ভবিষ্যৎ সুন্দর করতে কেন শৈশব হত্যা

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২২, ২০১৮

ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর এক বন্ধুর সুবাদে বেড়াতে গিয়েছিলাম ঝিনেদাতে। সেখানে অনেকদিন ছিলাম। প্রায় এক মাস। ঝিনেদা থেকে বন্ধুটি আমাকে অনেক জায়গাতেই নিয়ে গিয়েছিল- যশোর, ওদের গ্রামের বাড়ি কালীগঞ্জ। একবার নিয়ে গিয়েছিল চুয়াডাঙ্গাতে ওর বড়বোনের বাড়ি। সে-বাড়িতেই এমন একটা দুবির্ষহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে, সেই স্মৃতি মনে পড়লে আজও মন বিষিয়ে উঠে আমার! আমরা গিয়েছিলাম বিকেলে। কিন্তু সেই শান্ত বিকেলই তুমুল অশান্ত হয়ে উঠল সন্ধ্যার অন্ধকার জমাটি বাঁধার পর। আমরা যে রুমে ছিলাম, তার পাশের রুম থেকেই হঠাৎ কান্নার শব্দ ভেসে উঠল, ভয়ের কান্না, যন্ত্রণার কান্না, আর সহ্য না করতে পারার কান্না। আমি আর বন্ধুটি দৌড়ে গেলাম সে রুমে। গিয়ে যা দেখলাম, বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। বন্ধুটির দুলাভাই প্রাজ্ঞ চেহারার স্কুল মাস্টার দুলাভাই তার বারো কী তেরো বছরের ছেলেটাকে মারছেন। বেদম ভঙ্গিতে মারছেন। মারার কারণটি হলো, পড়া মুখস্থ করাতে পারছে না। বারবার ভুল করছে সেই কোমলমতি চেহারার ছেলেটি। আমার বন্ধুপ্রবরটি ভাগিনাকে তার বাবার কঠোর ছায়া থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো। পরদিন সাতসকালে আবার আমাদের সেই ছেলেটির কান্না শুনে ঘুম ভেঙে যায়। রাতে মেরেছিল ইংরেজির জন্য, এখন মারছে অংকের জন্য। মারতে মারতে ওকে চেয়ার থেকে ফেলে দিয়েছে নিচে। আমার বন্ধুপ্রবরটি এবার আর ভাগিনাকে উদ্ধারে গেল না। বড়বোনের কাছে গিয়ে অনুযোগ করল, দুলাভাই ওকে এত মারে কেন? বড়বোনের কণ্ঠও অশ্রুরুদ্ধ হলো, আর বলিস না! মারতে মারতে ছেলেটাকে আধমরা বানিয়ে ফেলেছে। বাপের কাছে পড়তে বসলেই সবকিছু ভুলে যায় আর মার খায়! বড়বোনের কথা শুনে বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাত করে উঠেছিল! এ-বাড়িতে আসাঅব্দি ছেলেটার মুখে একফোঁটা হাসি দেখিনি। সারাক্ষণ কী একটা আতংক যেন ওকে তাড়া করে বেড়ায়। আমি আর ওর দিকে তাকাতে পারি না। আমরা দুই বন্ধু সকালের নাস্তা খেয়ে সারাদিনকার জন্যে ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম।সন্ধ্যার সময় বাড়িতে ফিরে আবারো শুনলাম, সেই পড়ার ঘর থেকে ছেলেটির অসহ্য তীব্র যন্ত্রণাকর কান্না ভেসে আসছে... পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই আমার বন্ধুটির দিকে হাত করজোড় করে বলছিলাম, আমি আর এক মিনিটও এ-বাড়িতে থাকতে পারব না, চলো আমরা ঝিনেদাতে ফিরে যাই। বন্ধু সঙ্গে সঙ্গেই ফেরার জন্য তৈরি হয়েছিল।
আজও যখন কোথাও বেড়াতে যাই, শিশুদের মুখে হাসি দেখলে আনন্দে মন ভিজে উঠে আর অসহায়ত্বের করুণ মুখ দেখলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে চুয়াডাঙ্গার সেই দুঃসহনীয় স্মৃতি আর কানে বাজে বিলাপধ্বনি। ভবিষ্যতকে সুন্দর করার জন্য কারো শৈশবকে হত্যা করার কি কোনও মানে আছে? বলুন বাবারা, কিছু একটা বলুন।