ব্যাকডেটেড অটোটিউন
আশিকুজ্জামান টুলুপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৮
আমার মতো ওল্ড স্কুল মিউজিক ডিরেক্টর মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস ফেলে বলি, কী যুগ আসলো, সব গানে অটো টিউন। আমাদের সময় কি ভালো ছিল, কি সুন্দর অটো টিউন ছাড়া গান করতাম। শিল্পীরাও ছিল সব বাঘা বাঘা।
এই অটোটিউন বিষয়টা আসলে একটা নতুন টেকনোলোজি, যেটা সর্বপ্রথম পশ্চিমের শের নামক গায়িকা ব্যাবহার করেছিল। পরবর্তীতে গত একযুগে ধীরে ধীরে অটোটিউন নতুন জেনারেশনের কানে সুন্দরভাবে জায়গা করে নেয়। তাছাড়া এটা যুগে, টেস্ট ও টেকনোলোজির চাহিদা। কাউকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। মুভির ডিরেক্টর যদি চায় অটোটিউন, মিউজিক প্রোডিউসারের করার কিছু নাই। তবে যেকোনো কিছুরই ওভারইউজড বিষয়টা একটা একঘেয়েমি তৈরি করে। সেইদিকে নজর দেয়াও একটু দরকার। ভবিষ্যতে যে আরও কতকিছু আমাদের পরের জেনারেশনকে দেখতে হবে, সেটাই এই আলোচনার মূল বিষয়।
এখন মোটামুটি ৬৫% গানে অটোটিউন ব্যাবহার হচ্ছে বলে মনে হয়। শুধু আমাদের দেশে নয়, বরং বম্বেতেও। এখন স্টুডিওতে গেলে অনেক সময় ইঞ্জিনিয়ার জিজ্ঞাসা করে, ‘অটোটিউন দেব?’ অতিনিকটে এমন একটা সময় আসছে যখন অটোটিউন কেরানীগঞ্জের উত্তর পাড়ার বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বকলম সাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা স্টেজে দবির, সবেত, পুষ্প, সবার গানে ব্যাবহার করবে। তখন তাহলে স্টুডিওতে কি ইউজ হবে??
বর্তমানে নরেন আর সুলেখার গানে হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশির স্যাম্পল্ড পিস কপি পেস্ট করে ইন্টারলিউড বানানো হয়। ম্যাজিক ভিডুতে দেখানো হয়, কপোত কপোতির যৌবনভিত্তিক জটিলতায় ভরপুর দৃশ্য। এর মইদ্যে আবার দমকল বাহিনী দিয়া ‘রূপে আমার আগুন জ্বলে’ টাইপ আকুতি সৃষ্টি করার জন্য কৃত্রিম বৃষ্টি তৈরি করা হয় শুটিংয়ের সময়। সে কী হাড্ডিভাঙা শট! মাইনসে গান কি শুনবো, ম্যাজিক ভিডু’র সিন দেইখাই নানাখানা অবস্থা এবং ভিডু শেষ হইলে আবার ওজু কইরা আসার অবস্থা হয়। যাই হোক, এই স্যাম্পল বিষয়টা আরও বেশি করে বিভিন্নভাবে ইউজ হবে এর পরের শতাব্দীতে।
ভবিষ্যতে অর্থাৎ সামনের যুগে স্টুডিওতে যাওয়ার পর গান গাওয়ার আগে ইঞ্জিনিয়ার জিজ্ঞাসা করবে, গলায় কার স্যাম্পল দেব? আশা ভোসলে, না লতা মঙ্গেস্কর? না সামিনা চৌধুরী? না সাবিনা ইয়াসমিন? বিষয়টা একটু বিশ্লেষণ করি সাধারণ শ্রোতাদের জন্য। প্রত্যেকটা স্টুডিওতে তখন আশা ভোসলে, লতা মঙ্গেস্কর, সামিনা চৌধুরী, সাবিনা ইয়াসমিন এবং মোটামুটি সব নামকরা শিল্পীদের গলার টোনের একটা স্যাম্পল কপি বা অ্যাপ থাকবে। অনেক সময় একটা অ্যাপের মধ্যেই হয়তো ৩০টা শিল্পীর টোন স্যাম্পল করা থাকবে। অ্যাপের দামের উপর ভিত্তি করে শিল্পী সংখ্যা হবে। শিল্পী সিলেকশনে আবার এশিয়ান, অ্যামেরিকান, কেনেডিয়ান, চাইনিজ, জাপানিজ, কোরিয়ান, অ্যারাবিয়ান বিভিন্ন দেশের অপশন থাকবে অ্যাপে। গায়ক স্টুডিওতে গান গাইতে গিয়ে যদি সিলেক্ট করে কিশোর কুমার বা মনি কিশোরের গলার স্যাম্পল, ইঞ্জিনিয়ার প্রথমে র ভয়েসটা নিয়ে অটোটিউনের খেলা খেলে তারপর কিশোর কুমার বা মনি কিশোরের গলার টোনের স্যাম্পল লাগিয়ে দেবে। ব্যস, আর যায় কই! গান গাইবো নরেন আর গলা বাইরাইবো কিশোর কুমারের।
ইউনিভার্সাল অডিও বা নিভ তখন হয়তো আরও অ্যাডভান্স অ্যাপ বার করবে, যেখানে শিল্পীর বিভিন্ন বয়সের গলার অপশন থাকবে। অর্থাৎ আপনি যদি আশা ভোসলে সিলেক্ট করেন, তখন অপশন আসবে ২৫ বছরের আশা? না ৪০ বছরের আশা? না ৫৫ বছরের আশা? এইরকম আর কি! তখন এসডি বর্মণের ৩০ বছরের গলাতেও গান গাইতে পারবেন। সে সময় গলারও কপি রাইট করা হবে। টেকনোলোজি এমন পর্যায়ে চলে যাবে যে, জন্মের পরপরই মুসলমানি করানোর সময় ডাক্তারকে দিয়ে বাচ্চার গলায় অটোটিউনের অ্যাপ লাগিয়ে নেবে মা-বাবারা। কারণ বড় হয়ে লাগাতে গেলে খরচ অনেক বেশি পড়বে। প্রতিবছর শুধু বাচ্চাদের অ্যাপটা আপডেট করে নিতে হবে, ব্যস। বড় হয়ে গান গাইলে ভালো, না গাইলেও অসুবিধা নাই। কারণ ঐ লাগানোর খরচ চাইল্ড ইন্সিউরেন্সই কাভার করবে।
তবে আবার সেই একই অবস্থা হবে অর্থাৎ সব গলাই এক মনে হবে। সব ছেলেরা যেয়ে সিলেক্ট করবে আরজিত সিং আর সব মেয়েরা হয় শ্রেয়া ঘোষাল অথবা শুভমিতা। সমস্ত ইউটিউব তখন আরজিত সিং, শ্রেয়া ঘোষাল, শুভমিতাইয় ভরে যাবে। এখনকার মিউজিক প্রোডিউসাররা ঠিক আমাদের মতো করে তখন বলবে, ‘কি যুগ যে আসলো, আমাদের সময় কি ভালো ছিল, কি সুন্দর অটোটিউন দিয়ে গান করতাম। আর এখনতো সব আরজিত সিং হয়ে গেছে। কে যে ভূপেন হাজারিকা, আর কে যে মায়া হাজারিকা, বোঝা বড় কঠিন।
লেখক: কণ্ঠশিল্পী