ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা বিমুখ মুসলমান এবং বাংলা ভাগ
পর্ব ১
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : অক্টোবর ০৮, ২০২০
বাস্তবে বাংলার হিন্দু-মুসলিম চাষা বা কারিগরদের সন্তানরা খুব কমই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতো। মধ্যযুগের পাঠশালায়ও তাদের কিছু কিছু অংশগ্রহণ ছিল। আহমদ শরীফ লিখেছেন, নিম্নবর্গের মুসলিম কৃষকরা এবং নিম্নবর্ণের হিন্দু বা অন্ত্যজরা ছিল নির্জিত আর শোষিত। মধ্যযুগে মুসলিম শাসনে তাঁরা যে সবাই খুব এটা সুযোগ সুবিধা পেয়েছিল সেটাও সত্যি নয়। বিশেষ করে চাষী মুসলিমরা ছিল চিরকাল বিত্তে নগণ্য। পাঠশালায় শিক্ষাগ্রহণ করতে যাবার অধিকারে তাদের নিষেধ ছিল না। সমস্যা ছিল বিত্তের। বিশেষ করে নিম্নবর্ণের যে-সব হিন্দুরা মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে কখনোই তাঁরা খুব সুখে ছিলেন না। স্মরণ রাখতে হবে বাংলার ধর্মান্তরিত মুসলমানরা ছিল সমাজের সবচেয়ে নিম্নবর্ণের। হিন্দু থাকাকালে হিন্দু রাজত্বে তাঁরা না পেয়েছেন সম্মান, না পেয়েছেন শিক্ষালাভের সুযোগ। ফলে শিক্ষা গ্রহণের দিকে কখনো তাঁদের আর ঝুঁকে পড়া হয়নি। মধ্যযুগে পাঠশালা শিক্ষায় যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে নিম্নবর্ণের অনেকে থাকলেও অন্ত্যজদের কম দেখা গেছে। কারণ অন্ত্যজদের জন্য কায়িকশ্রম দেয়া ছাড়া আর কোনো পেশায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল না।
মুসলমানরা যাঁরা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন তাঁরা যে ইসলামের আচার-আচরণ পালন বা খুব ধর্মকর্ম করতেন তাও নয়। বলতে গেলে তাঁরা শুধু চাষাবাসই করতেন। মধ্যযুগে শাসক বনেদী মুসলমানদের সন্তানরা মক্তব-মাদ্রাসায় পড়াশুনা করতো। ধর্মান্তরিতরা অনেকে তখন সুযোগ থাকলেই সন্তানদের কমবেশি মক্তবে পড়াতেন শাসক মুসলিম সমাজে নিজেদের সম্মান বৃদ্ধির আশায়। মুসলমানদের ব্যাপক অংশটি চাষাবাদের সাথে যুক্ত থাকায় সন্তানদের সাক্ষরতা নিয়ে সেভাবে মাথা ঘামাতেন না। ইংরেজ শাসনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আর নীলকর ও জমিদারদের শোষণে কৃষকদের অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছিল যে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা ছাড়া তাঁরা সুস্থভাবে আর কিছুই ভাবতে পারতেন না। মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কেও ভাবতে হতো; আর সে জন্য মুসলমান কৃষকরা সন্তানদের মক্তবে পাঠাতেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে তাঁর মতো দীনহীনের সন্তানদের কী লাভ হবে তাঁরা বুঝতেই পারতেন না। তা ছাড়া মক্তবে পড়ার জন্য খুব বেশি সময় দিতে হতো না, খুব সকালে স্বল্প সময়ে পাঠগ্রহণ শেষ করে সন্তানরা পিতামাতাকে কাজে সাহায্য করতে পারতো। হিন্দু চাষার সন্তান খুব কমই ইংরেজদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে যেতো। প্রথম কারণ সে-সব বিদ্যালয় ছিল বর্ণহিন্দুদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, পাঠ্যসূচী ছিল ভদ্রসমাজের যোগ্য।
সাধারণ কৃষক মুসলমান শিশুদের ধর্মশিক্ষার জন্য মক্তবের সংখ্যা তখন বাড়ছিল। মিশনারীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বর্ণহিন্দুদের প্রভাবিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিকল্প হিসেবেই তাঁরা মক্তবকে গ্রহণ করেছিলেন। খ্রীস্টান শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে যাঁরা দীর্ঘকাল লড়াই করেছেন, সেই শাসকদের শিক্ষা যে তাঁরা গ্রহণ করবেন না এটাই তো স্বাভাবিক। ধর্ম রক্ষার স্বার্থে ইংরেজদের কাছে কৃষক মুসলমানরা তাঁদের ঈমান বিক্রি করতে রাজী ছিলেন না। এ কথা বলাও বাঞ্ছনীয় যে, বর্ণহিন্দুদের রচিত পাঠ্যপুস্তকের কারণেও অভিজাত মুসলিমদের একটি অংশ বাংলায় শিক্ষাদানের বিরোধী ছিলেন। কারণ পাঠ্যপুস্তক এবং তার ভাষা নিয়ে বহুজনেরই আপত্তি ছিল। শিক্ষাবিদ খান বাহাদুর আব্দুল মজিদ চৌধুরী জনশিক্ষা বিভাগের নিকট তাঁর চিঠিতে এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। তিনি চিঠিতে লেখেন, মুসলিম মাতা-পিতাগণ তাঁদের সন্তানদের শুধুমাত্র বাংলা পড়াতে চান না, কেন না এ ভাষাটি হিন্দু ভাবাদর্শে প্রভাবিত। বাংলা ভাষার মধ্যে সংস্কৃত শব্দের অনুপ্রবেশকে তিনি এজন্য দায়ী করেন। হিন্দুদের রচিত শিশুদের পাঠ্যগ্রন্থের নানা বিষয় বিজাতীয় প্রবণতার সৃষ্টি করে বলে তিনি অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে না গিয়ে তাই মুসলমানরা নিজেদের রুচি অনুযায়ী নিজ খরচে মক্তব প্রতিষ্ঠা করে। মুসলমানরা নিজেদের সন্তানদের শিক্ষাদানের জন্য কেন মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে।
বাংলার মুসলমানদের যে অংশ কিছুটা অগ্রগামী ছিলেন, তাঁরাও প্রাথমিক শিক্ষায় বর্ণহিন্দুদের আধিপত্য গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। শিক্ষিত বাঙালী হয়েও আব্দুল মজিদ কেন মক্তবের পক্ষে কথা বলেছিলেন তার ব্যাখ্যা জানা প্রয়োজন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি যাঁরা বাংলা শিক্ষার পুরোধা ছিলেন বা যাঁরা বাংলা ব্যাকরণ, বাংলা পড়ার বই লিখেছেন তাঁরা প্রায় সবাই ভাবতেন বাংলা ‘সংস্কৃত ভাষার সন্তান’। এঁরা মনে করতেন সংস্কৃত ব্যাকরণ মেনে চললেই এবং সংস্কৃত শব্দের অঢেল চলন হলেই বাংলা যথার্থ জ্ঞানপিপাসার ভাষা হয়ে উঠবে। সংস্কৃতপন্থী বাংলা আর হিন্দু স্বদেশীয়তা ভদ্রলোকদের মানসিকতায় বাসা বেঁধেছিল। শ্যামাচরণ সরকার আঠারশো বায়ান্ন সালে তাঁর বাংলা ব্যাকরণের ভূমিকায় সংস্কৃত সন্ধি, সমাস ও বিভিন্ন পদের বিস্তর ব্যবহার বাংলায় চলতে পারে বলে মত দিয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা ও একই মত পোষণ করতেন। তিনি বলেছিলেন, সংস্কৃত ভালো না জানলে এদেশের কোনো ভাষাতেই উত্তম বুৎপত্তি ঘটবে না। বাংলা ভাষার সংস্কার করে সংস্কৃতের মিশ্রণে এক মার্জিত সাধু বাংলা গড়ে উঠেছিল সেই সময়। সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষায় ভদ্রলোকদের পছন্দ ছিল না, কাজেই এই সংস্কার। বাংলা ভাষাকে ঋদ্ধ করার জন্য হয়তো এইরকম সংস্কারের কথা ঈশ্বরচন্দ্র বা অন্যরা ভেবেছিলেন, কিন্তু মুসলমানরা তা মেনে নিতে পারেননি। সত্যিকার অর্থ বর্ণহিন্দু বা বাবুরা তখন ইংরেজ শাসকদের এতোটাই পদলেহন করছিলেন যে, মুসলমানদের দিক থেকে বর্ণহিন্দুদের প্রতিটি পদক্ষেপই সন্দেজনক মনে হতে থাকে।
বাংলা ভাষায় যেমন তখন সংস্কৃত শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, একইভাবে দীর্ঘদিন মুসলিম শাসনে থাকার ফলে প্রচলিত বাংলায় যে-সব আরবি-ফারসি শব্দ ছিল সেগুলিকে বিসর্জন দেওয়া হলো। আঠারশো চল্লিশ সালে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীস হিন্দু কলেজ সংযুক্ত পাঠশালার পাঠ শুরুর বক্তৃতায় এই মার্জিত বাংলার পক্ষেই মত দেন। সংস্কৃতানুসারী বাংলা ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন তিনি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে এই সাধু বাংলা প্রসারিত হতে থাকে। পাঠ্যপুস্তকে এই সাধু বাংলার সাথে হিন্দুদের নানা পৌরাণিক গল্প স্থান পায়। প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তকে একদিকে সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলার অনুপ্রবেশ আবার অন্যদিকে হিন্দুদের পৌরাণিক গল্পকে স্থান দেয়ার কারণেই আব্দুল মজিদ ভাষাটিকে ‘হিন্দুভাবাদর্শ প্রভাবিত’ বলেছিলেন। প্রফুল্ল কুমার পান পরবর্তীকালে বাংলা পরিচয়ের দুশো পঁচিশ বছর গ্রন্থে লিখেছিলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেসব বর্ণপরিচয়মূলক গ্রন্থে নীতিপাঠ দেওয়া হতো, সেগুলির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার ও জাতিভেদের বীজ উপ্ত হয়। বর্ণপরিচয়মূলক গ্রন্থের গদ্যপাঠে সৃষ্ট চরিত্রগুলিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে গ্রন্থকাররা অনেকেই নিজের নিজের ধর্মের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন, ভিন্ন ধর্ম এবং নীচু জাতকে খাটো করেছেন। হিন্দুদের রচিত বর্ণপরিচয়মূলক গ্রন্থে শব্দ-বানান শিক্ষার পদ্ধতিতে এবং চরিত্র সৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িক বিভেদকে অনিচ্ছাকৃতভাবেই উস্কে দেওয়া হয়েছিল।
শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য যখন ‘শিশুসেবধি’ গ্রন্থ রচিত হয় তখন পুরো জাতপাতের যুগ। বর্ণমালার গ্রন্থ উল্টালেই দেখা যাবে প্রায়ক্ষেত্রে জাতিগতভাবে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়কে বড় করা হয়েছে। রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের শিশুসেবধি গ্রন্থে ‘জাতিমালা’ নামক অধ্যায়ে ব্রাহ্মণ, বারেন্দ্রশ্রেণীর ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র জাতির কিছু নাম এবং তাদের পদবী উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ব্রাহ্মণদের পদবী শর্মা, গঙ্গোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় ইতাদি; বারেন্দ্রশ্রেণীর ব্রাহ্মণদের পদবি লাহিড়ি, ভাদুরি, মৈত্র ইত্যাদি; ক্ষত্রিয় জাতির পদবী আগুরি, বৈশ্য জাতির পদবী সেন, দাস ,দত্ত এবং শূদ্র জাতির পদবী পালিত, গুহ ঘোষ ইত্যাদি। গ্রন্থের বিরাট অংশ জুড়ে উল্লিখিত হয়েছে ব্রাহ্মণ-বৈদ্য ইত্যাদি জাতির বিদ্যাসংক্রান্ত উপাধিগুলি; যেমন ব্রহ্মণদের বিদ্যাসম্বন্ধীয় উপাধি হচ্ছে বিদ্যালঙ্কার, বিদ্যাবাগীশ ইত্যাদি আর বৈদ্যদের বিদ্যাসংক্রান্ত উপাধি হচ্ছে বিশারদ, বৈদ্যরত্ন ইত্যাদি। এমনকী একাদশী, পুর্ণিমা, অমাবস্যা ইত্যাদির উল্লেখ এবং সেসব দিনের আচার-আচরণ সম্বন্ধীয় বক্তব্যগুলি হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথেই সম্পর্কিত। কিন্তু এগুলি খুব নির্দোষভাবেই হয়তো গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে, কিন্তু মুসলমান শিশু শিক্ষার্থীদের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে। মদনমোহন তর্কলঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’ গ্রন্থে ধর্মাধর্ম, জাতপাত, চতুবর্ণের কথা নেই। কিন্তু ঘোষাল পদবী, ব্রহ্মোপাসনা, জটবল্কধারণ ইত্যাদি শব্দ-বানান শিক্ষার জন্য ব্যবহৃত হলেও তা শিশুমনে হিন্দু সম্প্রদায়ের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থে জাতপাতের কথা নেই। বিদ্যাসাগর নবীন, মাধব, গোপাল এইভাবে নাম উচ্চারণ করেছেন কিন্তু কারো নামের সাথে পদবী যোগ করেননি। নামগুলি দেখে বোঝার উপায় নেই কে ব্রাহ্মণ আর কে ক্ষত্রিয় বা শূদ্র। কিন্তু তারপরেও সন্নাসী, পারলৌকিক, আহ্নিক এইরকম শব্দ-বানান শিক্ষার মধ্য দিয়ে হিন্দুধর্মাবলম্বী ক্রিয়াকাণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশেষ করে বিদ্যাসাগর জাতপাত মানতেন না এবং সাম্প্রদায়িকও ছিলেন না। কিন্তু তিনি মার্শম্যানের লেখা ‘বাংলার ইতিহাস’ দ্বিতীয় ভাগ বইটি অনুবাদ করেছিলেন। বইটির ভূমিকায় বলা ছিল, বইটি সরাসরি অনুবাদ নয়; কিছু যোগ বিয়োগ করা হয়েছে। সে বইয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে বিদ্যাসাগর বলেছেন ‘অতি দুরাচার’ আর বেন্টিঙ্ককে বলা হয়েছে ‘চিরস্মরণীয় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক মহোদয়’। বইটিতে অন্ধকূপহত্যার বর্ণনা আছে, যা পরবর্তীতে বহু ইতিহাসবিদ মিথ্যা বলে প্রমাণ করেছেন। বিদ্যাসাগরের সিরাজদৌলাকে দুরাচার বলাতে, পাশাপাশি বেন্টিঙ্ককে মহিমান্বিত করায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংশয়তো জাগেই। ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ নিয়ে মুসলামানদের মনে নানাধরনের প্রশ্ন দেখা দেয়।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ভদ্রলোকরা যখন ইংরেজ শাসনে শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে গেলেন এবং বিদ্যালয়ের জন্য তাঁদের অনেকে পাঠ্য বই লিখতে শুরু করলেন, দেখা গেল সেই পাঠ্য বইয়ে হিন্দুদের সংস্কৃতি বা হিন্দুধর্মের বহুকিছু স্থান পেল। হিন্দু এই ভদ্রলোকেরা গ্রন্থ লিখবার সময় এ কথা ভাবেননি যে, বাংলার একটি বড় সম্প্রদায় হচ্ছে মুসলমান। হিন্দুদের দেবদেবী বা হিন্দুদের আচার-অনুষ্ঠানকে গ্রন্থে স্থান দিলে তা ধর্মনিরপেক্ষ রচনা হবে না। মুসলমানদের আত্মমর্যাদায় স্বভাবতই তা ঘা দেবে এবং মুসলমানরা এক ধরনের বিদ্বেষ পোষণ করবে। নওয়াব আলী চৌধুরী মুসলিম ছাত্রদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, শিক্ষা বিভাগের কর্মচারীদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যাই অধিক এবং তাঁদের নির্বাচিত পাঠ্যপুস্তকে হিন্দুদের দেবদেবী, হিন্দু-কৃষ্টি ও হিন্দুদের ইতিহাসই প্রাধান্য পায়। তিনি আরো অভিযোগ করেন যে, হিন্দুদের রচিত বাংলা পাঠ্যপুস্তকে মুসলিম ইতিহাস ও অন্যান্য যা রয়েছে তার অধিকাংশ বিকৃত ও মনগড়া। নওয়াব চৌধুরীর বক্তব্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল। তিনি নওয়াব আলীর বক্তব্যকে খুবই সহানুভূতির সাথে গ্রহণ করেছিলেন এবং নওয়ার আলীর বক্তব্যের পক্ষ নিয়ে পত্রিকায় লিখেছেলেন।
রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতী’ পত্রিকায় মুসলিম শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেন যে, বাঙলা বিদ্যালয়ের প্রচলিত পাঠ্যপুস্তকগুলি বিশেষরূপে হিন্দু ছাত্রদের পাঠোপযোগী করে লেখা হয়ে থাকে, অথচ বাঙলার অনেক প্রদেশেই হিন্দু অপেক্ষা মুসলমান প্রজা সংখ্যা অধিক। তিনি নওয়াব আলীর আক্ষেপের প্রতি সম্মান জানিয়ে লেখেন যে, এরূপ হবার কারণ এই যে, এতদিন বিদ্যালয়ে হিন্দু ছাত্রসংখ্যাই অধিক ছিল এবং মুসলমান লেখকগণ বিশুদ্ধ বাংলা সাহিত্য রচনায় অগ্রসর হননি। কিন্তু ক্রমান্বয়ে মুসলমান ছাত্রসংখ্যা বেড়ে চলেছে এবং ভালো বাংলা লিখতে পারেন এমন মুসলমান লেখকের অভাব নেই। অতএব মুসলমান ছাত্রদের প্রতি দৃষ্টি রেখে পাঠ্যপুস্তক রচনার সময় এসেছে। সন্দেহ নেই যে, উনিশ শতকের হিন্দু সমাজের পুরোধারাই মূলত বাংলা গদ্যসাহিত্য ও বাংলার ইতিহাস রচনায় বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। বাংলার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা তথা প্রাথমিক শিক্ষার পুরো পাঠক্রম তাঁদের হাতেই রচিত হয়েছিল। সত্যিকার অর্থে বাংলার মুসলামানদের উনিশ শতকে এসব ব্যাপারে সামান্যতম অবদান ছিল না। হিন্দুদের দ্বারা রচিত পাঠ্যপুস্তকে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার বিষয়, ভাষা, সাহিত্য-ভাবনা হিন্দুদের সংস্কৃতি দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছিল। খুব গভীরভাবেই তাতে হিন্দু সংস্কৃতির ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সহ অন্যরা পুরানো বাংলা ভাষা থেকে আরবি-উর্দু শব্দ সম্পূর্ণ বিদায় করে দিয়ে সেখানে সংস্কৃত শব্দের আমদানী করেছিলেন। ব্যাপারটা যে সচেতনভাবে তাঁরা করেছিলেন, তা নয়। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায় যে সেখানে একেবারেই আলোচিত বা মূল্যায়িত হয়নি সেটা ছিল ক্ষোভের কারণ।
রবীন্দ্রনাথের বন্ধু লোকেন্দ্রনাথ পালিত লিখেছিলেন, মনে আছে আমরা বাল্যকালে কেবল মাত্র বাংলা ভাষায় শিক্ষা আরম্ভ করেছিলাম। বিদেশি ভাষার পীড়নমাত্র ছিল না। আমরা পণ্ডিত মহাশয়ের কাছে পাঠ সমাপন করে কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশীরাম দাসের মহাভারত পড়তে আরম্ভ করলাম। এই সব সরল স্বীকারোক্তি থেকে ভালোই বোঝা যায়, কী ধরনের গ্রন্থ দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার সাহিত্যপাঠ আরম্ভ হতো। নির্দোষ এইসব সাহিত্যের ব্যাপ্তী ছিল বিশাল কিন্তু সাধারণ মুসলমানের ধর্ম বা আচার-আচরণের সাথে এর সঙ্গতি ছিল না। বিশেষ করে শোষক জমিদার বর্ণহিন্দুদের প্রতি তাঁদের ঘৃণা, এই ধরনের সাহিত্যের প্রতি তাঁদের মনকে বিরুপ করে তুলেছিল। ধর্মীয় নেতাদের শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত সাধারণ কৃষকরা তাঁদের ধর্মের সাথে সম্পর্কিত বিষয় সন্তানদের শেখাতে চাইতেন। রামায়ণ বা মহাভারত নয়। সতের শতকের নিম্নবর্গের মুসলমানরা রামায়ণ মহাভারতের গল্প পড়তে ভালবাসতেন, কৃষ্ণের প্রেম সম্পর্কে উৎসাহী ছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নতুন বর্ণহিন্দু জমিদারদের দ্বারা দীর্ঘদিন শোষিত-নির্যাতিত উনিশ শতকের সেই কৃষকরা, ইসলাম ধর্মের নতুন দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হলেন। হিন্দু ভদ্রলোকদের হাতে তৈরি সংস্কৃতানুগ বাংলাকে তাই অনেক মুসলমান ভদ্রলোকরা হিন্দুয়ানী বাংলা বলে অভিহিত করেছিলেন। হিন্দুরাও অনেকে কালক্রমে সংস্কৃত-ঘেঁষা বাংলার সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বলেছেন, বাংলা সংস্কৃত ভাষার সন্তান নয় বা বাংলা ভাষা সংস্কৃত থেকে সৃষ্ট নয়।
মুসলমানদের কাছে যেমন এসব গ্রন্থ গ্রহণীয় ছিল না, খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে গ্রন্থের বিষয়বস্তুগুলি সাধারণ হিন্দুদের পক্ষেও যায় না। কারণ পৌরাণিক কাহিনীর মূল চরিত্ররা ছিলেন ব্রাহ্মণ। বেদের ধর্মশিক্ষা বা হিন্দুদের প্রাচীন ধারাগুলি প্রাথমিক শিক্ষার অন্তুর্ভুক্ত করে জাতপাতের প্রসারে তা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। তাতে শিক্ষাচর্চা ও শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে জাতপাতের ব্যাপারগুলি গভীরভাবে শেকড় গেড়ে বসেছিল। প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের নিরক্ষরতা দূর করাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত, বৃহৎ দার্শনিক প্রশ্নগুলোকে সামনে আনা নয়। দার্শনিক প্রশ্নকে বিচার করে গ্রহণ করবার ক্ষমতা শিশুরা রাখে না। সেজন্য শিশুকে নীতি শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে ভয়াবহ কিছু নেই। কারণ নীতিগুলো গড়ে ওঠে ধর্মশিক্ষার ভিত্তিতে, নীতিশিক্ষার ফলে শিশুর মন একপেশে হয়ে দাঁড়ায়। প্রশ্ন দাঁড়ায়, শিশুকে যদি নীতিশক্ষা দেওয়াই কাজ হয়; তাহলে সেটা কোন নীতি, কোন আদর্শের পক্ষে সে দাঁড়াবে। সকল নীতি বা আদর্শের বিপরীত আদর্শও রয়েছে। হিন্দুধর্মের আর বুদ্ধধর্মের নীতিশিক্ষা এক ছিল না, ঠিক তেমনি হিন্দু আর মুসলিমের নীতি শিক্ষা এক হতে পারে না। ফলে এইসব শিক্ষা শিশুর মনকে বিভ্রান্ত করে, সাম্প্রদায়িক করে তোলে। যখন পাঠশালা শিক্ষা ছিল, পাঠশালার কমবয়সের শিশুদের জন্য ইতিহাস বা ধর্মশিক্ষার ব্যাপার ছিল না। দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনে পাঠশালার শিক্ষাক্রম রচিত হয়েছিল। পাঠশালা শিক্ষায় ছাত্র এবং শিক্ষকদের একটা বড় অংশই ছিলেন হিন্দু। মুসলমান ছাত্র সে তুলনায় খুবই কম ছিল। অথচ পাঠশালার পাঠ্যক্রমে মুসলমানদের হেয় করা বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার মতো কারণ ঘটেনি।
বাংলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষিত হিন্দুদের একপেষে এবং মনগড়া রচনার অনেকেই সমালোচনা করেন। ভাষাবিদ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ‘আল ইসলাম’ পত্রিকায় লেখেন, ‘পরিতাপের বিষয়, আমাদের শিশুদেরকে প্রথমেই রাম শ্যাম গোপালের গল্প পড়তে হয়। সে পড়ে গোপাল বড় ভালো ছেলে। কাসেম বা আবদুল্লা কেমন ছেলে, সে তা পড়ার সুযোগ পায় না। এখান থেকেই তার সর্বনাশের বীজ বপিত হয়। তারপর সে পাঠ্যপুস্তকে রামলক্ষ্মণের কথা, কৃষ্ণাজ্জুর্নের কথা, সীতাসাবিত্রীর কথা, বিদ্যাসাগরের কথা, কৃষ্ণকান্তের কথা ইত্যাদি হিন্দু মহাজনদের আখ্যান পড়তে থাকে। স্বভাবতই তার ধারণা জন্মে যায়, আমরা মুসলমান ছোট জাতি, আমাদের মধ্যে বড় লোক নাই। হিন্দু বালকগণ ঐ সকল পুস্তক পড়ার পর মনে করে, আমাদের অপেক্ষা বড় কেহ নয়। মুসলমানরা নিতান্ত ছোট জাত। তাদের মধ্যে ভালো লোক জন্মে না। এই প্রকারে রাষ্ট্রীয় একতার মূলোচ্ছেদন করা হয়।’ চলবে