ব্যক্তিগত বিনোদন নাকি আসক্তি

পর্ব ৭

সরকার আবদুল মান্নান

প্রকাশিত : নভেম্বর ৩০, ২০২৪

ফেসবুক আমাদের গোপনীয়তাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। প্রতিনিয়তই লক্ষ লক্ষ টেক্সট ও পিক আপলোড করা হয় ফেসবুকে। সেখানে আমরা মানুষের ব্যক্তিত্বহীন, মর্যাদাহীন, রুচিগর্হিত জীবনাচরণের পরিচয় পাই। অর্থহীন, তাৎপর্যহীন, বিরক্তিকর, ফালতু টেক্সট থেকে শুরু করে খাদ্যগ্রহণের ছবি, অসুস্থতার ছবি, স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্ট সম্পর্কের ছবি, সাজ-সজ্জার ছবি, নিজের এবং ছেলে-মেয়েদের সাফল্যের অখ্যান ও ছবি এবং আরও অসংখ্য বিষয় এত পরিমাণে আপলোড হতে থাকে যে, কারো মাথা ঠিকা রাখার সুযোগ থাকে না।

বিশেষ করে পরচর্চা করা, অন্যকে ছোট করা, গালাগাল দেওয়া, বদনাম ছড়ানো, দোষী সাব্যস্ত করা, অপমান-অপদস্ত করা থেকে শুরু করে এহেন কোনো আপকর্ম নেই যা সামাজিক মাধ্যমে সংগঠিত হয় না। সুতরাং এমন একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কী করে ব্যক্তিগত বিনোদনের একমাত্র আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। ফেসবুকে প্রতিনিয়ত এমনসব মানুষদের আপনি দেখতে পাবেন যাদের মধ্যে যৌক্তিকতাবোধ, বিচারবোধ, ন্যায়বোধ, সৌন্দর্যবোধ ও দায়-দায়িত্ববোধ নেই। এরা ঈর্ষাপরায়ণ, পরশ্রীকাতর, ছিদ্রান্বেষী এবং সর্বদাই মানুষের ক্ষতি করার কথা ভাবে।

অন্যকে কষ্ট দেওয়ার মধ্যে এদের আনন্দ। এক ধরনের মানসিক রোগ এরা লালন করে। এরা অসুস্থ। আমরা চাই বা না চাই, ফেসবুক ব্যবহার করলে এদের এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। ফলে অনিবার্যভাইে আমরা আনন্দের পরির্বতে নিরানন্দকে বরণ করে নিই। আমাদের চেতন-অবচেতনে দুর্ভাবনার আবহ বিরাজমান থাকে। ধীরে ধীরে আমরাও অসুস্থ বোধ করি। কিন্তু অনেকেই বুঝতে পারি না যে, কেন অসুস্থ হয়ে পড়ছি।

ফেসবুক এমন একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্য যার আশ্রয়ে অনেক মানুষের সঙ্গে আমাদের নিত্যদিনের যোগাযোগ বেশ সহজ ও স্বচ্ছল হয়ে ওঠে। ফলে আপনা থেকেই এক বা একাধীক নারী বা পুরুষের সঙ্গে হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই সম্পর্ক পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা ও ভালোবাসার না হয়ে এক ধরনের লালসা ও মোহের হতে পারে। এ ধরনের সম্পর্ক মানুষকে খুব দ্রুত কাতর করে তোলো। ফলে ফেসবুক আমাদের ব্যক্তিজীবন এবং দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনে জটিলতা ও অশান্তি সৃষ্টি করে।

অনেক সময় আমরা ফেসবুক ব্যবহার করতে করতে সচেতন বা অসচেতনভাবে ফেসবুকে কোনো স্ট্যাটাস, কমেন্ট বা শেয়ার দিয়ে দিই। সে ক্ষেত্রে আমাদের চিন্তা করার সুযোগ থাকে না যে, কোনো ধর্ম, কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে আঘাত হানা হয়েছে কি না; দেশদ্রোহিতা হয়েছে কি না। ফলে অনেক সময় নানরকম জটিলতাসহ আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারে। জেল-জরিমানাও হতে পারে।

ফেসবুককেন্দ্রিক বিনোদনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আসক্তি। অধিক সময় ফেসবুক ব্যবহার করতে করতে আসক্তি জন্মায়। যে প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো বিষয়ের প্রতি আসক্তি তৈরি হয়, ফেসবুককেন্দ্রিক আসক্তি সেই একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে। অর্থাৎ সমস্তিষ্কে আসক্তির এই চক্র আর অন্যান্য মাদকের আসক্তির চক্র একই। মাদকাসক্তিতে যে ধরনের শারীরিক বা মানসিক লক্ষণ দেখা যায়, ফেসবুক আসক্তিতেও সেই ধরনের শারীরিক বা মানসিক লক্ষণ পাওয়া যায়- ক্ষতির পরিমাণও সমান। আর ফেসবুক আসক্তির কারণে ব্যক্তিগত, পেশাগত আর সামাজিক জীবন- সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সুতরাং ফেসবুককেন্দ্রিক বিনোদন বলে কোনো ব্যক্তিগত বিনোদন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।