গিয়ে ঠেকে। যতদিন না আল্লাহর জমিনে আল্লাহর শাসন ও হুকুম প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ততদিন আমরা কেউই স্বাধীন নই। কস্মিনকালেও নই। আর যতদিন না আমরা নবির (স.) পরিপূর্ণ সিরাত ও সুন্নাতের ভাষায় দ্বীন কায়েমের পথে না হাঁটছি ততদিন কোনো তন্ত্র মন্ত্র আমাদের শারিয়াহ ইমারাহ ও খিলাফাহও এনে দিতে পারবে না। কস্মিনকালে নয়।
আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের প্রজন্মের মাঝে আছে সাহস, দৃঢ়তা, আবেগ, ত্যাগ ও বিচক্ষণতা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসংখ্য বকধার্মিকের চেয়েও অনেক বেশি। তাদের প্রতি সালাম। তবে দ্বীনের জিম্মাদারি থেকে আমার আপনার ওপর ওয়াজিব হলো, তাদেরকে সিরাত ও সুন্নাতের আদলে পরিপূর্ণ ইসলামি হুকুমাত, শারিয়া ইমারাহ ও খিলাফাহর দিকে দাওয়াত দেয়া। কারণ সব মওজুদ থেকেও যদি তাওহিদুল্লাহ অনুপস্থিত থাকে তবে দাসত্বের শিকল আমাদের গর্দান থেকে নামানো সম্ভব নয়।
তাই আসুন, বন্যা থেকে শেকড়ের শিক্ষাটুকু গ্রহণ করি। আজকের বিপদ কেটে যাবেই ইনশাআল্লাহ। তবে মনে রাখা জরুরি, এটা শো অফের সময় নয় যে কে কী করলাম! কতটুকু করলাম, কত টাকা দিলাম, কালেক্ট করলাম, ত্রাণ দিলাম! এটা শো-অফের সময় নয় যে আমি, আমরা, আমার দল বা আমার ফাউন্ডেশন ইত্যাদি ইত্যাদি কে কী করলাম। বরং এটা সমস্যার শেকড়ে আঘাত করার সময়। এটা সমস্যার গভীরে গিয়ে সিরাতের শেকড়ে আঘাত করার সময়। মহান আল্লাহই একমাত্র তাওফিকদাতা। আল্লাহুমা সল্লি আ`লা মুহাম্মাদ ওয়া সাল্লিম।
মদিনা মুনাওওয়ারা
১৮ সফর ১৪৪৬ হিজরি
লেখকের অফিসিয়াল ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত