বয়ানভঙ্গি লেখকের স্টাইল তৈরি করতে পারে
তুহিন খানপ্রকাশিত : জানুয়ারি ২৭, ২০২০
যারা `প্রমিত` লেখেন, তারা সবাই `থেকে` লেখেন। সমস্যা হয় না। যারা `প্রমিত` লেখেন না, তারা কেউ `থিকা`, কেউ `থেইকা`, কেউ `হইতে`, কেউ `থাইকা`, কেউ `থাকি` ইত্যাদি লেখেন। তাও নাকি একরকম লাগে। কী করা যায়?
লেখার যে স্টাইল, এইটারে অনেকেই ভাবেন শব্দ আর সিনট্যাক্সের খেলা। শব্দ আর সিনট্যাক্স লেখার স্টাইলের জন্য জরুরি জিনিশ, সন্দেহ নাই। কিন্তু শব্দ আর সিনট্যাক্স খুব গুরুতর জিনিশ না। শব্দের তরলতা-কঠিনতা বা বাক্যের ভাঙচুরের বাইরেও, কেবল ন্যারেটিভ স্টাইল বা বয়ানভঙ্গি একজন লেখকের লেখার ইউনিক স্টাইল তৈরি করতে পারে। কথাটা আমার না, উমবের্তো একোর।
একো এই কথার পক্ষে তিনটা যুক্তি ও উদাহরণ দিছেন।
এক. উনিশ শতকে ইতালিয়ান সাহিত্যের মাস্টারপিস `দ্য বেট্রোডেড`। এই ক্ল্যাসিক উপন্যাসের লেখক ইতালিয়ান লিটারেচারের মায়েস্ত্রো মাঞ্জোনি। মাঞ্জোনির এই উপন্যাসে কোন শব্দ কতবার আসছে, তা নিয়া একটা গবেষণা হইছিল। দেখা গেল, মাঞ্জোনির শব্দের গুদাম অতিশয় দরিদ্র। `গুড` শব্দটা সবচাইতে বেশি ব্যবহৃত হইছে উপন্যাসটায়। তারপরেও এই উপন্যাস ক্ল্যাসিক হইতে পারছে, খালি মাঞ্জোনির বয়ানভঙ্গির কারণে।
দুই. একোর নিজের বিখ্যাত উপন্যাস `দ্য নেম অব দ্য রোজ`। এই বইয়ের নায়ক অ্যাডসো একবার এক মেয়ের সাথে সেক্স করে। তো, এই সেক্সের বয়ান যে দুই পেজে আছে, ওই দুই পেজে, একোর ভাষায়, তার নিজের কোনও শব্দ নাই। মধ্যযুগের বিভিন্ন বইপত্র ঘাঁইটা একো বিভিন্ন শ্লোক-আয়াত-মরমি গান ইত্যাদির একটা কোলাজ বানাইয়া ওই দুই পৃষ্ঠায় ঢুকাইছেন। তাতে যে ইউনিক চেহারা দাঁড়াইছে ওই দুইটা পৃষ্ঠার, তা অনবদ্য।
তিন. একো `ফ্ল্যাশব্যাক`র কথা বলছেন। `ফ্ল্যাশব্যাক` খুব প্রচলিত একটা ন্যারেটিভ ফর্ম। অনেক লেখক বা ডিরেক্টর এই ফ্ল্যাশব্যাকের কারিশমা দেখাইছেন তাদের হিট বই/মুভিতে। এর জন্য তাদের শব্দ বা বাক্যের ভাঙচুর লাগে নাই।
তো, স্টাইল বা ভঙ্গির ইউনিকনেস, এইটা পাওয়ার নানা ওয়ে আছে। বিশর ইবনু হারিস (বিশর হাফি) এর একটা বাক্যের অনুবাদ করছেন মীযান হারূন ভাই, এইভাবে— `বাইরে কোঁচা লম্বা, ভেতরে অষ্টরম্ভা।` এইটা বিখ্যাত একটা প্রবাদ। এখন কেউ যদি আপত্তি করেন, বিশর ইবনু হারিস আরবিতে আসলে কী বলছিলেন, তার পুরা টোন, অর্থ ও মর্ম এই বাঙলা প্রবাদে ধরা পড়ে কিনা, এই দাবির উত্তর দেওয়া মুশকিল।
একজন বিদেশি লেখকের টোন কেমন, তা কেবল শব্দ বা বাক্যের গঠন দিয়া জাজ করতে যাওয়া মুশকিলের। প্রথমত দেখা লাগবে, উনি যা বলতে চাইছেন, বাঙলায় তার কথার অনুবাদ সেই অর্থ বহন করতেছে কিনা। যদি করে, তাইলে উনি কোন টোনে কথা বলছেন, সেই আলাপটা গৌণ। কারণ, আমার এই লেখা কেউ যদি ইংরাজিতে অনুবাদ করেন, আমার লেখার টোন অক্ষত থাকবে কী?
আমাদের যে `প্রমিত` পূজারি ভাইয়েরা অনুবাদে লেখকের মৌলিক টোন দাবি করেন, তারা কিন্তু ইংরাজি অনুবাদে দিব্যি রুমি পড়েন, কোনও সমস্যা হয় না। অথচ, ইংরাজি অনুবাদে রুমির যে চেহারা দাঁড়ায়, তা যে পশ্চিমের পলিটিকাল এজেন্ডার অংশ, সেইটা উনারা জানেনই না, এমন ভাব। এই ব্যাপারগুলা মাথায় রাখা ভালো।